Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা নিয়ে ভোগান্তির শেষ কবে?

Icon

মুঈদ রহমান

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা নিয়ে ভোগান্তির শেষ কবে?

গেল সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত শিক্ষাবিষয়ক দুটি সংবাদে আমরা উদ্বিগ্ন। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার প্রথমটি হলো পাঠক্রম তৈরিতে বিভ্রান্তি, আর দ্বিতীয়টি হলো পাঠদানে অদক্ষতা।

এ দুটি কাজের প্রথমটির সম্পূর্ণ পরিচালন, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর দ্বিতীয়টির প্রধান ভূমিকায় কাজ করে সরকার। আমরা প্রথম সমস্যা অর্থাৎ পাঠক্রম তৈরিতে সরকারের দায়িত্বহীনতার পরিচয় পেলাম এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা প্রত্যক্ষ করলাম।

তবে এ দুটি নেতিবাচক দিকের কুফল সব শেষে শিক্ষার্থীদেরই ভোগ করতে হবে। আমরা এ সংবাদে আশাহত। কেননা আমাদের মতো আমজনতা শিক্ষার সুফল-কুফল সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নই। একটি গতানুগতিক প্রক্রিয়ার ওপরই ভরসা করি আমরা। সেই প্রক্রিয়াটি হলো, সরকার তার নীতিনির্ধারকদের নিয়ে আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নির্মাণে পাঠক্রম তৈরি করে এবং সে অনুযায়ী পাঠদানের ব্যবস্থা করে।

যখন এ দুটি পর্যায়ে বিপর্যয়ের সংবাদ শুনি, তখন হতাশা আমাদের অন্তরে বাসা বাঁধে। এ বিষয়ে আমরা অনেকটা বিভ্রান্তও হই। কারণ, যে কোনো সমস্যা, তা যত যথার্থই হোক, যদি কোনোক্রমে সরকারের বাইরে থাকা মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়, তখন সরকার সেখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে বেড়ায় এবং তা অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠে প্রচার করে।

সুতরাং আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রকৃত সত্য জানতে পারাটা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বিদ্যা-বুদ্ধি কম থাকা আর নির্বোধ সমার্থক নয়। আমরা সংবাদমাধ্যমের ভাষা বুঝতে পারি, যুক্তি-তর্কের কার্যকর মূল্যায়ন করতে পারি। সেই সামান্য জ্ঞান আছে বলেই হয়তো নিরাশা ভর করতে পারে। নিরাশা উপলব্ধি করে আমাদের মন হয়ে ওঠে অস্থির-উতলা।

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়ে প্রথম উদ্বেগের সংবাদটি হলো, মাত্র এক মাস আগে সরকারের পক্ষ থেকে বিতরণকৃত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই প্রত্যাহার করে নিয়েছে সরকার এবং আরও কিছু বইয়ের কিছু কিছু অংশ সংশোধনীর সিদ্ধান্তের কথা বলেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বই দুটি প্রত্যাহার করার মানে হলো কার্যত বই দুটি বাতিল করা।

প্রত্যাহারকৃত বই দুটির ভুলত্রুটি-অসংগতি-বিতর্ক নিয়ে সার্বিক আলোচনা অনেক হয়েছে। আমি এর বাইরে কিছু বলতে চাই। মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু কোন ধরনের ভুল, কোন পর্যায়ে, কী পরিমাণ মার্জনীয় তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। একটি বইয়ের পাঠ্যসূচি প্রণয়নে সারা বছর ধরে কাজ করে থাকে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রম প্রণয়নকারী সংস্থা (এনসিটিবি)। পাঠ্যসূচিতে কী কী বিষয় কেমনভাবে কতখানি সংযোজিত ও উপস্থাপিত হবে, তা নির্ধারণের জন্য শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের নিয়ে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞ পর্ষদ আছে।

সার্বিক তদারকি ও নজরদারিতে রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও মুদ্রণজনিত বা বানানের ক্ষেত্রে কোনো ভুল থাকলে তা মার্জনীয় বলে মনে করি। কিন্তু অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রইল কেন? এ অদক্ষতাকে মেনে নিয়েই বলছি, যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি অথবা আপত্তির বিষয় নিষ্পত্তি করার জন্য একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যুগান্তরের প্রতিবেদন বলছে, পাঁচটি বই-ই সংশোধন এবং এতে বিতর্কিত পাঠ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা রেখেছেন, তাদের খুঁজে বের করতে গত ৩১ জানুয়ারি দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একটির নাম ছিল বিশেষজ্ঞ কমিটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. হালিম এ কমিটির প্রধান ছিলেন।

কমিটিতে শিক্ষক, ধর্মবিশেষজ্ঞসহ সাতজন সদস্য ছিলেন। এছাড়া দায়ীদের চিহ্নিত করতে সাত সদস্যের কমিটির প্রধান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালেদা আক্তার। বিশেষজ্ঞ কমিটিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রণীত পুস্তকে অসংগতি/ভুল/ত্রুটি এক মাসের মধ্যে চিহ্নিত করে তা সংশোধনে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে বলা হয়। কমিটি গঠনের ৯ দিন পর এসব পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে আকস্মিক জুম প্ল্যাটফরমে অনলাইন বৈঠক ডাকা হয়।

ওই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব এবং এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা যোগ দেন। সেখানে পাঠ্যবই প্রত্যাহার বা বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কারণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার যথাযথ সময় হলো গঠিত কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর। কিন্তু বৈঠকের পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টার দিকে হঠাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ফোন করে সিদ্ধান্তের কথা এনসিটিবিকে অবহিত করেন। এর এক ঘণ্টা পর এনসিটিবির চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সরকারের এ তড়িঘড়ি আচরণ আমাদের বিস্মিত করে। একটি জাতীয় পাঠক্রম নিয়ে লুকোচুরির তো কিছু নেই এবং তা রাতারাতি পরিবর্তনেরও বিষয় নয়।

একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তা হতে পারত। তাই আমাদের মনে সংশয় জাগে এই ভেবে যে, আমাদের জাতীয় পাঠক্রম কি রাজনৈতিক সংকীর্ণতার শিকার? কিন্তু তা তো আমাদের কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্য হলো, শিশুদের পাঠ্যবইকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এতে কিছু অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন, সেটি যেমন কাম্য নয়, তেমনই রাজনৈতিক চাপের মুখে তা প্রত্যাহার করাও অপ্রত্যাশিত। পাঠ্যবইয়ের পাঠ নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ খুবই জরুরি। কোন বয়সে কোন পাঠ দেওয়া প্রয়োজন, সেটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন ছিল।

পাশাপাশি যারা আপত্তি তুলেছেন, তাদেরও অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগের বাস্তবতা মাথায় রেখে সমালোচনা করা উচিত। উচিত-অনুচিত যাই হোক, পাঠক্রম প্রণয়নে সরকারের নীতিনির্ধারণের জায়গাটি অধিকতর স্বচ্ছ ও রাজনীতিমুক্ত রাখা জরুরি।

পাঠক্রম তৈরিতে অসংগতির পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার দ্বিতীয় যে সমস্যাটি গেল সপ্তাহের সংবাদমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে তা হলো-পাঠদানে যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতি। সরকারি ও বেসরকারি একাধিক সমীক্ষার যে ফল সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্তরে গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করেন প্রায় ৮৩ শতাংশ অন্য বিষয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষক। এর মধ্যে গণিতে ৮১ এবং ইংরেজিতে ৮৪ শতাংশ শিক্ষক রয়েছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়কে বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ের কোনো শিক্ষক নেই। সেই সঙ্গে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবস্থা নেই ২০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। আমাদের দেশে সব সময়ই শিক্ষার্থীরা গণিত ও ইংরেজিকে তুলনামূলকভাবে কঠিন বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে থাকে। অন্যদিকে আইসিটি বিষয়ের আছে তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক দিক। সেই বিবেচনায় এ বিষয়টিও অপেক্ষাকৃত কঠিন বলে মনে করে শিক্ষার্থীরা।

তাই এ বিষয়গুলোয় সংশ্লিষ্ট ডিগ্রিধারী শিক্ষক না থাকায় বিপাকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংয়ের বদৌলতে কিছুটা পার পেলেও যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাবের উদাহরণ হিসাবে ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে তুলে ধরা যেতে পারে।

এবারের এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে আংশিক সিলেবাসে। তারপরও ৮ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী ইংরেজি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ মাসের ৮ তারিখে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছে।

আমাদের সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার নাম বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (বেনবেইজ)। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর দেশের শিক্ষার পরিসংখ্যান ও তথ্য নিয়ে সমীক্ষা প্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন ৯৬ হাজার ৫৮ জন। এতজন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৯ হাজার ২৮২ জন শিক্ষক আছেন, যারা ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। গণিতের পরিসংখ্যানেও একই চিত্র।

ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় গণিত শিক্ষা দেন ৬৭ হাজার ৯৫৫ জন শিক্ষক। তাদের মধ্যে মাত্র ১৩ হাজার ১২৭ জনের গণিত বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইসিটি বিষয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০ হাজার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইসিটি বিষয়ে শিক্ষাদানের শিক্ষক আছেন ১৬ হাজার প্রতিষ্ঠানে। বাদবাকি ৪ হাজার প্রতিষ্ঠানে আইসিটির কোনো শিক্ষক নেই।

এভাবেই চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। উন্নয়ন ও মেগা প্রকল্পের প্রচারের আড়ালে থেকে যাচ্ছে শিক্ষার দুর্দশা। সরকারের উপর মহল থেকে প্রায়ই শিক্ষাকে ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসাবে বিবেচনার কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ নজরে পড়ছে না। মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ সব সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করে এদেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাদের সন্তানদের সম্পদে রূপান্তরিত করার কোনো ব্যবস্থা সরকারের প্রচেষ্টায় নেই।

অথচ বৈশ্বিক কর্মপ্রতিযোগিতা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। দক্ষ জনবলের অভাবে আমাদের কর্মবাজারে প্রবেশ করেছে বিদেশিরা। সেসব কর্মীর বেতনভাতা বাবদ আমরা প্রতিবছর ব্যয় করছি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু নিজেদের পর্যাপ্ত জনশক্তিকে দক্ষ করে তুলছি না।

একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি গড়ার লক্ষ্যে যে ধরনের পাঠক্রম ও পাঠদানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, তা থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছি। তাই আমরা সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়ে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষা ভোগান্তি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম