Logo
Logo
×

বাতায়ন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন : শঙ্কা ও উত্তরণ

Icon

ড. শেখ আবদুস সালাম

প্রকাশ: ২০ মে ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গত ২৮ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শীর্ষক একটি আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদে পাস হয়েছে। এটি সম্প্রতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তা এখন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিবেচনাধীন রয়েছে। বর্তমান সময়ে একদিকে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের প্রেক্ষাপটে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অনেক সময় ভয়ানক অপরাধ সাধিত হওয়া, আবার কখনও কখনও ব্যক্তির মান-মর্যাদা নষ্ট হওয়া- এসব মাথায় রেখে সরকার এ আইনটি করতে যাচ্ছে।

এ আইনের সাহায্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তিও নেই। তবে সাংবাদিক সমাজ মনে করছে, আজকাল গণমাধ্যমও যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, সেজন্য এ আইনের কারণে তারা কাজ করার সময় কিংবা আগে-পরে পেশাগত ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এ আইন প্রণীত হলে এর মাধ্যমে তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন। এ আইনের প্রয়োজনীয়তা, আইনে সংবাদকর্মীদের শঙ্কার জায়গাটি চিহ্নিত করা এবং কীভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা যায়- এসব নিয়ে আজকের এই লেখা।

মিডিয়াসহ সবক্ষেত্রে প্রযুক্তির একধরনের আগ্রাসী প্রবেশের ফলে এখন নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হচ্ছে- কীভাবে মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির এ অদম্য উত্থান এবং একই সঙ্গে এসবের ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার সামাল দেয়া যায়। সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশের গণমাধ্যমও এ সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকারকে তাই গণমাধ্যমকর্মীদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার কথাও ভাবতে হচ্ছে কিংবা ভাবা উচিতও। এ কারণে ২০০৬ সালে সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইন-২০০৬ প্রণয়ন করে এবং পরববর্তী সময়ে তা দু’বার সংশোধন করে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এমন কিছু ধারা (যেমন : ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬) রয়েছে, যা বলবৎ থাকলে এসব ধারায় উল্লিখিত করণীয়, অকরণীয়, শাস্তি প্রভৃতির মারপ্যাঁচে যে কোনো সময় যে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে বিপদে ফেলা যায়। এরই মধ্যে বাংলাদেশে এমন বহু ঘটনাও ঘটেছে। সে কারণে দেশের সব জায়গা থেকে একসময় জোরালো আওয়াজ ওঠে- ‘৫৭ ধারা বিলুপ্ত করতে হবে’।

সাইবার ক্রাইমের আধিক্য, ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি প্রভৃতি মাথায় রেখে ২৮ জানুয়ারির মন্ত্রিসভায় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর খসড়া অনুমোদিত হয়। অতঃপর মন্ত্রিপরিষদ সচিব ঘোষণা দেন, এটি আইন হিসেবে পাস হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওপরে উল্লিখিত ওইসব ধারা বিলুপ্ত হবে। ৯ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি বিল আকারে আমাদের জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে এবং এরপর তা বাছাই কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আমরা এ পর্যায়ে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং গণমাধ্যম পরিচালনায় এ আইনের সম্ভাব্য অভিঘাত নিয়ে আলোকপাত করব। উল্লেখ্য, এ লেখাটি রচনাকালে ২০১৬ সালে প্রণীত এ আইনের (তৃতীয় খসড়া) সামনে রেখে তা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বিলটির ধারাগুলো অন্যথা হতে পারে।

সাতটি অধ্যায়ে বিস্তৃত প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিতে ৪৫টি ধারা রয়েছে। এ আইনের প্রথম অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত চারটি ধারায় আইনটির শিরোনাম, সংজ্ঞা, আইনের প্রাধান্য ও আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে বলা হয়েছে; দ্বিতীয় অধ্যায়ে থাকা দুটি ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি এবং জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন ও পরিচালনা সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো এবং সেসবের নিরীক্ষা ও পরিদর্শন বিষয়ে। আইনটির চতুর্থ অধ্যায়ে অপরাধ ও দণ্ডের ব্যাপারে বলা আছে। এ অধ্যায়ে ৯ থেকে ২৩ পর্যন্ত ১৫টি ধারা রয়েছে। এ ১৫টি ধারার মধ্যে অন্তত ১০টি ধারা ও উপধারায় এ আইন অমান্য করলে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির কথা বলা আছে। এ আইনের কোনো কোনো ধারায় শাস্তির মেয়াদ সর্বোচ্চ ১৪ বছর এবং সর্বনিু ২ বছরের কথা উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া এ আইনের বিভিন্ন ধারায় আইন লঙ্ঘনের জন্য অর্থদণ্ড হতে পারে সর্বনিু ১০ হাজার থেকে ১ কোটি টাকা- এমন কথাও বলা আছে। ধারা ১৬ অনুযায়ী ডিজিটাল সাইবার সন্ত্রাসী কার্যের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারদণ্ড হতে পারে বলেও প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ রয়েছে।

আইনটির পঞ্চম অধ্যায়ে (ধারা ২৪ থেকে ৩৮) তদন্ত ও তল্লাশি, ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সপ্তম অধ্যায়ে বিবিধ বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। এ আইনে ২৭ ধারায় কোনোরূপ পরোয়ানা ব্যতিরেকে ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার প্রভৃতির কথা বলা আছে। এ আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে : ধারা ৯, ১৫, ১৮ ও ২০-এ উল্লিখিত অপরাধগুলো আমলযোগ্য (Cognizable) ও অজামিনযোগ্য (Non-bailable ) হইবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে, প্রস্তাবিত আইনের ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য।

গত ৯ এপ্রিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি বিল আকারে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কর্তৃক যখন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়, তখন জাতীয় পার্টির এক সংসদ সদস্য বিলটির ওপর আপত্তি জানিয়ে বক্তব্য দেন। পরদিন পত্রিকাগুলো ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সেই ৫৭ ধারা’- এ ধরনের হেডলাইন করে খবর ছেপেছে। আমি এ লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন পত্রিকায় এ আইনের ওপর প্রকাশিত খবরাখবর পড়ে দেখার চেষ্টা করেছি। তাতে এ আইনের বিভিন্ন ধারায় বর্ণিত যেসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বলে মনে হয় সেগুলো হল : কোনো ব্যক্তি বা সত্তা যে কোনো উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট বা অনলাইন বা ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে কোনো উপায়ে সম্পূর্ণ অসত্য, ভুয়া, মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য প্রচার করে জনমনে যদি আতঙ্ক, ভীতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে, তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে একটি অপরাধ। (ধারা-১১)।

এ আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কোনো কিছু না থাকিলে, কোনো ব্যক্তি যদি এ আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধানের অধীন কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্ট্রার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তুতে প্রবেশাধিকার প্রাপ্ত হইয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে, কোনো ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্ট্রার, পত্র যোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (ধারা-১৭)।

১. কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধি (১৮৬০ সালের ৪৫ নম্বর আইন) এর ৪৯৯ ধারামতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটায় তাহা হইবে একটি অপরাধ।

২. কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনো কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যাহা মিথ্যা বা অশ্লীল এবং যাহা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে তাহা হইবে একটি অপরাধ।

কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যাহা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে বাংলাদেশের নাগরিকগণের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার ভাব বর্ধন করে বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তাহা হইলে উহা হইবে অপরাধ। (ধারা-২০)।

এ আইনের অধীনে অনুসন্ধান বা তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি বা সত্তা বা সেবা প্রদানকারী তদন্ত বা অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষা করিবেন। যদি কোনো ব্যক্তি এর বিধান লঙ্ঘন করে তাহা তা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। (ধারা-৩২)।

গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছেন আইনের ৩২নং ধারাটির। ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত, কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করে বা করতে সহায়তা করে তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’ আর এই অপরাধের শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। একাধিকবার কেউ এই অপরাধ করলে তার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

সাংবাদিক সমাজের বক্তব্য হল, কোনো সুরক্ষা ছাড়া এ ধারাটি আইনে পরিণত হলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে পড়বে সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। আইনটির ব্যাপারে ৬ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের হয়রানিমূলক ৫৭ ধারা বাতিল করে ওই ধারার বিতর্কিত বিষয়গুলো প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রেখে দেয়া এবং এর পাশাপাশি আরও নতুন কয়েকটি কঠোর ধারা সংযোজন করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’ তারা অবিলম্বে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ আইসিটি আইনের বিতর্কিত সব ধারা বাতিল এবং প্রস্তাবিত নতুন আইনে যুক্ত ৩২ ধারাসহ বিতর্কিত ধারাগুলো খসড়া থেকে বাদ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি প্রসঙ্গে অপরাধের ধরন ও শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে, তা গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনা এবং বাকস্বাধীনতায় আঘাত করবে; তা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এটি মুক্ত সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসরকেও সংকুচিত করবে। ১৯ জানুয়ারি সম্পাদক পরিষদ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে প্রস্তাবিত বিল/আইনের ২১, ২৫, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বাদ দিতে বা এ ধারাগুলো পুনর্বিবেচনার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। তারা আইনটির ৮ এবং ২৯ ধারা নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন।

মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করাসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলোর আসলে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই এবং ব্যাখ্যা দেয়াও কঠিন। আপাত দৃষ্টিতে এবং একাডেমিক বিবেচনায় এ কথাগুলো খুবই নির্দোষ। আমাদের সংবিধানেও এমন ধরনের কথা রয়েছে। আসলে মূল সমস্যা হচ্ছে- এসবের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ। প্রয়োগের সময় এর অপপ্রয়োগের সুযোগ থেকে যায় বেশি এবং অতীতে এমন অপপ্রয়োগ হয়েছেও। প্রভাবশালীরা তথ্যপ্রযুক্তি আইনটি সাংবাদিকদের হয়রানিতে ব্যবহার করেছেন, এমনকি সাধারণ মানুষও কোনো কোনো সময় হয়রানির শিকার হয়ে থাকতে পারেন।

কোনো ধরনের ‘নিরাপত্তা ক্লজ’ ছাড়া আইনে এ ধরনের ধারার অন্তর্ভুক্তির ফলে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা যেসব বাধার মুখে পড়তে পারেন তা হল : সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থায় গিয়ে সাংবাদিকরা ঘুষ-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে পারবেন না;

ঘুষ-দুর্নীতির কোনো দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারবেন না;

এসব অবৈধ কাজের কোনো ভিডিও বা অডিও করতে পারবেন না;

কোনো ডকুমেন্ট, ভিডিও, অডিও সংগ্রহ বা ধারণ করলেও তা প্রকাশ করতে পারবেন না ইত্যাদি।

যদি সাংবাদিকরা বৈধ অনুমতি না নিয়ে এসব করেন, তাহলে তারা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দায়ী হতে পারেন। সাধারণ মানুষও আর ঘুষ-দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করতে চাইবে না। তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হলেও আইনের ভাষা এমন যে তারা তার কোনো প্রমাণ বা ডকুমেন্ট প্রকাশ করলে এই আইনের শিকার হয়ে শাস্তি পেতে পারেন।

কী করা যেতে পারে?

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া এখন প্রকট। বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি কারও পক্ষে প্রযুক্তির বাইরে থাকা সম্ভব নয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ যেমন ভীষণভাবে উপকৃত হচ্ছে, তেমনি এর অপব্যবহারও কম হচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে রাষ্ট্রের যাতে ক্ষতি না হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার জন্যও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সেজন্য দেশে আইন, বিধিমালা ইত্যাদি থাকা প্রয়োজন। সাংবাদিক সমাজও এমন একটি আইন থাকার ব্যাপারে দ্বিমত করবে না। তবে নতুন আইনের কারণে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ যাতে কোনোভাবেই সংকুচিত না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এরই মধ্যে তথ্যমন্ত্রী এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী দু’জনই এমন মত ব্যক্ত করেছেন। তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের সময় এ সুযোগ সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের জন্য আইনের মধ্যেই বিশেষ ব্যবস্থা রেখে সেই আশঙ্কা দূর করা জরুরি। ৯ এপ্রিল এ আইনের বিলটি যখন জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়, তখন কোনো কোনো সংসদ সদস্যও হয়তো এমনটিই মাথায় রেখে আইনে সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা বা ‘সেফটি ক্লজ’ রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ক্লজে সাংবাদিকতা পেশাদারদের জন্য জামিন, নামমাত্র শাস্তি ছাড়াও এই আইনে কেস বা মামলা হওয়ার আগে ‘কুয়াসি জুডিশিয়াল’ (quasi-Judicial) কোনো বডি গঠন (যারা স্ক্রিনিং কমিটি হিসেবে কাজ করবে) করে তাদের Endorsement নিয়ে মামলা রজু করার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে এ বিষয় ক্রিয়াশীল করে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য আইন যেমন প্রয়োজন; আবার এ ধরনের আইনের ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, চিন্তা ও মতপ্রকাশের সময় সাংবাদিকদের যেন ভয়ের মধ্যে থাকতে না হয়, এমন একটি ভারসাম্য রেখে সরকার আইনটি পাস করার কথা ভাববে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

skasalam@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম