Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাবলু, তোমার কবর আমার হৃদয়ে

Icon

খন্দকার রেজাউল করিম

প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাবলু, তোমার কবর আমার হৃদয়ে

‘Thus let me live, unseen, unknown;

Thus unlamented let me die;

Steal from the world, and not a stone

Tell where I lie.’ -Alexander Pope

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পাড়ার আবু ভাই, আমির হোসেন, বাবলু, তারেক এবং আরও অনেকের মৃত্যু হয়। তারা কেউ ছিলেন আমার গুরুজন, কেউ বন্ধু, কেউ বা আমার স্নেহভাজন। তারা সবাই যে মারা গেছেন, তা-ও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, আরও লাখো শহিদের মতো অনেকের মৃতদেহের হদিস কখনো মেলেনি। তারা কেউ অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কেউ পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছিলেন, কেউ নিরপেক্ষ ছিলেন, কেউ বা মনেপ্রাণে পাকিস্তানপন্থি ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি সৈনিক বা পাকিস্তানপন্থিদের হাতেই এদের মরণ হয়। আমি এখানে বাবলুর কথা লিখতে চাই।

কবি আলেক্সান্ডার পোপ চেয়েছিলেন কেউ যেন তার কবরের চিহ্ন খুঁজে না পায়। বিদ্যুতের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে মৃত্যুর পরে তাকে সাধারণ মানুষের গোরস্থানে কবর দিতে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। কবি নজরুল ইসলামের ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’ গানটি অনেকেরই জানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশেই তাকে কবর দেওয়া হয়। এ বিদ্রোহী কবি আরেক জায়গায় লিখেছিলেন, তার কবর যেন হয় সব হতভাগ্য, অপমানিত, সর্বহারাদের মাঝে। বাবলুর মৃতদেহ হয়তো ওদের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি দেখেছি সারি সারি মৃতদেহ-ছেলে, মেয়ে, বুড়ো, শিশু, হিন্দু, মুসলমান-সব একাকার হয়ে নদীর পানিতে ভেসে যাচ্ছে। ২৫ মার্চের পর ঢাকার রাস্তায় দেখেছি অসংখ্য লাশ উলটেপালটে পড়ে আছে, লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালা, প্যান্ট-টাই পরা ভদ্রলোক, টুপি পরা মুসলমান, ধুতি পরা হিন্দু-সব একাকার। আমার ছেলেবেলার প্রিয় বন্ধু বাবলুর মৃতদেহ এদের মাঝেই কোথায় হারিয়ে গেছে।

বাবলুর পুরো নাম ছিল গোলাম মাহাবুব সাত্তার। আমাদের দুজনের বাড়ি একই পাড়ায়, একই স্কুলে পড়ি, একসঙ্গে হেঁটে স্কুলে যাই। বাবলু আমার চেয়ে দুই ক্লাস ওপরে পড়ে, দূরসম্পর্কে আমি বাবলুর মামা। তবে কখনো ওর সঙ্গে মামাত্ব ফলাতে যাইনি, সেটি বিপজ্জনক হতো, ওর গায়ে অনেক জোর, ব্যায়াম করা পেশিবহুল শরীর। দুজনই ছিলাম গোয়েন্দা উপন্যাসের পোকা। আমাদের স্কুলে একটি ঘরকে লাইব্রেরি হিসাবে ধরা হতো। সব সময় তার দরজায় মরচে পড়া এক তালা ঝুলে আছে। কদাচিৎ সেই ঘর খুলে দেওয়া হতো। ভেতরে কয়েকটি আলমারিভর্তি বই, একটি টেবিল, দুটি চেয়ার। চেয়ারে বেত নিয়ে বসে আছেন পণ্ডিত স্যার। আমরা লাইন করে একে একে ঘরের ভেতরে ঢুকে স্যারের সামনে দাঁড়াতাম। টেবিলের ওপরে অনেক বই গাদাগাদি করে রাখা, সেখান থেকে একটি বই স্যার আমাদের হাতে তুলে দিতেন। কার কপালে কী বই পড়বে, তা কে জানে? হয়তো আমি পেলাম লুৎফুর রহমানের লেখা ‘মহৎ জীবন’ বা কোনো এক মওলানার লেখা ‘ইহকাল এবং পরকালের কথা’ আর বাবলু পেল নীহারঞ্জন গুপ্তের লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস ‘কালো ভ্রমর’। গোয়েন্দা উপন্যাসগুলো সব বন্ধু মিলে ভাগাভাগি করে পড়তাম। দস্যু বনহুর, দস্যু মোহন, দস্যু বাহরাম জাতীয় বইগুলো আমাদের খুব প্রিয় ছিল। রোমানা আফাজের দস্যুরানী, দস্যু বাহারামের বউ সুফিয়া, ইত্যাদি ছিল আমাদের স্বপ্নের নায়িকা। রূপসী দস্যুরানির সঙ্গে গোয়েন্দার রোমান্টিক প্রেম এবং সংঘাত আমাদের কিশোর মনকে আবিষ্ট করে রাখত। কিরীটি রায় ছিল আমাদের পছন্দের গোয়েন্দা। ফেলুদা বা শার্লক হোমসের কথা তখন আমাদের জানা ছিল না। একবার লাইব্রেরি থেকে আমি পেলাম স্বপ্নকুমারের লেখা ‘চলন্ত ছায়া’ উপন্যাসটি। আমার পড়ার পরে বাবলু এবং হাসিবুলের হাত বেয়ে বইটি এসে পড়ল তারেকের হাতে। তারেকের বাবা ‘এলাহী মাস্টার’ ছিলেন ভয়ানক রাশভারী ভদ্রলোক। উনি সত্যি কোনো স্কুল বা কলেজের শিক্ষক ছিলেন কি না, তা আমার জানা ছিল না। তবে ওনাকে ভীষণ ভয় পেতাম। উনি ছেলের হাতে সব সময় পড়াশোনার বই দেখতে চাইতেন। ‘চলন্ত ছায়া’ দেখে ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি বইটি টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেন। আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। পণ্ডিত স্যারের হাতে কয়টা বেতের বাড়ি খেতে হবে কে জানে! আমার সব বিপদাপদের কাণ্ডারি ছিল বাবলু। ও আমাকে অভয় দিল। পণ্ডিত স্যার মাঝেমাঝে নাকে নস্যি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে হাঁচতেন। হাঁচির পরে কিছুক্ষণের জন্য নাকি তার মেজাজ ভালো থাকে, সেই সময়ে তার কাছে বই ছেঁড়ার দুঃসংবাদটা দিতে হবে। বাবলু আর আমি স্কুলের শিক্ষকদের কক্ষের সামনে ঘুরঘুর করছি, হঠাৎ এলো সেই বিকট হাঁচির শব্দ। হাজির হলাম স্যারের সামনে। জানালাম আমাদের দুঃখের কথা। স্যার ফুরফুরে মেজাজে আছেন। ধুতির প্রান্ত দিয়ে নাকটা মুছে বললেন, বাজার থেকে বইটি কিনে এনে দিলেই আমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। দুজনে মিলে রাজশাহী শহরের সব লাইব্রেরি চষে বেড়ালাম ‘চলন্ত ছায়া’র খোঁজে। কোথায়ও বইটি নেই। সাহস করে স্বপ্নকুমারের অন্য একটি বই, ‘রাত্রি যখন তিনটা বাজে’ কিনে পণ্ডিত স্যারের সামনে হাজির হলাম। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে স্যার বইটি নিতে রাজি হলেন।

বাবলু ছিল দুরন্ত সাহসী, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এক টগবগে কিশোর। পাড়ার গুন্ডা, পান্ডা, মাস্তান-সবাই ওকে ভয় করত। ও আমার বন্ধু, সেই সুবাদে আমিও কাউকে ভয় পেতাম না। একবার এক বিপত্তি ঘটল। কিছু বখাটে ছেলে প্রতি নববর্ষে পাড়ার ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন নামকরণ করে, কাগজে লিখে, পাড়ায় ছড়িয়ে দিত। যেমন পাড়ার এক কৃশকায় সুন্দরী মেয়ের উদ্দেশে লেখা হলো ‘লাঠির ভিতরে শরবত’। সে বছর বাবলুর নামকরণ করা হয় বালুর বস্তা। আমি আর দুলাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিলাম, বাবলু আসছিল সেই পথে। বাবলু ভেবে বসল যে ওর ‘বালুর বস্তা’ নামকরণই হলো আমাদের হাসির উৎস। বহু কষ্টে আমরা সেদিন বাবলুর হাতের মার থেকে রেহাই পাই।

আমাদের বাড়ি এবং আমার এক বোনের বাড়ি ছিল পাশাপাশি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দুটি বাড়িই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। আমাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে ছিল সে আমলের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসদের এক বিশাল ছাউনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরে ওরাই প্রথম পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। কিছুদিন সমানে সমানে যুদ্ধ চলে। পরে ঢাকা থেকে ভারী অস্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হয় নতুন পাকিস্তানি সৈনিক দল। ঢাকা থেকে উড়ে আসা ফাইটার বিমানগুলো আকাশ থেকে বোমা এবং গুলিবর্ষণ করছিল। হালকা অস্ত্রপাতি দিয়ে বাঙালি সৈনিকদের পক্ষে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় ওরা অনেকে আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, কিছু রাইফেল সেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রোশের প্রধান কারণ ছিল সেটাই। আমাদের বাড়িতে ছিল আমার মৃত বাবার অনেক কুরআন শরিফ। শুনেছি বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার আগে পাকিস্তানি সেনারা বলেছিল, ‘শালা কাফের, কাফেরের সাথে দোস্তি, এখানে এত কুরআন কেন?’ বাবুলদের বাড়ি ছিল একটু দূরে। দুই মাস পর আমার বোনেরা গ্রাম থেকে শহরে এসে যখন গৃহহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তখন বাবলুদের বাসায় কিছুদিন জন্য তাদের ঠাঁই মিলেছিল।

এইচএসসি পাশ করার পরে আমি ঢাকায় চলে আসি। বাবলু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে। আমার সঙ্গে কদাচিৎ দেখা হতো। একদিন শুনলাম বাবলু আলফা টোব্যাকো কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে যশোহর চলে গেছে। বাবলুর আম্মা সুফিয়া আপা, আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি আমার সঙ্গে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেছিলেন। রাজশাহী গেলেই তার সঙ্গে একবার দেখা করতে যেতাম। সুফিয়া আপাকে খুশি করার একটা উপায় ছিল বাবলুর খবর জানতে চাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবলুকে নিয়ে সুফিয়া আপার উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না। বাবলুর কোনো খবর নেই! মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, কত ছেলে মায়ের কোলে ফিরে এলো। বাবলু সুফিয়া আপার কোলে ফিরে এলো না। এরপর সুফিয়া আপার সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। বাবলুর কথা একবারও জানতে চাইনি।

বাবলুর মৃত্যু ঠিক কীভাবে হয়েছিল তা অজানাই রয়ে গেছে। অনেকের মতে, টোব্যাকো কোম্পানির কিছু অবাঙালি গুন্ডা এর জন্য দায়ী। আমার বিশ্বাস হয় না। যে অসম সাহসী যুবক খরস্রোতা পদ্মার উত্তাল ঢেউ তোলপাড় করে সাঁতার কাটতে পারে, তাকে কি এত সহজেই থামানো যায়? মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্যই বাবলুর মতো ছেলের জন্ম হয়। বিনা কারণে এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার মতো ছেলে বাবলু নয়। তবু জানতে ইচ্ছে করে ওর কথা। মরণের আগে কয়টা শত্রুকে খতম করেছিল, কয়টা নারীর সম্মান বাঁচিয়েছিল, কয়টা বোমা ছুড়েছিল, কয়টা পাকসেনাবোঝাই ট্রাক উড়িয়ে দিয়েছিল! মরার পরও বেঁচে থাকার আশায় মানুষ কবরের চারদিক ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়। বাবলুর জন্য তার প্রয়োজন নেই। বাবলুর মতো লাখো শহিদ অমর হয়ে বেঁচে থাকবে এ দেশের মানুষের স্মৃতিতে।

খন্দকার রেজাউল করিম : পদার্থবিদ ও গবেষক; ইমেরিটাস প্রফেসর, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

 

বাবলু হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধে

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম