|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজকাল প্রায়ই দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। করোনা মহামারিতে বিশ্বের অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ববাজার ব্যবস্থা টালমাটাল। আজ উন্নত বিশ্বে মূল্যস্ফীতির লাগাম কেউ ধরে রাখতে পারছে না। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সব দেশে সর্বক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কতগুলো দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। ইউরোপেও খাদ্যদ্রব্যে রেশনিং শুরু হয়েছে। বিশ্বের এমন অসহনীয় দুর্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কাম্য নয়। স্বাধীনতা কি এতই সস্তা বস্তু, এতই ঠুনকো?
বাঙালি হাজার বছর ধরে শোষণমূলক শাসনে পর্যুদস্ত ছিল। ব্রিটিশ শাসনে দু’দুবার বাংলার মানুষ মন্বন্তর দেখেছে। না খেয়ে লাখ লাখ মানুষ মরেছে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষ না খেয়ে মারা গেছে। বাংলার সব ফসল ব্রিটিশ সরকার জোর করে দেশের বাইরে নিয়ে যায় তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এটি ছিল বাঙালি জাতির সবচেয়ে ভয়ংকর দুর্যোগ, মহামারি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মানুষ না খেয়ে, আধাবেলা খেয়ে জীবনধারণ করেছে। তখনো স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। এখন গরিব মানুষ গরুর মাংস না খেতে পেরে পরাধীন হয়ে গেল? ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর আমরা দেখেছি, বাঙালিরা কোনো উৎসব/পার্বণ ছাড়া মাংস খেতে পারত না। বিশেষ করে গ্রাম-বাংলার মানুষ কোনো সচ্ছল পরিবারে বিয়ে হলে একটি খাসি জবাই করে বেশি করে আলু আর ঝোল দিয়ে ১০০ মানুষকে খাওয়াতে পারত। মুরগি খাওয়া হতো কোনো বাড়িতে জামাই এলে বা বহুদিন পর মেহমান এলে। মুরগির মাংস খাওয়া ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি উৎসব। আর আজ হতদরিদ্ররাও মুরগির মাংস খায়। গ্রাম-বাংলায় একমাত্র কুরবানির ঈদেই মানুষ গরুর মাংস দেখতে পেত। তখন কি আমরা স্বাধীন ছিলাম? ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা কি এতই ঠুনকো যে গরুর মাংস না খেতে পেড়ে পরাধীন হয়ে গেলাম! এটা অবশ্যই বাসন্তীকে জাল পরানো সেই আমেরিকান দালালদের মানসিকতা। আমেরিকার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ১৯৭৪ সালে বাসন্তীকে ছেঁড়া জাল পরিয়ে পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা প্রমাণের জন্য। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর অনুরোধে এক জাহাজ পাটের বস্তা পাঠিয়েছিলেন। কিউবায় তখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ ছিল। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পাঠানোর সব চাল, গম ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে এ দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এ জন্য দেশদ্রোহী ও বঙ্গবন্ধুবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধাচরণ করতে দেশবাসীকে প্ররোচিত করেছিল।
আমেরিকার ভয়ে আজ বিশ্বের কোনো দেশ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায় না। যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির বলে পৃথিবীর যে কোনো দেশকে বা তার সরকারকে যে কোনো সময় উলটে দিতে পারে। এ কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি দেশে তাদের পালিত দালালদের পুষে থাকে। আমরা শুনেছি, পাকিস্তান আমলে অনেক বাঙালিও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার্থে অহরহ কাজ করতেন। কোনো প্রমাণ নেই, তবে ছাত্রাবস্থায় শুনেছি-জামায়াত, মুসলিম লীগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তলপিবাহক। এমনকি আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। তখন অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং বড় বড় সাংবাদিকসহ বহু আমলা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত থাকতেন। এতে তাদের স্বার্থসিদ্ধি হতো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক পন্থা ধরায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষের শক্তি তাকে হত্যা করে স্বাধীনতাকে ম্লান করে দেয়। যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বাধীনতার বিরোধী ছিল এবং অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করে বাঙালি নিধনে সহায়তা করেছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রের দালালি করছে কিছু বাঙালি ব্যক্তিস্বার্থে। হায় সেলুকাস!
আজ বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে একটি গোষ্ঠী দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে এনে বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চায়। যেমনটি চেয়েছিল ইরাক ও লিবিয়ার স্বার্থান্বেষী মহল। যখন ইরাক ও লিবিয়া উন্নতির চরম শিখরে এবং আরব দেশে তারা সামরিকভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ, তখনই বাকস্বাধীনতার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অনুগতদের মাধ্যমে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার মোয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে ক্ষমতার লোভে ইরাকি ও লিবিয়ান বাকস্বাধীনতা কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রকে দেশ দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করিয়ে দেন। সাদ্দাম হোসেন আর গাদ্দাফি আজ নেই; কিন্তু সেখানে কি বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে? তারা আজ পরাধীনতার চেয়েও নিকৃষ্টতর জীবনযাপন করছে। গৃহযুদ্ধ লেগেই আছে, মানুষ হত্যা নিত্যদিনের ঘটনা। আজ ইরাক ও লিবিয়ায় খাদ্য ও ওষুধের অভাবে বহু লোক প্রাণ দিচ্ছে। এটাই কি যুক্তরাষ্ট্রের বাকস্বাধীনতার নমুনা? যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইরানের বিরুদ্ধে বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের কথা বলে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করে অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে পরাভূত করতে চেয়েছে। একসময় নিজেরা পরাজিত হয়ে কূটচালে ইরানের সঙ্গে ইরাকের যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র আজও ইরানের প্রতি যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু ইরানের জনগণ তাদের সরকারের প্রতি অবিচল বিশ্বাস রেখেছে বলে ইরানকে তার নীতি থেকে পিছু হটাতে পারেনি। ইরানিরা প্রমাণ করেছে, জনগণই সর্বশক্তির উৎস। বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকার পশ্চিমাদের একটি কৌশল মাত্র, যার মাধ্যমে তারা যে কোনো দেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে, যদিও সেই দেশের কোনো লাভ হয় না। তাই জনসাধারণের প্রতি আহ্বান করব, সস্তা স্লোগানে বা দুষ্ট সংবাদে তাড়িত না হয়ে আসল অবস্থা অনুধাবন করে দেশের ও জনগণের স্বার্থে সঠিক অবস্থানে থাকুন। কোনো গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে সঠিক পথে চলুন, যাতে দেশ ও জনগণের কোনো ক্ষতি না হয়। সরকার যদি জনবিরোধী কোনো কার্যক্রম চালায়, অবশ্যই তার বিরোধিতা করা হবে; কিন্তু দেশ ও জনগণের কোনো ক্ষতি করে নয়।
খান মোহাম্মদ নজীব : অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
