নতুন জন্মদিন, নতুন শুভেচ্ছা
পবিত্র সরকার
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ ১ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের নতুন এক জন্মদিন, তার জন্য আমার ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা তো থাকবেই। এক যুগের বেশি হলো, যুগান্তরের সঙ্গে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে, তা পাঠকরা জানেন। এখন প্রধানত এ পত্রিকার সূত্রেই আমার সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের বৌদ্ধিক মোলাকাত ঘটে। আমি যা লিখি তা সব সময় বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কিনা জানি না, কিন্তু আমি তো ঠেলেঠুলে পাঠাই। তারা আদর করে আমার লেখা ছাপেন দেখে কৃতার্থ থাকি।
তবে জন্মদিনের হিসাবের মানসিক প্রতিক্রিয়া তো একেক প্রতিবেশে একেক রকম। ব্যক্তির জন্মদিনের হিসাব এক রকম, আর প্রতিষ্ঠানের জন্মদিনের হিসাব আরেক রকম। ব্যক্তিরও আবার নানা বয়স অনুসারে জন্মদিনের হিসাব-নিকাশ বদলে যায়, তা কে না জানে? শিশুর জন্মদিন সব পরিবার আর আত্মীয়স্বজনের কাছে মহা-আনন্দের ব্যাপার; বেলুন, কেক, প্রচুর খেলনা, চকোলেট, উপহার এসব নিয়ে। শিশু অবশ্য জন্মদিনের সঙ্গে বৃহৎ জীবনের সম্পর্কটা যে ঠিক কী, তা বোঝে না। জন্মদিন যে জীবন নামে কমবেশি লম্বা; কিন্তু অনন্ত নয় এমন সিঁড়ির একটা ধাপ এবং এই ধাপ বেয়ে উঠতে উঠতে এক সময় শেষ একটা ধাপ আসবে, এই জ্ঞান শিশুকে দেওয়ার মতো নয়, তার আগে অনেক জরুরি জ্ঞান তার প্রাপ্য।
আমাদের বুড়োদের কথা অবশ্য আলাদা, আর এই অতিমারির দুবছরে আমাদের সিঁড়ির শেষ ধাপটা কত লাখ মানুষের জন্য ঝপ্ করে হঠাৎ নেমে এলো, তাদের মধ্যে কত মানুষ আমাদের প্রিয় ছিলেন, প্রার্থিত ছিলেন, সে কথাটা খুব তীব্র হয়ে সামনে আসছে। তাই আমাদের মতো বৃদ্ধদের জন্মদিন সেই সিঁড়িটার হিসাব করতেই থাকে, করতেই থাকে।
প্রতিষ্ঠানের জন্মদিনের মতো একেবারে অন্যরকম। তার চলার পথ অনন্ত, সিঁড়ির ধাপের কোনো শেষ নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যায় কত প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে সংবাদপত্রও আছে। আমাদের ভারতেই একাধিক সংবাদপত্র আছে, যারা শতবর্ষ পার করেছে, ইংরেজি, বাংলা দুই-ই। তাদের কারও নামের পরিবর্তন হয়েছে; যা ছিল The Friend of India, তা-ই হয়তো হয়েছে The Statesman। এক সময় কোনো কাগজ ছিল রাজার পক্ষে, স্বাধীনতা আর দেশভাগের পর হয়তো এসেছে প্রজার কিংবা নতুন দেশি রাজাদের পক্ষে। পরিচালনা-সংগঠনের বদল হবেই অনিবার্যভাবে, সেই সঙ্গে জীবনদর্শনের। যাই ঘটুক, ‘যুগান্তরে’র যাত্রা শতাব্দীর দিকে এগোক, শতাব্দী পার হোক, আমাদের তুচ্ছ অস্তিত্বকে পেছনে ফেলে সময় আর ইতিহাসের নানা দিগন্ত অতিক্রম করে যাক।
২.
আমি একটা ব্যাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন হব কিনা বুঝতে পারছি না; বুঝতে পারছি না যে, উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজেকে চূড়ান্ত নির্বোধ বা পশ্চাৎপদ প্রমাণ করতে চলেছি কিনা। আমি দেখছি, অন্তর্জালে (ইন্টারনেট) ও হোয়াটসঅ্যাপে প্রচুর পত্রপত্রিকা পড়তে পাওয়া যাচ্ছে। আমি নিজে, বোকামির আরেকটা প্রমাণ, আর টেলিভিশন দেখি না, বাড়িতে ওই একটি যন্ত্র তার আধুনিক সংস্করণ নিয়ে থাকা সত্ত্বেও। অর্থাৎ আমি নিছক মুদ্রণ-সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছি। সকালে চারখানা বাংলা কাগজ পড়ি, রোববারে তা ছয়খানা হয়। ইংরেজি কাগজ দরকার হলে অন্তর্জাল থেকে পড়ে নিই। লক্ষ করি যে, অন্তর্জালে শুধু যে কাগজগুলোর মুদ্রিত সংস্করণ পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়, অনেক কাগজ অন্তর্জালের জন্য বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করেছে, সেগুলো বেশ চলছেও। আমিও তার কোনো কোনোটাতে লিখি। এখন প্রশ্ন হলো, মুদ্রিত সংবাদপত্র কি এভাবে সংস্কৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে? শুধু অনলাইন বা বিম্ব-সংবাদপত্র থাকবে? প্রবণতা যেন সেই দিকে। তার সমস্যাগুলো আমি যে বুঝি না তা নয়। আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে কাগজের পাতার সপাট আওয়াজ করে পড়া, বিছানায় শুয়ে পড়া আর হবে না, বিম্ব-কাগজ পড়ার জন্য আমাদের একটু মেরুদণ্ড সোজা করে বসতে হবে।
এ হলো যাদের ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ আছে তাদের সমস্যা। অনেকের তা নেই, কিন্তু তাদের হয়তো স্মার্টফোন আছে বা হবে। এ অতিমারির মৌসুমে শিক্ষাদীক্ষার জন্যও তা অতিশয় জরুরি হয়ে উঠছে, রাষ্ট্র তার জন্য এগিয়ে এসে গরিব ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব বা স্মার্টফোন বিলি করছে, তা-ও দেখা যাচ্ছে। আমি জানি না ডিজিটাল বাংলাদেশ বা ইন্ডিয়া বলতে এই ক্ষমতায়নও বোঝায় কিনা। কিন্তু শুধু ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপই যথেষ্ট নয়, বিদ্যুৎ আর টাওয়ারও ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। কবে আমরা পুরোটা সমাধা করতে পারব জানি না। ভাত-কাপড়-শিক্ষা-চিকিৎসা তো আগে চাই। তবু যদি এক সময় এভাবে ছায়া খবরের কাগজ সবার কাছে পৌঁছায় তাহলে সে কাগজ ছাপার আর দরকার হবে না, অফসেট যন্ত্রপাতিরও না। অনেক ঝামেলা বাঁচবে, কাগজের মূল উপাদান লাখ লাখ গাছ (বাঁশ থেকে পাইন) বেঁচে যাবে, হয়তো ভালোই হবে। তবে সব ভালো জিনিসেরই যেমন একটা খারাপ দিক আছে, স্কুলের রচনায় ‘উপকারিতা’ ‘অপকারিতা’ লিখতে হতো আমাদের, তেমনি এ শিল্পে প্রচুর লোক বেকার হবে, জানি না অর্থনীতির ব্যবস্থাপকরা তার কথা ভেবে রেখেছেন কিনা। কী হতে চলেছে সেই ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব ধন্দে আছি। জানি না সেটি নির্বোধের ধন্দ, না চালাকের। কী জানি, চালাকরা কি কখনো ধন্দে পড়ে?
৩.
কাগজ যদি প্রেস থেকে উবে গিয়ে কম্পিউটারে ঢোকে, তার একটা জিনিস থেকেই যাবে, তা তার ভাষার রচনা। কাগজ তো ভাষাতেই লিখতে হবে। ফেব্রুয়ারি সেই মাস, যা বাংলা ভাষাকে সারা পৃথিবীতে এক বিশেষ গৌরবের আসন দিয়েছে। কৃতিত্ব তো মাসের নয়, কৃতিত্ব বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের, যারা নিজেদের ভাষার অসম্মান সহ্য না করে পথে বেরিয়ে এসেছিলেন, শাসকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন। সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
কিন্তু সেই ভাষাটার শরীর-স্বাস্থ্য ঠিকঠাক আছে কিনা, তার খবর কি আমরা নিই? নাকি গ্রামের বাড়িতে, বা প্রবাসীদের দেশের অ্যাপার্টমেন্টে ফেলে রাখা মায়ের মতো মাঝে-মধ্যে টেলিফোনে খোঁজখবর নিই তার, আর নিজেরা তাকে নিয়ে তালগোল পাকাতে থাকি? ভাবি যে বাংলা ভাষার দেখভাল করার দায়িত্ব লেখক আর কাগজপত্রের, আমি আমার ‘মুখের বাণী’ নিয়ে ইচ্ছামতো খেলা করতে পারি? আমার কথায় ফুলঝুরির মতো ‘বাট্’, ‘সো’, ‘অ্যাকচুয়ালি’, ‘প্র্যাকটিক্যালি’, ‘ওকে ওকে’, ‘মাই গড্’, ‘ননসেন্স!’, ‘থ্যাংক ইউ!’, ‘সরি, সরি’ এসে ভাষার গায়ে ফোসকা ফেলবে, আমার মুখের বাংলাটা ক্রমেই ‘বাংলিশ’ হয়ে যাবে, বাংলার মতো কম শোনাবে, ইংরেজি থেকেও বহুদূরে থাকবে, আর আমরা মহাসমারোহে শহিদদের স্মরণ করব। কাদের দায় ভাষাকে রক্ষা করা? শুধু লেখকদের, শুধু সংবাদপত্রের? আমি যে ভাষাটা বলছি, তার দিকে খেয়াল রাখব না? ইংরেজি শব্দ তো আসবেই আমার ভাষায়, কিন্তু তার যেখানে দরকার নেই, তাকে দিয়ে ভাষার চেহারা বদলে দেব?
যুগান্তরের জন্মদিনে এসব প্রশ্ন তুলে অপরাধ করলাম কিনা জানি না।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
