Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষকের মর্যাদা ও গুণগত শিক্ষা

Icon

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক

প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষকের মর্যাদা ও গুণগত শিক্ষা

সম্প্রতি আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন-শিক্ষকের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি না পেলে ‘গুণগত শিক্ষা’ অর্জিত হবে না। টেকসই উন্নয়নের যে চার নম্বর লক্ষ্যটি শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত এর তিনটি উপাদানের একটি হচ্ছে এই ‘গুণগত শিক্ষা’, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করব বলে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি। সেই লক্ষ্যে সরকার নতুন কারিকুলাম তৈরি করছে, এখন পাইলটিং চলছে, সামনের বছর থেকে সেটি বাস্তবায়ন শুরু হবে। এরকম একটা সময়ে শিক্ষামন্ত্রীর এ কথাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

শিক্ষায় যখনই একটা বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়, তখনই এ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ধকলটা পোহাতে হয় শিক্ষকদের। তারা কোনো একটি বিষয় কোনো একভাবে পড়াতে পড়াতে যখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেন, তখনই একদিন হঠাৎ বলা হয়, তাদেরকে কোনো নতুন বিষয় নতুনভাবে পড়াতে হবে বা মূল্যায়ন করতে হবে। হঠাৎ বলছি এই কারণে যে, প্রায়ই দেখা যায়, শিক্ষকদের প্রস্তুত না করেই তাদের নতুন একটি বিষয় নতুন একটি পদ্ধতিতে পড়াতে কিংবা মূল্যায়ন করতে বলা হয়। এতে দুটো সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত তারা ধন্ধে পড়ে যান এবং দ্বিতীয়ত এর জন্য যে বাড়তি পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়, মর্যাদাহীনতায় ভোগার কারণে সেই বাড়তি পরিশ্রম করার কোনো উদ্দীপনা তাদের মধ্যে তৈরি হয় না।

এ রকম ঘটনা যে আমাদের দেশে ঘটেছে, তার অন্তত তিনটি উদাহারণ দেওয়া যাক। ১৯৮৭-এর দিকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষায় কমিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচ বলে একেবারে নতুন একটি শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং এর সঙ্গে নতুন টেক্সটবই সংযোজন করা হয়। ২০১০ সালে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে চালু হয় সৃজনশীল শ্রশ্ন পদ্ধতি। ২০১২ সালে আসে নতুন কারিকুলাম এবং এর সঙ্গে নতুন টেক্সটবই। এ তিনটির কোনোটিতেই আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। কমিউনিকেটিভ অ্যাপ্রোচ চালু করে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেল না বলে কাগজে-কলমে থাকলেও, পরে তা একপ্রকার উঠে গেল। একইভাবে, ২০১২ সালের কারিকুলামের কিছু বিষয়, যেমন-ফরমেটিভ এসেসমেন্ট বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন সত্যিকার অর্থে চালু করা যায়নি। আর সৃজনশীল প্রশ্নপত্র যে অনেক শিক্ষক এই এগারো বছরেও বুঝে উঠতে পারেননি, এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বহুবার লেখালেখি হয়েছে।

শিক্ষকরা কেন এগুলো বাস্তবায়ন করলেন না বা করতে পারলেন না, এর মুখ্য যে তিনটি কারণ আছে এর সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। প্রথমটি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় যে আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদার কথা বলেছেন সেটি। অর্থাৎ তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা যথেষ্ট নয় বলে তারা বাড়তি পরিশ্রম করে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কোনো উৎসাহবোধ করেননি। দ্বিতীয় কারণটিও সরাসরি তাদের মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত। উল্লিখিত তিনটি বিষয় যখন সংযোজন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, তখন শিক্ষা-বাস্তবতা সম্পর্কে সবচেয়ে যারা ভালো জানেন, সেই শিক্ষকদের মতামত বা পরামর্শ নেওয়া হয়নি। এভাবে তাদের এড়িয়ে যাওয়ায় অন্তত দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কারিকুলাম প্রণেতাদের বাস্তব অবস্থা থেকে একটু দূরে থেকেই তাদের কাজটি করতে হয়েছিল এবং অবহেলিত ও বঞ্চিতবোধ করেছিলেন বলে শিক্ষকরাও এর বাস্তবায়নে তেমন উৎসাহবোধ করেননি। তৃতীয়ত, নতুন একটি বিষয় নতুনভাবে পড়ানোর জন্য যে প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন ছিল, সেটিও দায়সারাভাবে দেওয়া হয়েছিল বলে শিক্ষকদের কাছে ওই অচেনা-অজানা সংযোজনগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।

শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত যে তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলোর দিকে নজর না দিলে বাংলাদেশের শিক্ষায় কোনো সংযোজন যে সফল হবে না, তা বুদ্ধি দিয়ে না হলেও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বুঝে গেছি। এ কারণেই শিক্ষামন্ত্রী চমৎকারভাবে এ সত্যটি উচ্চারণ করেছেন। তিনি যে কেবল কথার কথা বলেছেন, তা নয়। তিনি ইতোমধ্যে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন। আমি উপরে যে তিনটি বিষয়ের কথা বললাম, এর অন্তত শেষ দুটির দিকে যে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন, সেটি এখন স্পষ্ট। যেমন ২০২৩ সালে কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে এ বছর যে পাইলটিং হচ্ছে, এ রকম আগে কখনো হয়নি। অর্থাৎ কারিকুলাম প্রণয়ন করার সময় শিক্ষকরা আগে কখনো এভাবে যুক্ত হননি। এবার শিক্ষকরা নিজেরা এ নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে তাদের মতামত সরাসরি সরকারকে জানাতে পারবেন, তাদের নিজেদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বলতে পারবেন, তাদের স্কুলের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারবেন, নতুন কারিকুলামের জন্য শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা কতটা তৈরি সে সম্পর্কে মতামত দিতে পারবেন এবং এ কারিকুলাম আসলে কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে এর একটা ধারণা দিতে পারবেন। সর্বোপরি, গুণগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জীবনব্যাপী শিক্ষা অর্জনে এ কারিকুলাম কতটা সহায়ক হবে, সেটি তাদের কাছ থেকেই সবচেয়ে ভালোভাবে জানা যাবে।

শুধু তাই নয়, শিক্ষামন্ত্রী এবার শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন, যা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ অর্থাৎ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগেই মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষক এ প্রশিক্ষণ পেয়ে যাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়াও এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করার জন্য যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা প্রয়োজন, করোনার মধ্যেই এর অনেকটা তিনি প্রস্তুত করে ফেলেছেন। নতুন কারিকুলামে প্রকল্পভিত্তিক অভিজ্ঞতামূলক শিখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিখন-শেখানো পদ্ধতি হবে, যার কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মাউশি ইতোমধ্যে সারা দেশে দুটো প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে-‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ এবং ‘মুজিববর্ষে গাছ রোপণ পরিবেশের সংরক্ষণ’। এ দুটো প্রকল্পই দৃশ্যমানভাবে সফল হয়েছে। সারা দেশে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রায় এক লাখ ডকুমেন্টারি তৈরি করে ফেলেছে এবং প্রায় এক লাখ রিপোর্ট লিখেছে। আর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শুধু ওই প্রকল্পের আওতায় নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের পছন্দমতো, নিজেদের পরিচর্যায় এবং নিজেদের জায়গায় প্রায় ২৫ লাখ গাছ লাগিয়েছে। নতুন কারিকুলামে কমিউনিটি সার্ভিসের কথা আছে। শিক্ষকরা পাশে থাকলে শিক্ষার্থীরা যে এ কাজ উৎসাহের সঙ্গে করতে পারে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। করোনার সময় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে হাওড় অঞ্চলে প্রায় দশ হাজার একর জমিতে তারা বোরো ধান কেটে দিয়েছে।

নতুন কারিকুলামে শিখন-শেখানোর ক্ষেত্রে আরও যে দুটো বিষয় গুরুত্ব পাবে, সেগুলো হচ্ছে দূরশিক্ষণ ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়ন। এ দুটি বিষয়েও শিক্ষকরা ইতোমধ্যে বহুদূর এগিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই টিভি ক্লাস ও অনলাইন ক্লাসে পারঙ্গম হয়ে উঠেছেন। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট বিস্ময়কর অবদান রেখেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন উভয় ক্ষেত্রে অ্যাসাইনমেন্ট অত্যন্ত কার্যকর ছিল এবং নতুন কারিকুলামের যেটা অন্যতম লক্ষ্য ‘স্বশিক্ষা’, সেই লক্ষ্য অর্জনেও অ্যাসাইনমেন্ট একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য গুরুত্ব পাবে বলে ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ শিক্ষককে পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, এখন প্রায় দুই লাখ শিক্ষককে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ চলছে এবং প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে স্বাস্থ্যসম্মত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার কাজও বহুদূর এগিয়ে গেছে। নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের বিএমআই মাপার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য রক্ষায় সারা দেশে সাত কোটি আয়রন ফলিক এসিড সরবরাহ করে তা খাওয়ানোর কাজ শুরু হয়েছে।

অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রী এতদিন যা করেছেন, তা প্রমাণ করে যে তিনি যা বলেছেন সত্যি সত্যিই তিনি তা বিশ্বাস করেন এবং শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তিনি নিশ্চিতভাবেই সচেষ্ট থাকবেন। তবে এটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের খুব বড় একটা সিদ্ধান্তের বিষয়। এখানে শিক্ষকদেরও একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। আসন্ন কারিকুলামটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করে তাদের প্রমাণ করতে হবে, যে মর্যাদা শিক্ষামন্ত্রী তাদের দিতে চান তা পাওয়ার যোগ্যতা তারা রাখেন।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক; অধ্যাপক ও ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ

শিক্ষক মর্যাদা গুণগত শিক্ষা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম