বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
যুক্তফ্রন্টের প্রথম সিদ্ধান্ত ও প্রথম সাফল্য
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রথম ‘একাডেমি’ কথাটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটি একাডেমি (পরিষদ) গড়তে হবে, যার কর্তব্য হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলির অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ। এজন্য এক পরিভাষা-সমিতির প্রয়োজন আছে।’
একাডেমি পরিকল্পনায় হয়তো তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল ফ্রান্সের আকাদেমি ফ্রঁজেস, যেটি ১৬৩৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রেড কার্ডিন্যাল কর্তৃক নির্মিত হলেও ফরাসি বিপ্লবের পর ভাষার বিকাশে বিশেষভাবে সংরক্ষিত হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্যারিসবাসের সময় ভাষা প্রতিষ্ঠানটির সংস্পর্শে এসেছিলেন ১৯২৬-১৯২৮ সালে। এর বিশ বছর পর দেশে এরকম একটি একাডেমি গড়ার প্রস্তাব দিলেন। হয়তো ভাষা আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে।
স্মরণীয়, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বাংলা ভাষাকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ও শিক্ষার ভাষা এবং উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। সরকার ১৯৪৮ সালের ৮ এপ্রিল পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করলেও তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি ভাষা বিকাশের প্রধান বাহন একটি একাডেমি।
একাডেমি প্রতিষ্ঠার আবেদন জানান তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎকালীন পূর্ববঙ্গ সরকারের কাছে। এমন সময়ে একাডেমি গড়ার এ প্রস্তাব করেন, যখন দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছিল; যখন পূর্ব বাংলায় শুরু হয়ে গেছে উদ্বাস্তু সমস্যার কাল (১৯৪৮-১৯৫২)। পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যায় ৩৩ লাখ মানুষ, এদেশে আসে ১০ লাখ মানুষ। দেশান্তরী হয়ে চলে যায় বাংলাভাষীরা, তার বিনিময়ে আসে উর্দুভাষীরা। ঢাকার অফিস আদালতে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষার প্রচলন শুরু হয়।
ব্রিটিশ আমলে টাকা-পয়সা, পোস্ট কার্ড, মানি অর্ডার ফরমে বাংলা লেখার প্রচলন ছিল। দেশ ভাগের পর উর্দুর প্রকোপ বেড়ে যায়। বিহারি কিংবা অবিহারি নির্বিশেষে সব উর্দুভাষী; এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত বাংলা ভাষাকে হেয় জ্ঞান করতে থাকেন। বাংলা ভাষা নিজ দেশে হয়ে যায় পরবাসী।
১৯৪৮ সালে ড. শহীদুল্লাহ্ একাডেমি প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব বঙ্গ মুসলিম লীগ সরকারের কাছে। ১৯৫২ সালে এ দাবি উপস্থাপিত হয় মুসলিম লীগ সরকারের পরিবর্তে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কাছে। কারণ, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয়েছে পূর্ব বাংলার শিক্ষা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে সময় শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলাকে মাধ্যম করার পরিকল্পনাও করেছিল।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলা একাডেমি স্থাপনের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বলে মনে করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২১-২২ জুন অনুষ্ঠিত সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্ট বাংলা একাডেমি চালু করার সুপারিশ করে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের কাছে। ভাষাসংগ্রামী আবুল কাসেম ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট মেম্বার হিসাবে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রাখেন। তারই অংশ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৫৩ সালের ১০ অক্টোবর ড. শহীদুল্লাহ্ সম্পূরক প্রস্তাব পেশ করে বলেন, ‘ইহার জন্য প্রথম প্রয়োজন সুন্দর পরিবেশের মধ্যে আধুনিকভাবে সজ্জিত একটি প্রশস্ত দ্বিতল গৃহ। তাহার সংলগ্ন পুস্তকালয়ে বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলি, বিশেষত বাংলাভাষায় মুসলমান রচিত, মুদ্রিত ও অমুদ্রিত সমস্ত বই ও পুথি থাকিবে। তাহাতে পকিস্তান এবং ইসলামের ধর্ম্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় আরবী, ফারসী, উর্দ্দু, হিন্দী, ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান, ডচ, স্পেনিশ এবং রুশ ভাষায় লিখিত পুস্তক এবং সাহিত্যিক পত্রিকাগুলি রক্ষিত হইবে। ইহার একটি অনুবাদ বিভাগ থাকিবে। তাহা হইতে বিভিন্ন ভাষার অনুবাদ এবং মুসলমান রচিত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সংস্করণ প্রকাশিত হইবে।’ দ্বিতল গৃহের প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন এস্টুটিটিউট দ্য ফঁসের স্থাপত্য থেকে। কেননা, ফ্রান্সের এ ভবনটির সঙ্গে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু বর্ধমান হাউজের মিল ছিল গথিক স্থাপত্যের কারণে; তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন ছিল যেখানে।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার এ ফ্রন্টের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মারকরূপে ২১ দফার সমাহার ঘটানো হয়। এর মধ্যে একটি দফা ছিল বাংলা একাডেমি স্থাপন। ষোড়শ দফায় বলা হয়-‘যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউজের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউজকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।’ ১৯৫৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের পর ২ এপ্রিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং আশরাফ উদ্দীন চৌধুরীকে নিয়ে। স্পিকার নির্বাচিত হন কৃষক শ্রমিক পার্টির আবদুল হাকিম, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের শাহেদ আলী। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়াকে। ৫ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি মোহম্মদ বরকতুল্লাহ্কে ডেকে বর্ধমান হাউজকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার নির্দেশ দেন। ফজলুল হক মন্ত্রিসভার এটিই ছিল প্রথম সিদ্ধান্ত।
শুরু হয় সিদ্ধান্তকে সাফল্যমণ্ডিত করার পালা। এপ্রিলেই যুক্তফ্রন্ট সরকার একাডেমি প্রতিষ্ঠায় সহায়তার জন্য বিশেষজ্ঞ ও পণ্ডিতদের নিয়ে যে কমিটি গঠন করেন, তাতে সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন ড. শহীদুল্লাহ্। ১৫ মে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান ও শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ক ধারার বিধান অনুসারে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে খারিজ করে। কলকাতায় পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি করেছেন-এ অজুহাতে ফজলুল হককে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করা হয়। স্মরণীয়, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখে হরফ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানোয় ১৯৪৯ সালে ড. শহীদুল্লাহ্কেও দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
যুক্তফ্রন্ট সরকার বরখাস্ত হলে একাডেমি প্রতিষ্ঠা স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু তার দাবি নিয়ে আবার আবির্ভূত হন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। দিনাজপুরের নওরোজ সাহিত্য সম্মেলনে ১৯৫৫ সালের ১৭ এপ্রিল সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে একাডেমির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন-‘...একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য-সমিতি অবশ্যই চাই, যার শাখা প্রত্যেক জেলায় থাকবে। এই কেন্দ্রীয় সাহিত্য-সমিতির একটি স্থায়ী কার্যালয় এবং একটি মুখপত্র থাকবে। মোট কথা, কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতো আমাদের এই কেন্দ্রীয় সাহিত্য-সমিতি হওয়া চাই।’
গভর্নর শাসন প্রত্যাহারের পর যুক্তফ্রন্ট সরকারের হাতে শাসনভার প্রত্যর্পণ করা হয়। ১৯৫৫ সালের জুন মাস থেকে ১৯৫৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় সরকার পরিচালনা করেন কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন মন্ত্রিসভা। নবনির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকার ২৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আয়োজক সমিতি গঠন করে। আয়োজক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন ড. কুদরত ই খোদা, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. এনামুল হক, খান বাহাদুর আবদুর রহমান। প্রথমে জনাব জহিরুল ইসলাম ও পরে অবসরপ্রাপ্ত মোহম্মদ বরকতুল্লাহ্কে একাডেমির স্পেশাল অফিসার নিযুক্ত করা হয়। বরকতুল্লাহ্ ১৯৪৮-১৯৫১ সালে ছিলেন ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক। পূর্ববঙ্গ সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর স্পেশাল অফিসার হিসাবে প্রথম দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫৫-১৯৫৭ সালে।
১৯৫৫ সালের ২ ডিসেম্বর নিয়োগ লাভের পর বরকতুল্লাহ্ ৮ ডিসেম্বর থেকে বর্ধমান হাউজের প্রধান ভবনের এক তলায় পূর্ব দিকের তিনটি কক্ষে কার্যালয় খুলে বসেন। দুটি কক্ষ ছোট, অন্যটি কাঠের মেঝের বৃহৎ কক্ষ-যেটি পূর্বে বলরুম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। বলরুমেই স্থাপিত হয় পাঠাগার। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল কক্ষগুলো ছেড়ে গেলে বাংলা একাডেমি এগুলো দখল করে। ওই সময় গোটা বর্ধমান হাউজ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ভর্তি ছিল। কয়েক মাস চেষ্টার পর নিচতলা খালি করে স্থাপন করা হয় অফিস, পাঠাগার ও লাইব্রেরি।
মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫ বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায় বাংলা একাডেমি উদ্বোধন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শের-এ-বাংলা একে ফজলুল হক, শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আজিজুল হক। উদ্বোধনের সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আবু হোসেন সরকার, শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী। ফরাসি বিপ্লবের চেতনা নিয়ে জন্ম হয় আকাদেমি ফ্রঁজসের, ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে জন্ম নিল বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি যুক্তফ্রন্ট সরকারের শুধু প্রথম সিদ্ধান্ত ও সার্থক সাফল্য নয়; সম্ভবত শ্রেষ্ঠ সাফল্য হিসাবে কীর্তিত হবে অনন্তকাল।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, ঢাকা
mahmoodnasirjahangiri@gmail.com
