মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান
মেজর মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ভূঁঞা
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে বিংশশতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জয়লাভ করা একটি বিরল ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা এবং সর্বোপরি তার ব্যক্তিত্ব এই সামরিক নেতৃত্বকে যুদ্ধ জয়ে উজ্জীবিত করেছে। এ যুদ্ধের সার্বিক সাফল্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ জনগণের; কারণ যুদ্ধ পরিচালনায় সাধারণ মানুষের সার্বিক সহযোগিতা ছিল সাফল্যের অন্যতম অনুঘটক। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর অবদানকে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা খুবই দুরূহ কাজ। প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে তা সামরিক যুদ্ধ কৌশলের মাপকাঠিতে অনন্য। আধুনিক যুদ্ধ বিদ্যার অন্যতম সমর কৌশল এই গেরিলা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের মার্চে টালমাটাল রাজনৈতিক অস্থিরতার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বাস্তবায়ন এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। একইসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনের সশস্ত্র লড়াই শুরু করার নির্দেশ আসে ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় (২৬ মার্চ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্দি হওয়ার প্রাক্কালে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বিভিন্ন বাঙালি ইউনিট, ইউনিটে অবস্থানরত ও ছুটিতে অবস্থানকালীন সদস্যরা, অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্যরা পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধে অবতীর্ণ হন। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকটি ইউনিট এবং ইপিআর সদস্যরা সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই প্রাথমিক প্রতিরোধকে একটি সশস্ত্র সাংগঠনিক কাঠামোতে রূপ দেওয়ার প্রথম দৃশ্যমান সামরিক পদক্ষেপ ‘১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিলের তেলিয়াপাড়া সম্মেলন’। তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ডাকবাংলোয় অনুষ্ঠিত সমন্বিত বৈঠকে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন ও মুক্তিযুদ্ধকে একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় আনার জন্য বাঙালি অফিসারদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এ আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের আগ পর্যন্ত ১ম ও ২য় তেলিয়াপাড়া (৪ ও ১০ এপ্রিল ১৯৭১) সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলোর ভিত্তিতে সমগ্র বাংলাদেশে প্রাথমিক প্রতিরোধ চলতে থাকে। সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি (পরে ৬টি) সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সামরিক অফিসারদের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ চলতে থাকে। অসামরিক যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, যুদ্ধের কৌশল, মৌলিক যুদ্ধ প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়ে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদেরও দ্রুততার সঙ্গে সংগঠিত করার মাধ্যমে ‘যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী’র একটি প্রাথমিক কাঠামো তৈরি হয়।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ আগরতলায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর ১২ এপ্রিল কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ প্রদান করা হয় এবং কলকাতায় বাংলাদেশ ফোর্সেসের সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং কর্নেল ওসমানী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। এ অস্থায়ী সরকারের অধীনে কর্নেল ওসমানী ৮নং থিয়েটার রোডের অস্থায়ী সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন।
১২ জুলাই ১৯৭১ থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করার আগ পর্যন্ত অঞ্চলভিত্তিক সামরিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই যুদ্ধ চলতে থাকে। ১১টি সেক্টরের সামরিক কমান্ডারদের আওতায় অন্যান্য গেরিলা বাহিনীগুলো জুলাই ১৯৭১ থেকে আরও তীব্রবেগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হওয়ার আগ পর্যন্ত সব আদেশ- নির্দেশনা কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ফোর্সেসের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পেশাদারত্ব, নৈতিকতা, দৃঢ় মনোবল ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সারা বিশ্বে এক অন্যান্য উদাহরণ।
মেজর মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ভূঁঞা, এইসি : সেনা কর্মকর্তা
