Logo
Logo
×

বাতায়ন

আমাদের বিচ্ছিন্নতা ও শিয়াল-কুমিরের গল্প

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের বিচ্ছিন্নতা ও শিয়াল-কুমিরের গল্প

প্রকৃতির লীলাভূমি আমাদের স্বদেশ। গানের দেশ, পাখির দেশ বাংলাদেশ। পৃথিবীর কম দেশেই পশুপ্রাণী তথা এমন জীববৈচিত্র্যের সমাহার লক্ষ করা যায়। কবির ভাষায়-‘পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমার দেশ ভাই রে ...।’ গীতিকবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি-‘...তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জাগে।’ নানা আকৃতি-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য আর বর্ণের পাখি এবং পশুর ডাকগুলোর সঙ্গে এ দেশের সাধারণ মানুষ বেশ পরিচিত।

তবু মনের খেয়ালে সামনে থাকা বাংলা অভিধানটি খুলে বেশ কটি পশুপাখির ডাকের অর্থ একনজর দেখে নিলাম। এতে দেওয়া আছে ‘কিচিরমিচির’ মানে পাখির কলরব। ‘কুহু’ কোকিলের আর ‘কেকা’ ময়ূরের ডাক। ‘কুক্কুরু ... কু’ মোরগের ডাক, ‘কা কা’ কাকের ডাক। ‘মিউ, মিউমিউ’ বিড়ালের এবং ‘ঘেউ ঘেউ’ কুকুরের ডাক। ঠিক এমনই ‘হাম্বা’ গরু, ‘হ্রেষা’ ঘোড়া ও ‘বৃংহণ’ হাতির ডাক। পশুদের মধ্যে ‘হুক্কাহুয়া’ শিয়ালের ডাক।

পশুপাখিদের মধ্যে যত প্রজাতি আছে, তার মধ্যে এ ভূখণ্ডের অধিবাসীরা বোধকরি বেশি পরিচিত শিয়াল আর তেমনি অভ্যস্ত শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাকের সঙ্গে। অবশ্য এর নানা কারণও রয়েছে। বাংলাসাহিত্য রচনায় শিয়াল এক গুরুত্বপূর্ণ ও রসময় উপাদান। উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের অসংখ্য রচনায় ফুটে উঠেছে দেখতে অনেকটা অসুন্দর শেয়ালের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য-আচরণ।

‘শিয়াল পণ্ডিত’, শিয়ালের সাত ছালা বুদ্ধি’, ‘শিয়াল মশাই’, ‘শিয়াল চোরা’ সহিত্যকর্মে আরও কতভাবেই না চিত্রিত করা হয়েছে শিয়ালকে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আর আধুনিকতায় উৎকর্ষের এ যুগেও শিয়ালকে কেন্দ্র করে প্রচলিত হাসির গল্প আর ওদের হুক্কাহুয়া ডাক শুনিয়ে ঠাকুমা-দিদিমা ও বাবা-মা এবং অন্য গুরুজনরা অবোধ-আত্মভোলা শিশুদের ভাত খাইয়ে দেন। একইভাবে গল্প বলে শান্ত করেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘুম পর্যন্ত পাড়ান।

ধূর্ত শিয়াল, কাক ও মাংসের টুকরো নিয়ে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত উপদেশমূলক গল্পটির কথা বোধকরি সবার মনে আছে। ছোঁ মেরে শিশুর হাত থেকে কেড়ে নেওয়া মাংসের টুকরো মুখে গাছের আগায় বসা কাককে দেখে লোভী ধূর্ত শিয়ালের সে কী প্রশংসা! ‘আহা, পাখিটি দেখতে কতই না সুন্দর, না জানি এর কণ্ঠ কত সুমিষ্ট আর মধুর, কিন্তু পাখিটি হয়তো বোবা, কথা বলতে পারে না!’ এই গল্পের উপদেশ-‘দুষ্টু লোকের মিষ্ট কথায় কখনো ভুলিতে নাই’।

উপেন্দ্র কিশোরের কুমির ছানা ও শিয়াল পণ্ডিতকে নিয়ে তৈরি গল্পে সে কী সংলাপ! কুমিরের বন্ধু শিয়ালের ছাত্র সাতটি কুমির ছানা। শিয়াল : বল তো বাপুরা, ‘কানা খানা গানা ঘানা কেমন লাগে কুমির ছানা ...!’ রবীন্দ্রনাথের ‘চুরির ফল’ শিরোনামের শিক্ষামূলক ছড়া-কবিতাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের পাঠ্য ছিল। শুরুটা এভাবে-‘আমড়া গাছের ঝোপের ভিতর মৌমাছিদের বাসা/মাঝখানে তার প্রকাণ্ড এক চাক রয়েছে খাসা/তাই না দেখে শিয়াল মশাই মধু খাওয়ার তরে/সেই পথেতে সকাল বিকাল আনাগোনা করে ...।’ কবিতাটির শেষের অংশ : ‘হুলের জ্বালায় ঝালাপালা প্রাণটা রাখা ভার/কাতর হয়ে বলে শিয়াল ছাড় না রে ভাই ছাড়/পথ ভুলে ভাই এসেছিলাম আমড়া গাছের কাছে/তা নাহলে হেথায় আসে এমন গাধাও আছে?’

প্রচণ্ড চালাক যারা, তারাও লোভে পড়ে বিপদ ডেকে আনে। বাঁচার তাগিদে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। অতিলোভ বিপদের কারণ; এটাই কবিতাটির শিক্ষা। বিশ শতকের অন্যতম বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তার একটি কবিতার দুটি চরণ-

‘হুক্কাহুয়া কুমির মশাই!

নমস্কার!-এবার পালাই!’

শিয়ালকে উপলক্ষ্য করে অনুরূপ অন্য একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘এক যে ছিল শিয়াল

তার বাপ দিয়েছিল দেয়াল

সেই বা কম কিসে

তারও হল খেয়াল।’

শিয়াল ও শিয়ালের ডাককে নিয়ে বর্তমানের কবি-সাহিত্যিকরাও কম যান না। ছড়াকার ফেরদৌস চৌধুরী আমার স্কুলজীবনের সহপাঠী-বন্ধু। তার প্রকাশিত প্রথম ছড়ার বইটির নাম দিয়েছেন ‘হুক্কাহুয়া সবই ভুয়া’।

শৈশব ও বাল্যস্মৃতি বলে কথা। শিয়ালের ডাক আর অস্তিত্ব আমাদের প্রত্যেকের মনে গেঁথে রয়েছে। শিয়ালের সঙ্গে কুকুরের অহিনকুল সম্পর্ক। আমাদের গ্রামের বাড়ি লাগোয়া প্রতিবেশী মুসলমান বাড়িগুলোতে মুরগি লালন-পালন করত। মাঝে ঝোপঝাড়-জঙ্গল। ছেলেবেলায় দেখেছি, দু-চারদিন পর পর একদম ভোরবেলা কিংবা দিনশেষে সন্ধ্যায় সুযোগ বুঝে ‘শিয়াল-চোরা’ মুরগির ওপর চড়াও হতে। বাড়ির লোকজন (বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা) টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে-‘ধ্ ধর্, মুরগিটা নিয়ে গেল ... ’ ডাক হাঁকতে হাঁকতে লাঠিসোঁটা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত শিয়াল বধের অভিযানে। একই সঙ্গে বাড়ির কুকুরও মনিবদের এ অভিযানে যোগ দিত। এতে অনেক সময় মুখের শিকার ফেলে রেখে শিয়াল দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।

আমাদের দেশে ইদানীং বরেণ্য বুদ্ধিজীবী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখনিঃসৃত ‘হুক্কাহুয়া’ শব্দটি যেভাবে এবং যে অর্থে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতীতে তা আর কখনো হয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে তার বক্তব্য সর্বত্র বেশ ভাইরাল হয়েছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন-‘আজকাল আমাদের দেশে দেখবেন, ভালো মানুষরা বিচ্ছিন্ন। ভালো মানুষদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। তারা একা, পরস্পরকে খুঁজে পায় না। কিন্তু যারা খারাপ, তারা খুব সংঘবদ্ধ। এক শয়তান ‘হুক্কাহুয়া’ দিলে মুহূর্তেই হাজারো শয়তান ‘ক্যায়া হুয়া’ বলে এগিয়ে আসে।’

কথাটা অমূলক নয়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ হয়তো তার দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই এমন উপলব্ধিতে আসতে পেরেছেন। সরকারি আর বেসরকারি নেই, সংস্থা-সংগঠন-প্রতিষ্ঠান, ছোট আর বড়, উচ্চ পদধারী আর পদবিহীন-সবখানে, সবার মাঝেই বলতে গেলে এক আওয়াজ ‘হুক্কাহুয়া’। অন্যদিকে দুঃখজনক হলেও সত্য, এই হুক্কাহুয়া ‘কোরাসে’র বিপরীতে কম-বেশি সবার কাছেই বেশ দৃশ্যমান একটি ছবি ‘বিচ্ছিন্নতা’।

সবখানে দেখা গেলেও এমন বাস্তবতা নিজের জীবনে কখনো না এলে তা কারও পক্ষে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই বিচ্ছিন্নতা, উদাসীনতা বা নিজেকে-নিজেদের সরিয়ে রাখার প্রবণতা আমাদের দিন দিন আরও দুর্বল, আরও বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। চারদিকে শঠ-খল আর দুর্বৃত্তদের ‘বাক বাকুম’ আওয়াজ।

দুইশ বছরের ইংরেজ শাসন। পাকিস্তানি শাসন চব্বিশ বছরের। অবশেষে প্রিয় স্বপ্নের স্বাধীনতা লাভ, তা-ও একান্ন বছরে গড়াল। এখনো যদি ‘উল্টো ঘোরার’ সময় না আসে, তাহলে আর আসবে কবে?

বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

আমাদের বিচ্ছিন্নতা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম