দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলন
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান দখল করে নেয় থাইল্যান্ড এবং একই সঙ্গে মালয়, সিঙ্গাপুর, হংকং ও পার্ল হারবারে আক্রমণ করে উন্মুক্ত করে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় থিয়েটারের। জাপানি কমান্ডার লেফটেনেন্ট জেনারেল কাওয়াবে মাসাকাজু প্রথমে আরাকানের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম অভিযান শুরু করেন। তার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রামের ডিসি সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হয় কুমিল্লায়। সাম্পান নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নোঙর করা হয় দাউদকান্দিতে। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের ফিল্ড হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তর করা হয় ঢাকার বেস হাসপাতালে। ঢাকাকে পূর্ব রণাঙ্গনের জন্য একটি হাসপাতালকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়। নীলক্ষেত এলাকার ফাঁকা মাঠটিতে (এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন), অগণিত বাঁশের ঘরের মধ্যে স্থাপন করা হয় হাসপাতাল।
রমনার ফাঁকা জায়গায় সৈন্যদের তাঁবু ফেলা হয়। ঢাকা ক্লাবের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় উঠিয়ে দেওয়া হয় গলফ ও ক্রিকেট খেলার পাট। ১৯৪২ সালের জুলাইয়ে কলাভবন, ফজলুল হক মুসলিম হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সামরিক হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। সলিমুল্লাহ হলকে তিন অংশে বিভক্ত করে তিন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। একটা অংশ চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সেই অংশে, যেখানে আগে ছিল ফজলুল হক হলের স্থান। দ্বিতীয় অংশ চলে যায় তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ভবনে, যেখানে এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দপ্তর। তৃতীয় অংশটি নিয়ে যাওয়া হলো সেগুনবাগিচার খান ম্যানশনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভবন থেকে ফজলুল হক হলকে সরিয়ে আনা হয় বর্তমান ভবনে, যেখানে ওই সময় ঢাকা ইন্টারমেডিয়েট কলেজের হোস্টেল ছিল। ১৯৪২ সালে সৈনিকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম অংশে স্থানান্তর করে গড়ে তোলা হয় হাসপাতাল-যেখানে ছিল ইংরেজি ও দর্শন বিভাগ। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত জঙ্গলাকীর্ণ পুরো এলাকা ছিল জাপানি বিমানের নজরদারি থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।
সৈনিকরা অবসর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে গড়ে তোলে নিবিড় সম্পর্ক। তাদের মধ্যে দু-একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছিলেন, যারা ফজলুল হক হলে আসা-যাওয়া করতেন এবং বইপুস্তক নিয়ে আলোচনা করতেন। সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন, সৈনিকদের মধ্যে সাম্যবাদী আদর্শের কমরেডদের সঙ্গে ছাত্রদের সাহিত্যের আসর বসত। ক্যান্টনমেন্টের সেনাছাউনিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে বিতর্কে অংশ নিতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা। সে সময়ের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সানাউল হক, নূরুদ্দিন, মতিন, মুনীর চৌধুরী, কামাল, নূরুল ইসলাম, বাহাদুর, নাজমুল করিম, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামরিক হাসপাতাল খালি করে দেওয়া হলে পুরো ভবন দখল করে মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে প্রত্যাগত ছাত্ররা। দেশবিভাগের আগেই ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ। সিপাহি বিপ্লবের সময় পুরান ঢাকার সুগার মিল দখল করে কলকাতা থেকে আগত সৈনিকরা যেমন গড়ে তোলে মিল ব্যারাক, অনেকটা সেরকম। প্রথমদিকে আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় মেডিকেল ছাত্রদের স্থান হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলে। পরে ছাত্রদের আবাসনের জন্য কলেজের বর্ধিতাংশে গড়ে তোলা হয় কয়েকটি অস্থায়ী শেড-দেখতে নিগ্রো সেনাদের সেনাছাউনির মতো। অনেকটা এরকম : পাকা মেঝে, সারি সারি ঘর, মাঝে চাটাইয়ের বেড়া। টিনের ছাউনি দেওয়া এ হোস্টেলকে ডাকা হতো ব্যারাক হোস্টেল নামে। বেশি যুক্তিযুক্ত হয়-যদি বলা যায়, সৈনিকদের পরিত্যক্ত শেডে গড়ে তোলা হয় ব্যারাক হোস্টেল। ছাত্ররা উত্তরাধিকার সূত্রে সামরিক সেনাছাউনিতে লাভ করে বেসামরিক আবাসিক সুবিধা।
১৯৪৭ সালে সরকার-বাহিনী কলকাতা থেকে আসে প্রাদেশিক রাজধানী ছোট মফস্বল শহর ঢাকায়। বঙ্গভঙ্গের সময়ে প্রতিষ্ঠিত ভবনগুলোয় অধিষ্ঠিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো লাভ করেছিল রাজকীয় উপঢৌকন হিসাবে। দেশবিভাগের পর নতুন সরকার উত্তরাধিকার সূত্র প্রয়োগ করে সেসব ভবন হুকুমদখল করে শুরু করে প্রশাসনিক কার্যক্রম। জগন্নাথ হল মিলনায়তনে স্থাপিত হয় পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, বাণিজ্য ও আইন অনুষদ নিয়ে যাওয়া হয় মেডিকেল কলেজের একটি ক্ষুদ্র অংশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের পরিত্যক্ত নীলক্ষেত ব্যারাক। প্রাদেশিক সচিবালয় স্থাপিত হয় ইডেন বিল্ডিংয়ে। ইডেন কলেজ কার্জন হলের একটি অংশে স্থানান্তরিত হয়। বর্ধমান হাউজে স্থানপ্রাপ্ত হয় মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন। সরকারি কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় পলাশী ব্যারাক। সামরিক হাসপাতাল হয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ; বেস হাসপাতাল হয় আবাসিক এলাকা। সরকারি সব প্রতিষ্ঠান ছিল দোতলা, শুধু ব্যারাকগুলো ছিল আপৎকালীন সামরিক স্থাপনার মতো ভূমিলগ্ন একতলা টিনের ছাউনি। ১৯৪৬-১৯৪৮ সালের মধ্যে পুনর্বাসিত এসব ব্যারাক হয়ে ওঠে প্রাথমিক কালের ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার।
পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, মানি অর্ডারের ফর্ম, রেল টিকিট ও টাকায় শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহারকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলনের সূচনা করেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। ‘ভাষা মতিন’ প্রথম ভাষা আন্দোলনের চেতনা লাভ করেন নীলক্ষেত ব্যারাকের একটি পথসভায় শামিল হয়ে। সেখানে একজন বক্তা বলছিলেন, এনভেলাপাদিতে বাংলা থাকলেই চলবে না, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাও করতে হবে। একইরকমভাবে সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার সিলেবাসে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, লাতিন, সংস্কৃতিসহ ৯টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত হলেও বাংলাকে বাদ দেওয়া হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত অধিবাসীরা ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেন। ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বাঙালি এবং উর্দুর সমর্থক অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ফুলবাড়িয়া রেললাইনের উভয় পাশে নির্ধারিত হয় বিরোধের সীমারেখা। একপাশে পুরান ঢাকা, অন্যপাশে নতুন ঢাকার ব্যারাক আবাসিক এলাকা। ১২ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার একদল লোক উর্দুর পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে ব্যারাক এলাকায় এসে হামলা চালায়। ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এটাই ছিল প্রথম হরতাল। এরই ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয় নীলক্ষেত ব্যারাকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন। ১৯৪৯ সালের ২ মার্চ কর্মচারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে ছাত্ররাও ধর্মঘট শুরু করে। ভাষা আন্দোলনকে যদি তুলনা করা যায় নদীর সঙ্গে, তাহলে বলা যায় এ নদী উপচে প্রবাহিত হয় এসব আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ঢাকার সম্প্রসারণ শুরু হয়। উঠতি মধ্যবিত্তদের জন্য ১৯৫২ সালে নির্মিত হয় নিউমার্কেট। একই বছর রমনা পার্কের ডিজাইন করা হয়। আগে বিনোদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল সদরঘাটের বেড়িবাঁধ। শাহবাগ, রমনা, ইডেন বিল্ডিং হয়ে বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল পর্যন্ত নির্মিত হয় নতুন সড়ক। একই সঙ্গে ব্যারাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও তাদের সন্তানরা পরিপুষ্ট হয় নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বাতন্ত্র্যের চেতনায়। ১৯৫২ সালে এসে এ ব্যারাকগুলোই হয়ে ওঠে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিকশিত ভাষা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। বায়ান্নর সকালে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে মিছিল পরিচালনার পর বিকালে আমতলা থেকে ব্যারাক পর্যন্ত এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। মেডিকেল কলেজের বিশটি ব্যারাকের মধ্যে বাঁদিকে ছিল ১ থেকে ১১ নং ব্যারাক-যার প্রতিটিতে ছিল পাঁচটি করে কক্ষ। ডানদিকে ছিল ১২ থেকে ১৭ নং ব্যারাক-যার প্রতিটিতে ছিল ছয়টি করে কক্ষ। ১২নং ব্যারাকের সামনে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এমএ শেষবর্ষের ছাত্র বরকত। পাহাড়ের চূড়ায় যেমন জোছনার আলো সবার আগে পতিত হয়, তেমনি ‘অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বিশাল শরীর বালক’ বরকতের ওপর বর্ষিত হয় গুলি। ১৪নং মেডিকেল ব্যারাকের ডানদিকে রফিক গুলিবিদ্ধ হন, রফিকের মাথার খুলি উড়ে গিয়ে মস্তিষ্ক ছিটকে পড়ে। ২০নং ব্যারাকের কাছে গুলিবিদ্ধ হন জব্বার। আবদুল জব্বারের তলপেট বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। সালাম মারা যান মেডিকেল কলেজে দেড় মাস চিকিৎসার পর।
সালাম ছিলেন শিল্প বিভাগের রেকর্ড কিপার, থাকতেন পলাশী ব্যারাকে। রফিক কাজ করতেন প্রিন্টিং প্রেসে। শফিকুর ছিলেন সরকারের হিসাব বিভাগে কর্মরত, সাইকেলে অফিসে যাওয়ার পথে নবাবপুর রোডে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। সবারই বাসস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যারাকে নির্মিত আবাসিক এলাকায়। এভাবে বার্মা ফ্রন্টে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে তোলা সামরিক হাসপাতাল দশ বছর পর ভাষা আন্দোলনকালে আবার পরিণত হয় বেস হাসপাতালে। যুদ্ধাহত কৃষ্ণাঙ্গ সেনাদের স্থান দখল করে নেয় বাঙালি ভাষাসৈনিকরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির কাল। এরই ধারাবাহিকতায় ভাষা আন্দোলনের পর বাংলাদেশ লাভ করে দ্বিতীয় মুক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত ব্যারাকগুলোকে বলা যায় সেই মুক্তির সূতিকাগার।
ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ
mahmoodnasirjahangiri@gmail.com
