মিঠে কড়া সংলাপ
ভ্রষ্টাচারের রাজনীতি আর নয়
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে একে অপরের প্রতি বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেন, তাতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বলে কোনো কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কারণ একে অপরকে ঘায়েল করতে ভাব ও ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি অসহনশীল ও বেসামাল। আর বিষয়টি মাঠ পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ায় রাজনীতির ময়দানে বক্তৃতা-বিবৃতিতে টপ টু বটম যেসব ভাব ও ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেরাই নিজেদের সম্মানহানি করে চলেছেন।
নিজেদের পরস্পর তারা ভোটচোর, ভোট ডাকাত, অর্থ পাচারকারী লুটেরা ইত্যাদি বলাসহ অনুল্লেখযোগ্য অনেক ভাষা ব্যবহার করে থাকেন, গালমন্দ করেন। আর তাদের এসব কথার প্রভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মসহ কোমলমতি শিশুরাও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ বিভিন্ন মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি ছড়িয়ে পড়ায় ভাইরাল হয়ে এসব কথা দেশ-বিদেশের সব শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি কথাবার্তায় সাবধানতা অবলম্বন না করেন, তাহলে নিজেদের সঙ্গে তারা দেশ ও জাতিরও ক্ষতি করে চলবেন বলে মনে করি।
উল্লেখ্য, এমনিতেই বর্তমান অবস্থায় আমাদের দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তার ওপর নিজেদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি বেড়ে গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কারণ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শক্তির দড়ি টানাটানিতে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বৈদেশিক শক্তি নাক গলাচ্ছে। সে অবস্থায় আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশও আমাদের দেশের রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ে আমাদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
অন্যদিকে ভারত এবং চীনও বসে নেই। আমাদের দেশের রাজনীতি নিয়ে তারাও ছক কষে চলেছে। আর এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা এখন, ‘গরিবের বউ সবার ভাবী’! একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তির তিনটি দেশসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেভাবে খোলামেলাভাবে মাঠে নেমে পড়েছে, সত্যি তা দুঃখজনক। বিশেষ করে স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে দেশটি স্বাধীন করেছিলেন, তাদের জন্য কষ্টটা আরও বেশি।
আর এজন্য দায়ী হলো আমাদের দেশের অপরাজনীতি। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজনীতির ময়দানে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মতো এক দল অপর দলকে ঢালাওভাবে যাচ্ছেতাই বলে না বা এভাবে গালমন্দ করে না; একজন আর একজনকে, এক দল আর এক দলকে তুই চোর, তুই চোর বলে গলা ফাটায় না। অথচ আমরা সেই কাজটিই অহরহ করে চলেছি। সংবাদ শোনার জন্য এখন যে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের বাটন টিপলেই দেশের বড় বড় দলের বড় রাজনীতিকদের পারস্পরিক বিষোদগার তথা গালমন্দের এসব কথা শুনতে পাওয়া যায়। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, এ কোন দেশে আছি আমরা! তাদের কথাবার্তা, বাগবিতণ্ডা চলার সময় টেলিভিশনের সামনে কোনো শিশু থাকলে তাকে সরিয়ে দিতে হয়।
এ অবস্থায় এখানে উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, আমাদের দেশের রাজনীতি সঠিক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে না বা সঠিক পথে এগিয়ে চলছে না। কারণ রাজনীতির নামে দিনরাত গরম গরম বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আমরা একে অপরকে যেভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করে থাকি, তাতে আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থার ওপরই এর বিরূপ প্রভাব পড়ে থাকে। আর এভাবে রাজনীতিকদের কথাবার্তায় হিংসা-প্রতিহিংসার বীজ রোপণ করা হয়। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে তা প্রোথিত হয়ে সারা দেশে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় এসব হিংসা-বিদ্বেষের ফলাফল মারাত্মক আকার ধারণ করে। নেতৃবৃন্দের বক্তব্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর অন্য নেতাকর্মীরা বিবদমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে মারামারি হানাহানি শুরু করে দেয়। একে অপরের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়; পরস্পরের প্রাণ সংহার করতে দ্বিধাবোধ করে না।
কথাগুলো এখানে এভাবে বলার কারণ হলো, স্বাধীনতার পর অনেকবার আমরা এমন সব অমানবিক ঘটনা দেখতে পেয়েছি, রাজনীতির নামে দেশের সাধারণ মানুষের জানমাল নষ্ট হতে দেখেছি। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের ত্রাহি অবস্থা দেখেছি, হরতাল-অবরোধের কারণে দিনে আনা দিনে খাওয়া মানুষের করুণ অবস্থা দেখেছি। আর সবই করা হয়েছে রাজনীতির নামে। রাজনৈতিক দল এবং নেতারা ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা রক্ষার প্রতিযোগিতায় এসব করেছেন।
কখনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আবার কখনো ভিন্ন ইস্যুতে তারা আন্দোলন-সংগ্রামের নামে প্রকারান্তরে দেশের সাধারণ নিরীহ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক একটি রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্নভাবে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে; আর তা রক্ষার জন্য দেশের সাধারণ মানুষকে বারবার বিপদগ্রস্ত করেছেন; জিম্মি করেছেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতার বেনিফিসিয়ারি নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে অর্জিত অর্থবিত্ত দ্বারা হুন্ডা-গুন্ডা বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করে আন্দোলন-সংগ্রামের নামে বা আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিরোধের নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বিভিন্নভাবে নিরীহ মানুষের অধিকার হরণ করেছেন। কেউ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে আবার কেউ ভোটাধিকার রক্ষার নামে এসব করে দেশের মানুষকে বোকা বানিয়েছেন।
আর এ কথাটিও বলার কারণ হলো, দিন শেষে দেখা যায়, উভয় দলের চরিত্রই এক ও অভিন্ন। ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলে বা ক্ষমতায় বসলে ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে সবকিছু ভুলে যাওয়াই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের চরিত্রের যে দিকটা দেখতে পাওয়া যায়, ক্ষমতায় না থাকার সময়ে ঠিক তার বিপরীত চিত্রটি পরিলক্ষিত হয়। সময়ে সময়ে আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, অবরোধের নামে এসব রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের দেশের মানুষকে বিপদগ্রস্ত করা বা জিম্মি করার অধিকার আছে কিনা, সে বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
পরিশেষে বলতে চাই, হিংসা, বিদ্বেষ থেকেই কিন্তু প্রতিহিংসার জন্ম হয়; আর প্রতিহিংসা থেকে জিঘাংসার সৃষ্টি হয়। আদিকাল থেকেই মানুষ প্রতিহিংসা, জিঘাংসার বশবর্তী হওয়ায় যুগে যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতিতে অনেক ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছে। আর আমাদের দেশেও এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এমনই একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমি নিজে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গুলিস্তানে গ্রেনেড হামলার সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং একটু দূরে থাকায় নিরাপদ ছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সে দৃশ্য কখনো ভুলে যাব না; ভুলে যাব না মানুষের আর্তনাদ ও মৃত্যযন্ত্রণার সেসব দৃশ্যও। সে সময় আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক পদে ছিলাম। অতঃপর সেদিনের গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সেক্রেটারি আব্দুল জলিলসহ আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম, অত্যন্ত বিমর্ষ হৃদয়ে তিনি বসে আছেন এবং গ্রেনেড হামলায় আহতদের চিকিৎসার জন্য সাহায্য সংগ্রহ করছেন।
সেদিন তার কাছে গিয়ে আমিও খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম এবং দেখেছিলাম তার পাশে শুধু বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বসা আছেন। এ ঘটনাটিও আমার জীবনে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। কারণ বেশ কিছুক্ষণ সেখানে উপস্থিত থেকে দেখেছিলাম, গ্রেনেড হামলায় আহতদের সাহায্যার্থে সেখানে আর কেউ এগিয়ে আসেননি; যেমনটি দেখেছিলাম, ২০০৮ সালে জিল্লুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি থাকাবস্থায়, তার বাড়িতে একটি মিটিং শেষে তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আশরাফ ভাই যখন বললেন, ‘১৫ আগস্ট পালনের জন্য আমার কাছে টাকা না থাকায় আমি কোনো অনুষ্ঠান করতে পারব না’।
উল্লেখ্য, সে সময়ও আমি দলের সহ-সম্পাদক ছিলাম এবং আশরাফ ভাইয়ের কথা শুনে কেউ কিছু না বলে একে একে সবাই চলে গেলেন দেখে সেদিনও খুব বেদনাহত এবং অবাক হয়েছিলাম। আমি ছাড়া সেদিনের ঘটনার অন্য প্রত্যক্ষর্শীরা হলেন ডাক্তার দীপু মনি এবং আখতারুজ্জামান। তা ছাড়া ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বাসার দু’জন কর্মচারীও বিষয়টি জানেন। উল্লেখ্য, বর্তমান অবস্থায়, দেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে, মানুষের, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষের চরিত্রের বিশেষ একটি অধ্যায় তুলে ধরার জন্যই এখানে ঘটনাটির অবতারণা করা হলো।
লেখাটির উপসংহার টেনে বলতে চাই, বর্তমান অবস্থায়, আমাদের দেশে রাজনীতিকরা রাজনীতিকে ব্যবসা হিসাবে ব্যবহার করে চলেছেন। ফলস্বরূপ বিপদের সময় তাদের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যায় না। আর এই শ্রেণির নেতাকর্মীর মধ্যে নীতি-আদর্শেরও বালাই থাকে না। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই গলা ফাটায়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি করে। কারণ ক্ষমতায় না গেলে বা ক্ষমতার কাছাকাছি না থাকলে তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে না। তারা যা কিছু বলেন, তার সবই রাজনৈতিক তথা সামাজিক অঙ্গন কলুষিত করে। এ শ্রেণির রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক শিষ্টাচারও থাকে না। এ অবস্থায়, এই শ্রেণির নেতৃবৃন্দ থেকে সরকারি দল, বিরোধী দল উভয়েরই সতর্ক থাকা উচিত বলে মন করি। কারণ আদর্শহীন, নীতিহীন, শিষ্টাচারহীন এসব নেতাকে কিন্তু প্রয়োজন বা বিপদের সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
