Logo
Logo
×

বাতায়ন

শুরু থেকে আছি, থাকব

Icon

ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শুরু থেকে আছি, থাকব

পাঠকরা যুগান্তর কেন পড়েন, কেন ভালোবাসেন যুগান্তরকে? এ প্রশ্ন আমাদের কাছে প্রায় সময়ই আসে। এমনকি যুগান্তরের খোদ স্বপ্নদ্রষ্টা, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট শিল্পপতি নুরুল ইসলাম সাহেবও এ প্রশ্ন করেছিলেন আমাকে ডেকে নিয়ে। আমি যুগান্তর প্রকাশের আগে প্রস্তুতি পর্যায়েই সম্পৃক্ত হয়েছিলাম এবং এখনো আছি; তাই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার কোনো বেগ পেতে হয় না। কারণ যুগান্তর প্রকাশ থেকে এ পর্যন্ত সবকিছুই আমার নখদর্পণে। যুগান্তর প্রকাশের উদ্যোগ-প্রস্তুতি এবং পরবর্তী মার্কেটিং সব কিছুই আমার দেখা।

প্রকাশের পরপরই সিলেটে বাজিমাত করে যুগান্তর। প্রকাশের মাত্র ৬ মাসে সব দৈনিককে ছাড়িয়ে শীর্ষে চলে যায়। পুরো বিভাগের পাঠক ঝুঁকে পড়েন যুগান্তরে। সিলেটে চাহিদা এমনই বৃদ্ধি পায় যে, মাঝেমাঝে চাহিদা অনুযায়ী পত্রিকা সরবরাহে অনেকটা অপারগ হয়ে ওঠে ঢাকা অফিস। সিলেটে যুগান্তরের যখন এমন জয়জয়কার, তখন ঢাকায় ডাক পড়ে আমার। যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, যুগান্তরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আমাকে ডেকে নিয়ে অনেক প্রশংসা করেন। সেই থেকে যুগান্তরের সঙ্গে ছিলাম, এখনো আছি, আগামীতেও যত দিন বেঁচে আছি-থাকব।

শুরুর কথা আরও একটু বলি। একদিন খবর পেলাম দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যমুনা গ্রুপ পত্রিকা বের করছে। সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করলাম। সাইফুল ভাইকে ডেকে আমার এজেন্সির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলো। সম্পাদক মহোদয় সিলেটে এলেন, সুধীজনের সঙ্গে বিশাল মতবিনিময় করলেন। যুগান্তর বাজারে এলো। তখন বাংলাবাজার পত্রিকাসহ আরও অনেক পত্রিকা বাজারে। অল্পসময়ে প্রথম আলো পত্রিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষস্থান দখল করে যুগান্তর।

সার্কুলেশন ম্যানেজার ফরিদ খান মজলিস আমাকে জানালেন, যমুনা গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম সাহেব আমাকে দেখতে চান। সিলেটের সার্কুলেশনের খবর পেয়ে তিনি নাকি অভিভূত। তখন আমি এবং আরও কয়েকজন গেলাম। যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান আমাকে দেখেই বললেন, ইসমাইল, পত্রিকাটা কেন মানুষ পড়ে? আমার যুগান্তর কী এমন লিখে! আমি বললাম, পত্রিকায় নতুনত্ব আছে, স্বনামধন্য সাংবাদিক ব্যক্তিত্বরা এর সঙ্গে আছেন, যা সত্য তা-ই লেখা হয়, কারও কাছে মাথা নত করে না।

দেখতে দেখতে মাথা নত না করেই দুই যুগে পদার্পণ করেছে যুগান্তর। তাছাড়া যমুনা বিশাল একটি শিল্প গ্রুপ। রুচিসম্মত কাগজটি সবার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব মিলে পাঠকের অন্তরজুড়ে যুগান্তর। প্রথম সংখ্যা দেখেই বুঝেছিলাম পত্রিকাটি বাজার পাবে, হয়েছেও তাই। সত্যের সন্ধানে নির্ভীক স্লোগান নিয়ে পথচলা যুগান্তরকে এগিয়ে নিতে প্রকাশক, সম্পাদক, সাংবাদিক, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আমরা এজেন্ট, হকারসহ সংবাদপত্রসেবীদের শ্রম, অবদান মোটেও কম নয়। শুরুতে যুগান্তরকে এগিয়ে নিতে যে যেখানে যে দায়িত্বে ছিলেন, সবাই ছিলেন সিরিয়াস।

আমার মনে পড়ে কিছু ঘটনা। স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কোনো পত্রিকাই নিউজটি ছাপার সুযোগ পায়নি। একমাত্র যুগান্তর ছেপেছিল। তাক লাগিয়ে দিয়েছিল গোটা দেশের সংবাদপত্রকে। সেদিন রাতে সিলেটের পত্রিকা চলে এসেছিল ভৈরব পর্যন্ত। মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর পত্রিকাসহ গাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া হয় ঢাকায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ আন্দোলন, সিলেটের সমাবেশে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে বোমা হামলা ও হত্যাচেষ্টা, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা, দেশের শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান গ্রেফতার অভিযান, মাওলানা ফুলতলীর সাক্ষাৎকার, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের পদত্যাগের হুমকির বহুল আলোচিত নিউজ সিলেটে যুগান্তরকে বেগবান করে।

আর এসব আলোচিত বিষয় পত্রিকায় আসার খবর যখনই আগাম জানতাম, আগের দিনই ‘আগামীকাল চোখ রাখুন যুগান্তরে’ বিজ্ঞাপন দিয়ে দিতাম স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে। আর পত্রিকাটিকে সর্বমহলে পরিচিত করে দেওয়া, গ্রাহক সৃষ্টি, পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি লেগেই থাকতাম। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি আমি আমার ভাইদের সঙ্গে কর্মীবাহিনী দিয়ে মাঠে থাকতাম। এখন শরীর অসুস্থ, চিকিৎসক ও পরিবারের সবার বাধানিষেধ অনেক। তার পরও ছুটে চলি দিনভর শুধু পত্রিকার জন্য। আমি কাগজের সঙ্গে থাকলেই বরং মানসিকভাবে ভালো থাকি, অসুস্থ হয়ে পড়ি বিশ্রামে গৃহবন্দি থাকলে। কাগজের সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং আমৃত্যু থাকতে চাই।

অনেক প্রতিকূলতা, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে যুগান্তর এগিয়ে চলেছে। তার কণ্ঠ কেউ রোধ করতে পারেনি, পারবেও না। যুগান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম সবসময় সাহস দিতেন। বলতেন, সত্য কথা লিখে যাবে, কোনো দিন ভয় পাবে না। ভয়কে জয় করে নিবে। আমি তোমাদের পাশে আছি। যুগান্তর সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এখন তিনি নেই, আল্লাহ তার বেহেশত নসিব করুন।

অনেক পত্রিকা বের হয়েছে, আরও বের হচ্ছে, বন্ধও হচ্ছে। কিন্তু যুগান্তর এখনো তার অবস্থানে অটল। এখন ডিজিটাল যুগ। অনলাইন, ফেসবুক, ইন্টারনেট-এত কিছুর ভিড়েও যুগান্তরের প্রতি পাঠকের আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরশীলতা কমেনি। সিলেটবাসীর প্রাণের দাবি সবসময় উঠে আসে যুগান্তরে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুগান্তরের সাহসী উচ্চারণ অব্যাহত আছে। যুগান্তর ভয় পায় না, পিছপা হয় না।

যুগান্তর সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের কথা বলে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকের কাছে সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, খেলার পাতা, সাহিত্য পাতা, বিনোদন পাতা, নারী পাতা, ইসলামী পাতা, প্রবাসী পাতা, আন্তর্জাতিক পাতা, কার্টুন প্রিয়। সংবাদপত্র পাঠ না করলে একটা অতৃপ্তি থেকে যায়। যুগান্তর এ ব্যাপারে সচেতন। সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিদিন সংবাদ প্রকাশনা করে আসছে।

করোনা মহামারি, দুর্যোগ কাটিয়ে যুগান্তর তার লক্ষ্য অব্যাহত রেখেছে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, যুগান্তরের আপসহীন সম্পাদক সাইফুল আলমের নেতৃত্বে। শত সমস্যার মধ্যেও তিনি যুগান্তরের জন্য অন্তঃপ্রাণ। তার দক্ষ, সাহসী লেখনীর সাথী একঝাঁক সাংবাদিক। বিশ্বব্যাপী যখন চরম অর্থনৈতিক সংকট, তখনো যমুনা গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান ও দৈনিক যুগান্তরের প্রকাশক সালমা ইসলাম এমপি পত্রিকা প্রকাশনায় কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেননি।

দুই যুগ ধরে যুগান্তর আমার পরিবারের, আমি যুগান্তর পরিবারের সদস্য। প্রকাশের প্রথম দিন থেকে আজ অবধি নিজ পরিবারকে ঠিকমতো সময় দেইনি, কিন্তু যুগান্তরকে সময় দিতেই হয়। পত্রিকা যারা বিক্রি করে, অনেকেই তাদের ছোট মনে করে। গণমাধ্যমকে ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার কারণে এমন হচ্ছে। অথচ আমি পত্রিকার সঙ্গে থেকে গর্বিত বোধ করি। এখনো নিজেই পত্রিকা হাতে নিয়ে বিক্রি করছি।

সংবাদপত্র, গণমাধ্যম দেশ-জাতি তথা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। অথচ সংবাদপত্র, সংবাদিকদের এখন করুণ অবস্থা। শ্বাসরুদ্ধকর এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদপত্রকে শিল্প হিসাবে ঘোষণা করলেও বাস্তবে তা আলোর মুখ দেখতে পারছে না। সংবাদপত্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও এদেশের নাগরিক, তারা তাদের কর্ম করে খায়। কারও দুয়ারের ভিখারি নয়। তাদের পেছনে ফেলে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়া কখনোই সম্ভব নয়।

সংবাদপত্র জাতির দর্পণ। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে না রাখলে সমাজ ও জাতির কাছে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় সংবাদপত্রকে অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি, যাতে সংবাদপত্র তার নিজস্ব গতিতে চলে। সংবাদপত্রের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে পাঠকের অধিকারও ক্ষুণ্ন হতে বাধ্য। সংবাদপত্রের অধিকার থাকলে সংবাদপত্র পাঠ করে পাঠকরাও তৃপ্তি পাবে। প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে সংবাদে। নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার নিয়ে লড়ছে যুগান্তর। তাই দেশের মানুষের এ সাহসী কণ্ঠ বেঁচে থাক যুগ যুগ ধরে। (শ্রুতিলিখন : সংগ্রাম সিংহ)

ইসমাইল হোসেন : সংবাদপত্র ব্যবসায়ী; স্বত্বাধিকারী, আলমগীর এন্টারপ্রাইজ

 

যুগান্তর

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম