Logo
Logo
×

বাতায়ন

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া : একটি পর্যবেক্ষণ

Icon

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার ও ড. মো. বিল্লাল হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া : একটি পর্যবেক্ষণ

মূল্যায়ন হলো একটি শিক্ষাক্রমের প্রাণ। জাতীয় প্রয়োজন এবং পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সময়ের ব্যবধানে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়।

শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে কিনা তথা শিক্ষার্থীর মধ্যে সেই কাক্সিক্ষত যোগ্যতা ও দক্ষতা তৈরি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা হয় সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে।

আর এটি নিশ্চিত করা হয় শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন ধাপে, যাতে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও দক্ষতা সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়।

এক্ষেত্রে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে চলমান শিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং মূল্যায়নের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্যে নিশ্চিত করা হয়।

এভাবে বিশ্বব্যাপী আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতায় দক্ষ করে তোলে এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়।

আমাদের দেশে সর্বশেষ শিক্ষাক্রম নবায়ন হয়েছিল ২০১২ সালে। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম আরও আগেই বাস্তবায়নের কথা থাকলেও কোভিড-১৯-এর কারণে তা সম্ভব হয়নি।

তাই ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের নির্দিষ্টসংখ্যক স্কুলে এর পাইলটিং সম্পন্ন হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যেসব অস্পষ্টতা রয়েছে,তা স্পষ্ট করতে না পারলে নতুন এ পদ্ধতির সুফল নিয়ে সংশয় তৈরি হবে।

একটা সময় ছিল যখন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়বস্তু মনে রেখে তা পরীক্ষার হলে উত্তরপত্রে উপস্থাপন করতে পারল কিনা তা-ই মূল্যায়ন করা হতো।

কিন্তু বাস্তব জীবনে মানুষের আরও অনেক দক্ষতার প্রয়োজন হয়; যেমন- বিষয়বস্তু উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করা, হাতে-কলমে কাজ করা, দলে নেতৃত্ব ও দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারা, একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা, নিজের আনুষঙ্গিক কাজ নিজেই করতে অভ্যস্ত হওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় থাকা ও ব্যবহার করতে পারা, স্বাস্থ্যসচেতনতা ও ট্রাফিক রুলস মানা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করা ইত্যাদি।

পড়ালেখা শেষ করে শিক্ষার্থীকে এগুলো নতুন করে অর্জন করতে হয়, যা অনাকাক্সিক্ষত। এসব বিবেচনায় শিক্ষাক্রম পরিবর্তন বা নবায়নের কাজ শুরু হয়। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় বর্ণিত বিবরণ অনুযায়ী শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং চাহিদা নিরূপণের জন্য ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালব্যাপী বিভিন্ন গবেষণা ও কারিগরি অনুশীলন পরিচালিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় ১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে বিভিন্ন সংস্থার ১৫৬ জন বিশেষজ্ঞ অনেক কারিগরি কর্মশালা ও ভার্চুয়াল সভায় তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।

সব দিক বিবেচনায় দক্ষতাভিত্তিক এ পদ্ধতির মূল্যায়ন অংশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যেমন-ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৫টি বিষয়ে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন, আর বাকি ৫টি বিষয়ে শতভাগই শিখনকালীন মূল্যায়ন। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন নয়। শিখনকালীন মূল্যায়নে গুরুত্ব দিয়ে বহুমুখী মূল্যায়ন যেমন -সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তনের চিন্তা করা হয়েছে।

অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, যোগাযোগ, পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান, হাতে-কলমে কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্যায়ন করে প্রারম্ভিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর ও পারদর্শী স্তর -এ তিনটি ধাপে ফল প্রকাশ করা হবে। এক্ষেত্রে এই নম্বর বা গ্রেডবিহীন দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পাবলিক পরীক্ষা বা উচ্চশিক্ষায় কীভাবে সমন্বয় হবে, তা স্পষ্ট করা দরকার। দক্ষতার স্তর বিবেচনায় শিক্ষার্থী পরবর্তী ক্লাসে যাবে নাকি আগের ক্লাসে থাকবে, তা-ও স্পষ্ট হওয়া দরকার।

যেহেতু শিখনকালীন মূল্যায়নে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়পক্ষই উপকৃত হয় এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার নিজের অবস্থা অনুমান করতে পারবে; সেহেতু দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সে আরও তৎপর হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষক হিসাবে পাঠদানের উদ্দেশ্য কতটা সফল হচ্ছে, তা জেনে একদিকে পাঠদানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারবে, অন্যদিকে দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়ক হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে দশটি শিখনক্ষেত্র চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করা এবং যোগ্যতা বা দক্ষতা ঠিক করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিষয়ের অধ্যায়ভিত্তিক দক্ষতাসমূহ কোন অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে করা হবে তা-ও টিচার্স গাইডে উলে­খ করা হয়েছে। এ গাইড অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে বেশ সুফল পেয়েছে। আসলে একটি শিক্ষাক্রম থেকে তাত্তি¡কভাবে বর্ণিত সুফল পাওয়া নির্ভর করে তার সঠিক বাস্তবায়নের ওপর, যা হয়ে থাকে শিক্ষকদের হাত ধরে শ্রেণিকক্ষে। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা।

কারণ এক সময়ের ‘এসো নিজে করি’ পদ্ধতি এবং সর্বশেষ ‘সৃজনশীল’ পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এ পদ্ধতিতে মাউশির তদন্তমতে অর্ধেকসংখ্যক শিক্ষককেও সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে দক্ষ করা যায়নি। ‘রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন’ শীর্ষক জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝার জন্য গৃহশিক্ষকের সাহায্যের প্রয়োজন হয় -এমন তথ্য উঠে আসে।

সাবেক শিক্ষা সচিব এনআই খানের একটি লেখা থেকে জানা যায়, আমাদের শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সৃজনশীল হবে এ প্রত্যাশায় সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হলেও ২০২২ সালে সৃজনশীল ইনডেক্সে বাংলাদেশকে ১৩৫টি দেশের মধ্যে ১২৯তম অবস্থানে দেখা গেছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পরীক্ষার মাধ্যমে নম্বর দেওয়া ও মূল্যায়ন করার পরিবর্তে কোনোরকম পরীক্ষা ছাড়া নম্বর দেওয়া এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার বিষয়টি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তাই বিষয়টি নিশ্চিন্ত করার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সময়মতো বই ও গাইড হাতে পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। আধুনিক ডিজিটাল অ্যাপস ও ডিভাইস সম্বন্ধেও তাত্তি¡ক জ্ঞান প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাবিষয়ক টেলিভিশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রচার করা হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

বিশ্বায়নের এ সময়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকলে দেশও অগ্রগতির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। পুরোনো প্রথার কোচিং বাণিজ্য, গাইড বইয়ের নির্ভরশীলতার পরিবর্তে শিল্পকারখানা পরিদর্শন, মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন, আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ স্থাপনা পরিদর্শন, আধুনিক খামার (হাঁস, মুরগি, মাছ, গবাদিপশু, ফুল, ফল চাষ) ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি সংযোজন বর্তমান শিক্ষাক্রমকে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময় করে তুলবে, যা শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে বের করে আনতে খুবই সহায়ক হবে। তবে এসবের বাস্তবায়ন নিশ্চিতে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় দ্রুত করতে পারলে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাবে এবং এ নিয়ে সব বিভ্রান্তির অবসান হবে।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার ও ড. মো. বিল­াল হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক

 

নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন. প্রক্রিয়া.একটি পর্যবেক্ষণ.

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম