|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ উপমহাদেশে এক সময় হাতে লেখা খবরের কাগজের প্রচলন ছিল। এ অঞ্চলে আধুনিক গণমাধ্যম হিসেবে ছাপানো সংবাদপত্রের যাত্রা ১৭৮০ সালে সেই ‘হিকির গেজেট’ পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ অঞ্চলে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ মতান্তরে ‘বঙ্গাল গেজেটে’র প্রকাশনা ঘটে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮১৮ সালে। এসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর দেশটির পূর্ব অংশের রাজধানী ঢাকায় এ সময়ে প্রকাশিত কোনো দৈনিক পত্রিকার সন্ধান মেলে না। দেশ বিভাগের আগে থেকে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের প্রথমদিকে সে সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত আজাদ, মর্নিং নিউজ, ইত্তেহাদই এ অঞ্চলের পত্রিকাশূন্যতা পূরণ করেছিল। একপর্যায়ে আজাদ ও মর্নিং নিউজ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে এলো। এরপর পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান ইত্যাদি পত্রিকা গোটা পাকিস্তান আমলে, এমনকি তার পরও (কোনো কোনোটি ভিন্ন নামে যেমন- বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক বাংলা ইত্যাদি) এ দেশের প্রভাবশালী পত্রিকা হিসেবে ভূমিকা পালন অব্যাহত রেখেছিল। সেই আমলের পত্রিকা হিসেবে আজ অব্দি ইত্তেফাক ও সংবাদ তাদের প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান বাংলাদেশে বহুল প্রচারিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথম আলো (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৯৮), যুগান্তর (১৯৯৯), বাংলাদেশ প্রতিদিন (২০১০), কালের কণ্ঠ (২০০৮), আমাদের সময় (২০০৩), দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৫৩), সমকাল (২০০৫), দৈনিক ইনকিলাব (১৯৮৭), দৈনিক জনকণ্ঠ (১৯৯৩), নয়াদিগন্ত (২০০৪), দ্য ডেইলি স্টার (১৯৯১), দি ইনডিপেনডেন্ট (১৯৯৪), দ্য নিউ এজ (২০০৩), মানবজমিন (১৯৯৭) ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রাচীন পত্রিকা সংবাদ (১৯৫১), দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসসহ (১৯৯৩) বাজারে দ্য নিউ ন্যাশন, দি অবজারভার ইত্যাদি বেশকিছু পত্রিকাও চালু রয়েছে। ২০১৮ সালের হিসাবমতে দেশে বর্তমানে ১,২০০টি দৈনিক (ঢাকা থেকে ৪৭৬টি), ১,১৭৯টি সাপ্তাহিকসহ (ঢাকা থেকে ৩৪৭টি) মাসিক, দ্বিমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক সব মিলিয়ে ৩,০৪১টি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রিন্ট মিডিয়া হিসেবে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার সেই আগের চেহারা আর নেই। অবয়ব, ছাপার সৌকর্য, কনটেন্টের ভিন্নতা, পাঠক রুচি এ সবকিছু মাথায় রেখে আজ পত্রিকার পরতে পরতে পরিবর্তনের ছাপ। সেখানে টেকনোলজির অনুপ্রবেশ ও অভিঘাত আজ সুস্পষ্ট। পুরনো ট্রেডিশন ভেঙে ছাপা পত্রিকার চেয়ে অনলাইন সংস্করণ আজ বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন উঠছে, ভবিষ্যতে কাগজের প্রিন্ট মিডিয়া সাংবাদিকতা আদৌ থাকবে কিনা? দেশে বর্তমানে অনলাইন পত্রিকার ছড়াছড়ি। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রথম অনলাইন পত্রিকা bdnews24.com আজও শীর্ষ অনলাইন পত্রিকা হিসেবে তার প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে দেশে ১,৮০০-এর বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। বেসরকারি হিসাবমতে, এ সংখ্যা কয়েক হাজার।
পত্রিকার পাশাপাশি পাকিস্তান সৃষ্টির আগে (১৯৩৯ সাল) থেকেই সরকারি মালিকানায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রেডিও সম্প্রচার চালু ছিল। পাকিস্তান আমলে তা রেডিও পাকিস্তান ঢাকা নামে অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সরকার কর্তৃক অধিগৃহীত হয়ে তা বাংলাদেশ বেতার নামে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তা রেডিও বাংলাদেশ এবং ১৯৯৬ সাল থেকে আবারও বাংলাদেশ বেতার নামে পরিচিতি পায়। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে রেডিও মেট্রো নামে প্রথম প্রাইভেট রেডিও সম্প্রচার শুরু হয়, তবে ৪-৫ বছরের মধ্যেই এটি বন্ধ হয়ে যায়। মূলত ২০০৬ সাল থেকে প্রাইভেট সেক্টরে বেতার সম্প্রচারের প্রসার ঘটে। বর্তমানে দেশে সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ বেতার ছাড়াও ২৮টি প্রাইভেট এফএম স্টেশন (সম্প্রচারে আছে ২২টি), ৩২টি কমিউনিটি (সম্প্রচারে আছে ১৭টি) রেডিও এবং বেশকিছু অনলাইন রেডিও রয়েছে। এফএম রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা কিংবা এর সম্প্রচার আজ খুবই অল্প পরিসরে পরিচালনা করা সম্ভব। বেতার প্রযুক্তিও আজকাল বহুলাংশে আইসিটিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অবয়ব, সম্প্রচার ও প্রযুক্তির দিক থেকে আশির দশক পর্যন্ত বেতার সম্প্রচার ব্যবস্থার যে চেহারা ছিল তা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচারের শুরু পাকিস্তান আমলে- ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। সরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত এই সম্প্রচার ব্যবস্থা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশন নামে তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে ব্যক্তি মালিকানায় প্রথম এটিএন টেলিভিশন চ্যানেলকে অনুমতি দেয়। বর্তমানে দেশে বেসরকারি মালিকানায় অন্তত ৪৪টি টিভি চ্যানেলকে সম্প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সম্প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ২৮টি। বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের স্যাটেলাইন যুগ শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে। সম্প্রতি বাংলাদেশের নিজস্ব বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সম্প্রচার ও প্রযুক্তি উৎকর্ষে আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। মানুষ এখন টেলিভিশনও দেখছে অনলাইনে।
১৯৯০ সালে বিশ্বব্যবস্থায় ভাঙন ধরার পর দুনিয়াজুড়ে একধরনের উদার যুগ (liberalized era) শুরু হয় এবং তা অব্যাহত রয়েছে। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুর মতো গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও মূলত তখন থেকেই একধরনের দ্রুত পরিবর্তনশীলতা শুরু হয়েছে। গণমাধ্যমসহ সর্বত্র এই পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বর্তমান শতাব্দীতে এসে সাংবাদিকতাও আজ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে যুগপৎ দুটি বিষয়ের পারস্পরিক সংশ্লেষের কারণে। প্রথমটি হচ্ছে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (যার উদ্ভব ঘটেছে আবার প্রথমটি থেকে)। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেক্টরেও এই পরিস্থিতির প্রতিফলন দৃশ্যমান। পুঁজি ও প্রযুক্তির ছায়া সেখানে বেশ গাঢ়।
একদিকে বাজার অন্যদিকে প্রযুক্তি, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন কোনো গণমাধ্যমই তাদের সেই ট্রেডিশনাল/ফাংশনাল অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারছে না বলে আমাদের মধ্যে একধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন SEA-ME-WE 4-এর মাধ্যমে ইনফর্মেশন সুপার হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত। এ দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ৮ লাখ। ১৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষের হাতে এখন মোবাইল সিম রয়েছে। তারা আজ ফোর জেনারেশন মোবাইলও ব্যবহার করছেন। ২০০৮ সালে ঘোষিত বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর আলোকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন অনুভবযোগ্য এবং দৃশ্যমানও বটে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সর্বশেষ ব্রান্ডের আইফোন সবকিছু এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। দেশের দেড় কোটির বেশি মানুষ যারা বিদেশে থাকেন, তাদের তিন ভাগের দুই ভাগ কিংবা তারও বেশি বাংলাদেশি অনলাইন গণমাধ্যমের পাঠক-শ্রোতা। এভাবে বাংলাদেশ আজ গ্লোবাল মিডিয়াস্কেপের সঙ্গে সম্পর্কিত ও অঙ্গীভূত।
অনলাইন ছাড়াও নিউ মিডিয়া যেমন- ব্লগ, ফেসবুকসহ নানা ধরনের প্রযুক্তি ও কৃৎকৌশলগত (technological and technical) ওয়েবসাইট, সমকেন্দ্রাভিমুখ (convergence) মিডিয়া ও তার দর্শন, মিডিয়ার মালিকানা, মিডিয়ার পরিচালনা, মিডিয়ার ব্যবহার সবকিছুই যেন গণমাধ্যম জগৎকে এ সময়ে এলোমেলো করে দিচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে এসব মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে এ প্রশ্ন আজ আমাদের সবার সামনে। ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (INMA) প্রধান নির্বাহী গত বছর তার ঢাকা সফরকালে এ সম্পর্কে প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (২৯.০১.২০১৭) বলেছেন- ‘ভবিষ্যতে কোনো সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টিভি চ্যানেল থাকবে না। সবই হয়ে যাবে নিউজ কোম্পানি। টিভি চ্যানেলগুলোও এখন সে পথেই হাঁটছে, তাদের ওয়েবসাইট আছে। তাদের কেউ কেউ হয়তো মুদ্রণ শিল্পেও প্রত্যাবর্তন করতে পারে। সংবাদপত্রগুলো এখন বেশি করে ভিডিও সংশ্লিষ্ট হতে চলেছে। তারা আরও বেশি করে পডকাস্টের দিকে ঝুঁকছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আপনারা এফএম রেডিওর শেষ আর ডিজিটাল রেডিওর উত্থান দেখতে চলেছেন।’ এ ধারণা এক সময় হয়তো সত্য হবে। আর তেমনটি হলে গণমাধ্যম তখন আর প্রতিষ্ঠান থাকবে না। এগুলো হয়ে যাবে ওইসব নিউজ কোম্পানির একেকটি প্লাটফর্ম। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম তখন আরও নিবিড়, এককথায় একাকার হয়ে যাবে।
সম্প্রতি দেশের একটি দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম ছিল : ‘সাংবাদিক ছাড়াই সংবাদ’। খবরটিতে বলা হয়েছে, জাপানের টোকিওতে ২০০৮ সালে সংবাদ-প্রযুক্তিভিত্তিক একটি ব্যবসা-উদ্যোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম জেএক্স প্রেস কর্পোরেশন। জাপানি এক তরুণ উদ্যোক্তা কাতসুহিরো ইয়োনেশি এটির প্রতিষ্ঠাতা। এ প্রতিষ্ঠানের বার্তাকক্ষে এখন কোনো প্রতিবেদক বা সংবাদদাতা নেই। সেখানে সংবাদ লেখা হয় প্রযুক্তির সাহায্যে।
২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মালয়েশিয়ার এক বিমানবন্দরে উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উনের সৎভাই কিম জং-নামকে হত্যা করা হয়। মার্কিন সরকার বলেছিল, এটি গুপ্তহত্যা। সেদিন জাপানের বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর চেয়েও প্রায় আধা ঘণ্টা আগে জেএক্স প্রেস এ হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি প্রচার করেছিল। কাতসুহিরো ইয়োনেশি মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ভর করে মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে ‘নিউজ ডাইজেস্ট’ নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করেন, যা ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর পোস্ট বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় তথ্য বাছাই করতে এবং তা দ্রুত সংবাদ আকারে লিখেও ফেলতে পারে। তবে এভাবে তৈরি সংবাদে ভুল থাকার আশঙ্কাও আছে। আর সে ভুলগুলো ক্ষতিয়ে দেখেন বিভাগীয় সম্পাদকরা। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান ২৪ জন তরুণ কর্মী নিয়ে চলছে। তাদের দুই-তৃতীয়াংশই প্রকৌশলী, বাকিরা সংবাদ বিপণন কর্মকর্তা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে নির্দিষ্ট অর্থের মাধ্যমে তারা সংবাদ কেনে এবং অ্যাপ নিউজ ডাইজেস্টের মাধ্যমে তা প্রচার করে। জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি জাপানে ভালোই চলছে। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম যখন এভাবে নিবিড় ও একাকার হয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের পক্ষে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কী তা বলা সত্যিই কঠিন।
ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
skasalam@gmail.com
