Logo
Logo
×

বাতায়ন

মানি লন্ডারিং অর্থনীতির এক দুষ্ট ক্ষত

Icon

রজত রায়

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের কত টাকা জমা আছে তার একটি ধারণা প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। ২০২০ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ২০১ কোটি টাকারও বেশি, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিরা জমা করেছেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি এ তথ্য প্রকাশ করে। যদিও সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয় বা টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। এ গোপনীয়তার নীতির কারণে সারা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশি এ ধনকুবেররা কিভাবে সেই অর্থ সুইস ব্যাংকে পাঠান, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হুন্ডি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেই এ অর্থ পাচার হচ্ছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থ সন্ত্রাসের মাত্রাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উন্নত ও অনুন্নত সব দেশই অর্থ সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ দেশেই অর্থের অবৈধ লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একইসঙ্গে অবৈধ অর্থ ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন অন্যায় কার্যক্রমে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদের সামাজিকভাবে বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই অর্থের উৎস গোপন করার জন্য মানুষ বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়। অবৈধ অর্থের উৎস গোপনকরণের মাধ্যমে সম্পদের বৈধতা দেওয়ার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকেই মানি লন্ডারিং হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। শুধু বিদেশে টাকা কিংবা সম্পদ পাচারের মাধ্যমে লন্ডারিং করা হয়ে থাকে-ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। বরং এটি মানি লন্ডারিং করার একটি উপায় মাত্র। দেশের অর্থনৈতিক গণ্ডির ভেতরে রেখেও অবৈধ সম্পদকে বৈধ করা যায়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে ‘ডমেস্টিক লন্ডারিং’।

মূলত, তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে মানি লন্ডারিং। যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে Stage of Money Laundering. অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢোকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানি লন্ডারিং। এটি হতে পারে ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ডিপোজিটের মাধ্যমে ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের টাকা জমা রাখার মাধ্যমে, অর্থনীতির পরিভাষায় এ ধাপটি পরিচিত ‘Placement’ নামে। এরপর শুরু হয় লেনদেন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে অর্থ ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হলে তা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া অ্যাকাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এ ধাপকে বলা হয় ‘Layering’। আর শেষ ধাপটি পরিচিত ‘Integration’ বা সমন্বয়করণ নামে। অর্থাৎ এ ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও মানি লন্ডারিংকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু সবসময় যে এ তিন ধাপে ব্যাপারটি ঘটে এমন নয়। ইলেকট্রনিক মানি, অফশোর ব্যাংকিং, ডার্ক ওয়েবের কারণে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

আমরা যখন কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করি, তখন তার একটি প্রমাণপত্র আমাদের দেওয়া হয়। এ প্রমাণপত্রে পণ্যটির দাম, ক্রয়ের তারিখ ইত্যাদি তথ্যের উল্লেখ থাকে। এটিকে বলা হয় ইনভয়েস কিংবা পণ্য ক্রয়ের স্মারক। ইনভয়েসকে কাটাছেঁড়া করে মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়াকে আবার ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কোনো একটি পণ্যকে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামের ইনভয়েসিং কিংবা চালানপত্র বানিয়ে অন্য দেশে পণ্য রপ্তানি করা হয়। ফলে আমদানিকারক পণ্যের মূল্য হিসাবে খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য দেশে থাকা রপ্তানিকারকদের কাছে চোরাচালান করে দিতে পারেন। আর যে কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এ প্রক্রিয়াটিকে অনুসরণ করে চোরাচালানকারীকে ধরা কঠিন। পাশাপাশি ভুয়া চালানপত্র তৈরি করে খুবই সাধারণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি করার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করে দেয় সন্ত্রাসী চক্র। আর আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অর্থের উৎস খুঁজে বের করা আরও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে ঠিক উলটো কাজটি করা হয়ে থাকে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে পণ্য রপ্তানি করে দেওয়া হয়। ফলে পণ্যের বাজারমূল্য বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমদানিকারকের কাছে পৌঁছে যায়।

প্রতিবছর কত টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয় সেই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথাও নেই। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র মোতাবেক, সম্প্রতি কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে, সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো, অর্থাৎ বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর একটি হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কারসাজি, আরেকটি পন্থা হলো হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়; ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। একইভাবে রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টি যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। অর্থ পাচারের বিষয়গুলো নজরদারির জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি ইউনিট গঠন করেছে অনেক আগেই। এর নাম ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য শর্তসাপেক্ষে অর্থ নেওয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেওয়া নিষিদ্ধ। তাহলে অনেক বাংলাদেশি কানাডায় বাড়ি কিনেছেন কীভাবে? সূত্র মোতাবেক, কানাডায় যে কোনো ব্যক্তি বাড়ি ক্রয় করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কানাডার নাগরিক না হলেও কোনো সমস্যা নেই। যারা পুরোপুরি নগদ টাকা দিয়ে বাড়ি ক্রয় করেন, তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী যে রপ্তানি করেন, সেখান থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশের ব্যাংকে রাখেন। সে টাকা বাংলাদেশে আসছে না। একটি দেশ থেকে টাকা তখনই পাচার হয়, যখন সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ আস্থা কম থাকে।

বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয়, তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটি দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়ত। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম আইন প্রণয়ন করে-মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২ (আইন নং-৭,২০০২)। পরবর্তী সময়ে ওই আইন বাতিল করে ২০০৮ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ প্রবর্তন করা হয়।

মানি লন্ডারিং দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থার গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা অবৈধভাবে আহরিত অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ করার প্রয়াস পায়, অর্থাৎ নেপথ্যে অন্য অপরাধ সংঘটিত হয়। এ ধরনের অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি জাতীয় ও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির অন্যতম। জিডিপির আকার বিবেচনায় বিশ্বে ৪১তম। গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। অর্থনীতির এ গতিশীল ধারা বজায় রাখতে মানি লন্ডারিং নামক দুষ্ট ক্ষত প্রতিরোধে আমাদের যথাযথ ভূমিকা নিতে হবে।

রজত রায় : অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম