Logo
Logo
×

বাতায়ন

হরমুজ প্রণালি সংকটে ছুরি কার গলায়?

Icon

আখিউজ্জামান মেনন

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২২, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হরমুজ প্রণালি সংকটে ছুরি কার গলায়?

গত ২৮ জুন কাতারের রাজধানী দোহায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনা ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল ব্যাপক আগ্রহ। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল ‘ইরান পরমাণু চুক্তি’ অর্থাৎ জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তিকে পুনরায় কার্যকর করা। উল্লেখ্য, পরমাণু কর্মসূচি সীমিতকরণে রাজি হওয়া ইরান এ চুক্তিতে যুক্ত হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ চুক্তি থেকে বের করে নিয়ে আসেন এবং ইরানের ওপর আগেকার নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেন।

জেসিপিওএ নিয়ে সমাধানের লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশ লম্বা সময় ধরেই ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে বসাতে চাচ্ছিল। তাই বহুল কাক্সিক্ষত সেই বৈঠক ঘিরে তৈরি হয়েছিল বিপুল আগ্রহ। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এনরিক মোরার মধ্যস্থতায় ইরানের প্রতিনিধি আলী বাঘেরি কানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি রব ম্যালির মধ্যকার পরোক্ষ সেই আলোচনা শেষ হয়েছে কোনো অগ্রগতি ছাড়াই। আলোচনা শেষে ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশকেই দেখা গেছে আলোচনার অগ্রগতি না হওয়ার জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করতে।

অন্যদিকে, এ আলোচনার আগেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস রিজার্ভের মালিক ইরানকে দেখা গেছে পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যোগদানের জন্য আবেদন করতে। উল্লেখ্য, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট ব্রিকস পশ্চিমা প্রভাবের বিপরীতে মস্কো-বেইজিং বলয়ের শক্তিশালী উদীয়মান বাজার হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। একদিকে তেহরান-ওয়াশিংটন সমঝোতার কোনো অগ্রগতি না হওয়া, অন্যদিকে ব্রিকসে ইরানের যোগদানের জন্য আবেদন বর্তমানে ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-পশ্চিমা মিত্র ও রাশিয়া-চীনকেন্দ্রিক ক্ষমতার মেরুকরণের যে রাজনীতি চলছে, তাতে বিশেষ কোনো মাত্রা যোগ করে কি না, সেটা পর্যবেক্ষণের বিষয়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর প্রভাবে হামলা চালানোর জন্য ইরানের হাতে রয়ে গেছে বড় একটি অস্ত্র-হরমুজ প্রণালি। জ্বালানি তেলের রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি ইরান বহুদিন থেকেই দিয়ে আসছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে পশ্চিমা দেশগুলো জ্বালানি তেলের জোগান পেতে এখন পুরোপুরি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। পরমাণু চুক্তি সমঝোতা ও ইরানের ব্রিকসে যোগদানের আবেদনকে প্রেক্ষাপট হিসাবে রেখে এমন পরিস্থিতিতে ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকিকে বাস্তবে পরিণত করার সম্ভাবনা কতটুকু তা বিবেচনার বিষয়।

সেই আলোচনায় অবতারণার আগে জ্বালানি তেলের রাজনীতিতে হরমুজ প্রণালি কেন গুরুত্বপূর্ণ তা আলোকপাতের দাবি রাখে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথের নাম হরমুজ প্রণালি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তেল রপ্তানি করা হয় হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে। হরমুজ প্রণালির একদিকে আছে আরব দেশগুলো, অন্যদিকে রয়েছে ইরান। হরমুজ প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অংশ, সেখান থেকে ইরান ও ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। এই সংকীর্ণ অংশের ওপর ইরানের আছে একচ্ছত্র আধিপত্য। সংকীর্ণ হলেও জ্বালানি তেল বহনের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ চলাচল করার জন্য হরমুজ প্রণালি যথেষ্ট গভীর ও চওড়া। পৃথিবীতে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হরমুজ প্রণালি দিয়ে যায়। এ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়। এর ফলে সারা বিশ্বই তেলের দেখা পেতে অনেকাংশে নির্ভর করে হরমুজ প্রণালির ওপর। অন্যদিকে, মালাক্কা প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেল রপ্তানি হয় ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেল এবং সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন ৫৫ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি হয়।

প্রশ্ন আসতে পারে, ইরান নিজের তেল রপ্তানির জন্য হলেও তো হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার কথা নয়, যেখানে হরমুজ প্রণালি ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রধান রুট। এবং ইরানের অর্থনীতির জন্য এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইরানের মোট রপ্তানি আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানি তেল রপ্তানির মাধ্যমে। উত্তর মিলবে ইরানের বছর দুই আগের তেল রপ্তানির নতুন এক রুট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে-ওমানের জাস্ক বন্দরের কাছে ইরান নতুন একটি টার্মিনাল তৈরি করেছে, যা হরমুজ প্রণালির দক্ষিণে অবস্থিত। এ টার্মিনাল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ইরান হরমুজ প্রণালিকে পাশ কাটিয়ে নিজের তেল রপ্তানি করতে সক্ষম হবে বলে ভাবা হচ্ছে। ইরানের সাবেক রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির কাছে এমন সিদ্ধান্ত ছিল কার্যকর নতুন এক কৌশল। হাসান রুহানি সে সময় জানিয়েছিলেন ওই রুট ব্যবহার করে ইরানের দিনে ১০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেল রপ্তানির লক্ষ্যের কথা।

অনেক বছর ধরেই ইরান থেমে থেমে মূলত নিজেদের শত্রু দেশগুলোকে লক্ষ্য করে হলেও আদতে সারা বিশ্বকে হরমুজ প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়ে আসছে। তবে ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করে, তখন থেকে ইরান প্রদত্ত হরমুজ প্রণালি দিয়ে জ্বালানি তেলের পরিবহণ বন্ধ করার হুমকিতে অধিক দৃঢ়তা লক্ষ করা গেছে। উল্লেখ্য, ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধের সম্ভাবনা নিয়ে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের থিংক ট্যাংক মাইকেল নাইটস একবার বলেছিলেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তাহলে তারা নিজেরা নিজেদের গলায় ছুরি বসাবে।

গলায় ছুরি আদতে কার গলায় গাঁথতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিত কিছু বলা না গেলেও ইরান যদি সত্যিই হরমুজ প্রণালি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল পশ্চিমা দেশগুলোকে ইরানের এমন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং রাশিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ভূরাজনৈতিকভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার। কারণ হরমুজ প্রণালিতে সম্ভাব্য এমন অবরোধের মধ্য দিয়ে ইরান কার্যকরভাবে ইউরোপে ইরাক, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল প্রবেশ বন্ধ করে দেবে। ফলে জ্বালানি তেলের রাজনীতিতে রাশিয়ার ইউরোপকে কাবু করার সুযোগ বাড়বে। একই কারণে ইউক্রেনে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দেখা যেতে পারে দুর্বল হয়ে পড়তে। সেক্ষেত্রে কার গলায় মাইকেল নাইটসের ছুরি গাঁথবে সেটি দেখার বিষয়।

আখিউজ্জামান মেনন : প্রাবন্ধিক

 

হরমুজ প্রণালী রাশিয়া ইউক্রেন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম