|
ফলো করুন |
|
|---|---|
করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্রশিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সে সময়ে। মহামারির প্রকোপ এখন অনেক কমে গেছে, কিন্তু করোনা দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে এ কথা বলা যাবে না।
এখনো করোনায় মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। করোনার বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও প্রত্যাহার করা হয়নি।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনা মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে জনজীবনে। করোনার ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি সামাল দেওয়ার আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত হয়েছে সারা বিশ্ব।
বৈশ্বিক অর্থনীতি স্থবির হয়েছে, কম-বেশি সংকটে পড়েছে প্রায় প্রতিটি দেশ। বাংলাদেশও বাদ যায়নি। সংকট মোকাবিলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারি শুরুর পরপরই সংবাদপত্রশিল্প বড় রকমের ধাক্কা খায়। সবকটি দৈনিক পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়। কোনো কোনো দৈনিকের প্রচার সংখ্যা অর্ধেকে বা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে।
শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দার কারণে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনও কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। আয় কমে যাওয়ায় বহু পত্রিকা অস্তিত্বের সংকটে পড়ে, সংকটে ভুক্তভোগী হয় সাংবাদিক ও কর্মচারীরা। পরবর্তীকালে করোনা মহামারি থেকে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করে সংবাদপত্রশিল্প এবং অধিকাংশ পত্রিকাই আগের অবস্থানে ফিরে আসতে থাকে। ঠিক এ সময়ে শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত থাকলেও এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয় বিশ্বব্যাপী। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বৈশ্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেনি। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেও যুদ্ধের প্রভাব পড়ে। সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
ডলার সংকটের ফলে আমদানির পরিমাণ কমে যায়। এ পরিস্থিতির শিকার হয় সংবাদপত্রশিল্পও। আমদানি করা সব ধরনের কাগজের দাম বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে সমানতালে বাড়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজের দাম। মুদ্রণশিল্পে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যের দামও বেড়ে যায়।
সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কাগজ চালানো হয়ে যায় ব্যয়বহুল। কয়েক মাস আগে সংবাদপত্র মালিকরা পত্রিকার দাম কিছুটা বাড়িয়েছেন। তাতে কিছুটা আয় বেড়েছে; যা সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে সহায়ক ছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন মুদ্রণসামগ্রীর মূল্য আরও বেড়েছে। সংবাদপত্রশিল্পের সংকট রয়েই গেছে।
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন, ‘নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (নোয়াব) সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন যাতে সংবাদপত্রের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়। সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে এসব দাবি বিবেচনা ও পূরণ করা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। রাষ্ট্র ও জাতির স্বার্থে সংবাদপত্রশিল্পকে ভালোভাবে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বোঝেন, কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংবাদপত্রবিহীন একটি রাষ্ট্রের কথা কি কল্পনা করা যায়? সরকার, প্রশাসন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন সংবাদপত্র বাদ দিয়ে চলতে পারবে কি? ডিজিটাল বা অনলাইন কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে সংবাদপত্রের অভাব পূরণ করা যাবে না।
সংবাদপত্র যে জনজীবনে কতটা অপরিহার্য তা অনুভব করা যায় যখন সংবাদপত্রে ছুটি থাকে এবং পত্রিকা প্রকাশনা তিন/চার দিন একটানা বন্ধ থাকে, তখন পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন কখন পত্রিকা আবার প্রকাশিত হবে। কোনো কোনো পত্রিকা ছুটির সময়ে অনলাইন সংস্করণ চালু রাখে, কিন্তু তাতে মুদ্রিত পত্রিকার অভাব পূরণ হয় না। অনলাইন সংস্করণ পড়ার সুযোগও সবাই পান না।
টেলিভিশনের মতো ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে খবর জানা যায়, কিন্তু তা বিস্তারিত খবর বা খবরের পেছনের খবর দিতে পারে না, তদুপরি টিভির খবর একবার প্রচারিত হওয়ার পর দর্শক ইচ্ছা করলেই সে খবরটি আবার দেখতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট টিভির কর্তৃপক্ষ যদি খবরটি পুনঃপ্রচার করেন, তাহলেই দেখা বা শোনা সম্ভব হয়।
সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই। পাঠক একটি সংবাদপত্র একবার সংগ্রহ করলে যতবার ইচ্ছা তা পড়তে পারেন, পত্রিকাটি সংরক্ষণও করতে পারেন। প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচারিত খবরের যে স্থায়িত্ব আছে, সেটা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নেই। থাকলেও তা দর্শক বা শ্রোতার আয়ত্তে থাকে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে দেশে দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল অল্প কয়েকটি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বাংলা সংবাদপত্র ছিল-দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, পূর্বদেশ ও আজাদ। দুটি ইংরেজি দৈনিক ছিল-বাংলাদেশ অবজারভার ও মর্নিং নিউজ। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ হতো দৈনিক আজাদী। পরবর্তীকালে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহর থেকেই স্থানীয় দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে।
দেশে দৈনিক সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাগজের মূল্যবৃদ্ধি ও অন্যান্য কারণে সব পত্রিকাই সংকটের মধ্যে আছে। সরকার যদি সংবাদপত্রের জন্য কাগজের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সহায়তা করে এবং সংবাদপত্রশিল্পে ব্যবহৃত অন্যান্য সামগ্রীর দামও যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সংবাদপত্র টিকে থাকতে পারবে।
সেক্ষেত্রে পত্রিকাগুলোকে মান উন্নত করে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে। পত্রিকার জনপ্রিয়তা নির্ভর করে পাঠকপ্রিয়তার ওপর। পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিক এবং সব পর্যায়ের কর্মীরা সবাই যদি নিজ নিজ দায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেন, তাহলে সেই সংবাদপত্র অবশ্যই জনপ্রিয় হবে।
সংবাদপত্রের পাঠক হচ্ছে জনগণ। জনগণ যদি পত্রিকাকে পছন্দ করে, তাহলে সেই পত্রিকার বিকাশ ও উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। একটি গণমুখী ও জনপ্রিয় উন্নতমানের সংবাদপত্র রাষ্ট্র ও জাতির উন্নয়নে অর্থবহ অবদান রাখতে পারে।
দুই যুগে যুগান্তর
প্রকাশনার ২৩ বছর পূর্ণ করে যুগান্তর ২৪ বছরে পদার্পণ করছে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। পত্রিকাটি দুই যুগ পূর্ণ করতে যাচ্ছে। তাই এবারের স্লোগান ‘দুই যুগে যুগান্তর’। পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হয় রাজধানীর আরামবাগ এলাকায় ইডেন কমপ্লেক্সে টিনের চাল দেওয়া একটি দোতলা ভবনে।
প্রয়াত অগ্রজ সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার ছিলেন প্রথম সম্পাদক। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ও সখ্য ছিল ১৯৭০ থেকে। আমার বাড়িও আরামবাগের কাছেই, গোপীবাগে। সে কারণেই যুগান্তর অফিসে আমার প্রায়ই যাওয়া হতো। যুগান্তর অফিস এখন আর সেখানে নেই, তবে যুগান্তরের সাইনবোর্ডটি সেখানে এখনো রয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই যুগান্তরের সঙ্গে আমার একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, যা এখনো বিদ্যমান।
সারওয়ার ভাই এখন নেই। যুগান্তর সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন সুহৃদ সাইফুল আলম। তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য। বিশেষ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। সম্পাদক হিসাবে পত্রিকার উন্নয়নে তিনি নিবেদিত। করোনাকালে অসুস্থ হলেও যুগান্তর পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব অব্যাহত রেখেছিলেন। করোনাকালের দুঃসময়েও পত্রিকাকে রেখেছিলেন সচল।
জন্মের পর থেকেই যুগান্তর পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। যুগান্তরের পাঠক সংখ্যা এখন শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। পাঠকপ্রিয়তার মূল কারণ পত্রিকার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ নীতি। জনজীবনের সমস্যা যদি পত্রিকার পাতায় প্রতিফলিত হয়, তাহলে সে পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা তথা জনপ্রিয়তা পাবেই। যুগান্তর তা করতে পেরেছে।
যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিক সহকর্মীদের জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। যুগান্তরের অগ্রযাত্রা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকুক।
চপল বাশার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, লেখক
basharbd@gmail.com
