Logo
Logo
×

বাতায়ন

মানুষ অভ্যাসের দাস

Icon

ড. কাজী ছাইদুল হালিম

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৮, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘মানুষ অভ্যাসের দাস’- এ প্রবাদবাক্যটি আমরা কমবেশি সবাই শুনেছি। অভ্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Charles Duhigg তার ‘The Power of Habit’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অভ্যাস হল এমন একটি পছন্দ যা আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু সময়ের জন্য করি এবং তারপর সে পছন্দ সম্পর্কে চিন্তা করা বন্ধ করে দিই, কিন্তু সে পছন্দটা চালিয়ে যাই অবিরত।’ আমরা অভ্যাসকে দুই ভাগে ভাগ করে থাকি যেমন ভালো অভ্যাস ও খারাপ অভ্যাস। উদাহরণস্বরূপ- সততা, সকাল সকাল ঘুমোতে যাওয়া এবং খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং বড়দের সম্মান করা ভালো অভ্যাস। অন্যদিকে ধূমপান, মদ্যপান, মাদক গ্রহণ, মিথ্যা কথা বলা, অধিক খাদ্য গ্রহণ, উৎকোচ গ্রহণ, প্রয়োজনের অধিক দ্রব ক্রয় এবং হিংসা খারাপ অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।

আমাদের জীবন আসলে অভ্যাসের একটা বড় বান্ডিল ছাড়া আর কিছুই নয়। শত শত অভ্যাস আমাদের দিনকে প্রভাবিত করে। তারা আমাদের গাইড করে- আমরা কিভাবে সকালে পোশাক পরি, কিভাবে আমাদের সন্তানদের সঙ্গে কথা বলি এবং কিভাবে বা কখন রাতে ঘুমাতে যাই; তারা প্রভাবিত করে আমরা দুপুরের খাবারে কী খাই, আমরা কিভাবে ব্যবসা করি এবং কর্মদিবস শেষে ব্যায়াম করি নাকি টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখি। এখানে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, মানুষ কেন তাহলে একটা ভালো অভ্যাসের পরিবর্তে একটা খারাপ অভ্যাস গ্রহণ করে?

এক্ষেত্রে আমরা একটা প্রবাদবাক্যের উদাহরণ টানতে পারি, যা হল ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’। হ্যাঁ, মানুষ তার অভ্যাসের একটা বড় অংশ গ্রহণ করে তার আশপাশ বা প্রতিবেশ থেকে- যার মধ্যে পড়ে পরিবার, আবাস এলাকা, স্কুল, কর্মক্ষেত্র, বন্ধু সমাজ এবং যে দেশে বসবাস। জীবন পরিক্রমার বিভিন্ন স্তরে মানুষের বিচরণের ক্ষেত্রে আসে পরিবর্তন। এভাবে জন্মের পর আমরা প্রথমেই পাই পরিবার। পরিবারকে সাধারণত মানুষের জীবনের প্রথম স্কুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এভাবে একজন মানুষের অভ্যাস গঠনের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা থাকে বলিষ্ঠ। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যদি কোনো পরিবার নিয়মিত সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে রাতের খাবার খায়, তাহলে সন্তানরা দক্ষতার সঙ্গে স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ করতে পারে, স্কুলে ফলাফল ভালো করে, সন্তানদের মানসিক নিয়ন্ত্রণ হয় এবং তাদের আত্মবিশ্বাসও হয় অনেক বেশি।

এক সময় পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে একটা শিশু স্কুল জীবনে পদার্পণ করে। আর এই স্কুলও অভ্যাস গঠনের একটা প্রধান প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল অভ্যাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই স্কুল ও পরিবারের পারস্পরিক সহযোগিতা শিশুদের সুষমভাবে বেড়ে ওঠা এবং ভালো অভ্যাস গঠনে সহায়ক হতে পারে। মাধ্যমিক স্কুলের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে পদার্পণের পর একজন ছাত্র শৈশব থেকে কিশোর বয়সে পদার্পণ করে। আর এটা একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে জটিল সময়, কারণ কিশোর বয়সে একজন মানুষ খুব বেশি অনুকরণপ্রিয় হয়। আর তাই কিশোর বয়সে একজন সন্তান কার সঙ্গে মেলামেশা করছে এবং অবসর সময়ে সে কী করছে তার ওপর নজর দেয়া বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ আর কিশোর (১৪ বছর থেকে ১৭ বছর) বয়সে এই প্রবাদটার প্রতিফলন আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি।

কিশোর বয়সের শুরুতে জীবনের সঙ্গে যৌবনের প্রথম মিলন ঘটে। এ সময় হরমোনের উৎপাদন থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আর এ বয়সে সন্তানরা বিভিন্ন বিষয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তারা একটু বেশি মুক্ত হতে চায় আর অনেক নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিশোরদের কাছে সবকিছু অনেক বড়, অনন্য এবং অবাক করার মতো লাগে, কারণ জীবনে প্রথম তারা এগুলোর সম্মুখীন হয়। অনেক সময় অভিভাবকরা একা তাদের কিশোর সন্তানদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। এভাবে অনেক কিশোর বিপথে পা দেয়। আজ আমাদের দেশে যে ৫০ থেকে ৭০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মাদকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে থাকতে পারে এই কিশোর বয়সে। ফিনল্যান্ডে প্রতিটি পৌরসভায় অনেক তরুণকেন্দ্র বা Nuoriso Talo আছে, যেখানে এক বা একাধিক পরিচালকের অধীনে তরুণরা অবসর সময়ে নিয়মিত বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফিনল্যান্ডের এই তরুণকেন্দ্র বা Nuoriso Talo মডেল বাংলাদেশে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে আমাদের তরুণ ও কিশোরদের ব্যস্ত রাখার জন্য, যাতে তারা বিপথে পা না বাড়ায়।

একজন মানুষের জীবনে অভ্যাসের গঠন সব সময় চলতে থাকে; তবে শৈশব আর কিশোর বয়সে এর গঠন হয় সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে শৈশব আর কিশোর বয়সের অভ্যাসগুলো জীবনের পরবর্তী ধাপগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কর্মজীবনে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। আবার কর্মজীবন মানুষকে নতুন অভ্যাস গঠনে সাহায্য বা বাধ্য করে, যেমন উৎকোচ গ্রহণ। আমাদের দেশে সরকারি বিভিন্ন দফতরে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে সেবা প্রদানকারীর উৎকোচ গ্রহণ বলতে গেলে একটা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই উৎকোচ গ্রহণ একটা খারাপ অভ্যাস এবং মাদক গ্রহণের চেয়ে কোনোভাবেই কম নয়।

ব্যক্তির মধ্যে কিভাবে অভ্যাস গঠিত হয়? অভ্যাস গঠন প্রক্রিয়া একটা সূত্রের মতো, যা আমাদের মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে। সূত্রটা হচ্ছে এমন : যখন আমরা কোনো একটা কিছুর জন্য ইঙ্গিত পাই বা অভাববোধ করি, তখন আমরা একটা কার্যপ্রণালী অনুসরণ করি, যাতে কোনো একটি পুরস্কার বা প্রশান্তি পাই। এখন আসি ব্যায়াম করার অভ্যাস প্রসঙ্গে। ব্যায়াম করলে সাধারণত শরীরের মধ্যে প্রচুর এন্ডরফিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা আমাদের মধ্যে প্রশান্তি বা সুখানুভূতির উদ্রেক করে। ধরি একজন ব্যক্তি কয়েকদিন কর্মদিবসের পরে ব্যায়াম করল। এই ব্যায়াম করা তখন তার একটা অভ্যাসে পরিণত হবে, যখন সে ব্যায়াম থেকে নিয়মিত প্রশান্তি পাওয়া শুরু করবে এবং ব্যায়ামের অভাব তাকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। পরবর্তী সময়ে ব্যায়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তির অভ্যাস এভাবে কাজ করবে : প্রতিদিন কর্মদিবসের পর ব্যায়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তির মস্তিষ্ক ব্যায়াম করার জন্য ইঙ্গিত দিবে, তখন ব্যায়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তি ব্যায়াম (কার্যপ্রণালী) করবে এবং ব্যায়াম থেকে সে একটা প্রশান্তি পাবে। এভাবে ব্যায়াম একজন ব্যক্তির নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম করা একটা ভালো অভ্যাস, যা আমাদের রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

ভালো অভ্যাসের মতো খারাপ অভ্যাসের গঠন প্রক্রিয়াও একই। ধরি একজন ব্যক্তি কৌতূহলবশত কয়েকদিন ধূমপান করল। ধূমপান তখন তার অভ্যাসে পরিণত হবে, যখন সে ধূমপান থেকে নিয়মিত একটা প্রশান্তি পাওয়া শুরু করবে এবং ধূমপানের অভাব তাকে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে। পরবর্তীকালে ধূমপায়ীর অভ্যাস এভাবে কাজ করবে- ১. একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ধূমপায়ীর মস্তিষ্ক ধূমপানের জন্য ইঙ্গিত দেবে, ২. তখন ধূমপায়ী ধূমপান (কার্যপ্রণালী) করবে এবং ৩. ধূমপান থেকে সে একটা প্রশান্তি পাবে। ব্যায়াম করা যেমন একটা ভালো অভ্যাস, তেমনি ধূমপান একটা খারাপ অভ্যাস। ভালো অভ্যাস সব সময়ই ভালো, যা গঠনে আমরা অন্যদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। সমস্যা হল খারাপ অভ্যাস নিয়ে। একটা খারাপ অভ্যাস ব্যক্তির নিজের জন্য যেমন খারাপ, তেমনি পরিবার ও সমাজের অন্যদের জন্যও খারাপ।

খারাপ অভ্যাস, যেমন ধরুন ধূমপান, কি বন্ধ করা সম্ভব? এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়ার আগে আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন। একটা অভ্যাস যত দীর্ঘ সময়ের হবে, সেটা বন্ধ করাও হবে তত কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যদিকে ছোটবেলায় গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলো পরিত্যাগ করা খুবই কঠিন। তবে হ্যাঁ, ধূমপান বন্ধ করা সম্ভব আর এজন্য প্রথমেই যা করতে হবে তা হল, ধূমপায়ীকে ধূমপান বন্ধ করার জন্য মনস্থির করতে হবে। এরপর যখনই ধূমপায়ীর মস্তিষ্ক ধূমপানের জন্য ইঙ্গিত দেবে তখন ধূমপান না করে বিকল্প কিছু একটা করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন- ব্যায়াম করা বা বই পড়া বা অন্য কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। এভাবে আস্তে আস্তে একদিন দেখবেন আপনি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। ধূমপানের মতো যে কোনো খারাপ অভ্যাস বিকল্প কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে পরিত্যাগ করা সম্ভব। এভাবে খারাপ অভ্যাস পরিত্যাগের মাধ্যমে আমাদের সবার জীবন ভালো অভ্যাসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

ড. কাজী ছাইদুল হালিম : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং ফিনল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি

shaidul.kayi@tamk.fi

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম