Logo
Logo
×

বাতায়ন

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নতুন দেশ গড়ার প্রেরণা

Icon

আবদুস ছালাম

প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নতুন দেশ গড়ার প্রেরণা

বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয়, অনন্যসাধারণ দিন ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের অন্ধ কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৭২ সালের এই দিনে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের নায়ক, মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। দেশের মাটিতে এসেই আবেগে আপ্লুত অশ্রুসিক্ত নয়ন থেকে ঝরে পড়া অঝোর ধারা সামলে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ময়দানে নতুন স্বদেশ গড়ার দিশা দেখিয়েছিলেন সেদিন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িটি ঘিরে ফেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। অবিরাম গুলিবর্ষণের একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর বঙ্গবন্ধুকে জানান, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখন পরিবারের সবাইকে ডেকে বলেন, ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু জানবে, একদিন আমার মানুষ মুক্ত হবে। আমার আত্মা তা দেখে শান্তি পাবে।’

পাকিস্তান সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। ৪ ডিসেম্বর এ বিচার শেষ হয়। ১২টি অভিযোগের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাসহ ছয়টি অভিযোগের দণ্ড ছিল মৃত্যু। ইয়াহিয়া তার সেনা কর্তাদের রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠিয়ে গুলি করে শেখ মুজিবকে হত্যার দ্রুত প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। ১৫ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের একদিন আগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়ার যে পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে যে সেলে রাখা হয়েছিল তার পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছিল। এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ৬৭টি দেশের সরকারপ্রধানকে চিঠি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিয়ে ব্রিটেনে পাঠাতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের পরপরই ব্রিটিশ বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না। কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে স্বদেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু ভারতে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে ২১ বার তোপধ্বনিসহ ১৫০ জনের গার্ড অব অনার দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা, স্বাগত ও অভিনন্দন জানানো হয়। অবশেষে বঙ্গবন্ধু যখন ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে প্রিয় স্বদেশের মাটিতে নামলেন, তখন দুপুর ১টা বেজে ৪১ মিনিট। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা কমেট বিমানটি ওপর থেকে স্বপ্নের সোনার বাংলা অবলোকনের বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে অবতরণের আগে প্রায় ৪৫ মিনিট বিমানবন্দরের ওপর চক্রাকারে ঘুরেছিল। লাখ লাখ জনতা বিমানবন্দরমুখী রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলেছিল। বিমানবন্দর থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে এসে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ১৭ মিনিটের যে অনবদ্য ভাষণটি রেখেছিলেন, তা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের স্বপ্নের অভিযাত্রায় টনিকের মতো। উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক সোনার বাংলা গড়ার পথে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণটি এখনো আলোর দিশারি হয়ে কাজ করছে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম করেছে। আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম; কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায় রাখতে পারবে না। আমি আমার যেসব ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। প্রায় ৩০ লক্ষ শহিদের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ প্রাণ দেয়নি। তিনি বলেছিলেন, আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিও, এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে। দেশের মাটির প্রতি, দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় ভরা বঙ্গবন্ধুর এ বক্তব্য বাঙালি হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছিল।

তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের জনসাধারণ, সামরিক বাহিনীকে মোবারকবাদ জানানোর পাশাপাশি রাশিয়া, জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সমর্থনকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মোবারকবাদ জানিয়ে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ গড়ে তোলার শুভ সূচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় আমেরিকার সরকারকে মোবারকবাদ জানাতে না পারলেও আমেরিকার জনসাধারণকে মোবারকবাদ জানাতে বঙ্গবন্ধু সেদিন ভুলে যাননি।

মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্মাহুতি দেওয়া মহান শহিদদের স্মরণ করে আবারও আবেগে ভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার বহু ভাই, বহু কর্মী, আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই, তাদের আমি দেখব না।

আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম।

তিনি দেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলেন, দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন, আমার রাস্তা নাই আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। তোমরা আমার বাংলাদেশকে রিকোগনাইজ করো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-‘সাত কোটি বাঙ্গালি হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নাই’ কবিগুরুর কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ।

তিনি তার ভালোবাসার বাঙালির প্রতি আবদারের সুরে বলেছিলেন, আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই, তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সেদিন বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে, অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক বাংলায় কথা বলে না, তাদের বলছি তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি তাদের ওপর হাত তুলো না, আমরা মানুষ ভালোবাসি।

তবে যারা দালালি করছে যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করছে তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।

তিনি দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন, নতুন করে গড়ে উঠবে এ বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাবে, এই আমার সাধনা।

আজ ১০ জানুয়ারি। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পূর্ণতা লাভের ঐতিহাসিক দিন। এই দিনে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহিদদের। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মাতৃভূমির জন্য সম্ভ্রম হারানো আড়াই লাখ মা-বোনদের। স্মরণ করি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিহত হওয়া তার পরিবারের সব সদস্য, আত্মীয়, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের। বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি ৩ নভেম্বর কারাভ্যন্তরে ঘাতকের গুলিতে নিহত জাতীয় চার নেতা ও পরে বিনা বিচারে নিহত হওয়া মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের। স্মরণ করি সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বীর শহিদদের। সালাম জানাই একাত্তরের রণাঙ্গনের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

আবদুস ছালাম : সাবেক চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কোষাধ্যক্ষ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ

বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নতুন দেশ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম