Logo
Logo
×

বাতায়ন

সময়, পরিস্থিতি ও ইতিহাসের চাকা

Icon

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সময়, পরিস্থিতি ও ইতিহাসের চাকা

পাবলো পিকাসো জন্মের পর প্রথম ‘লাপিজ (স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘পেনসিল’) শব্দটি দিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলেন। মা বুঝেছিলেন, ছেলে তার অনেক বড় মাপের মানুষ হবেন। মা বলে কথা, ঘটেছিল তা-ই। পেনসিল মায়ের কাছে শুধু একটা শব্দ ছিল না, শব্দের চেয়ে অনেক বড় কিছু ছিল। পাবলো পিকাসো একদিন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী হলেন। পেনসিল শব্দটা পূর্ণতা পেল, পেনসিল থেকে জন্ম নিল পৃথিবীর সেরা চিত্রকর্মগুলো। পিকাসো সবসময় বলতেন, ‘আমি কিছু খুঁজি না, আমি পেয়ে যাই।’ খুব অদ্ভুত একটা দর্শন। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পাওয়ার মতো। আলোতে খুঁজে পাওয়া খুব সহজ, অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।

পিকাসো আমাদের বুঝিয়েছেন, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হলে খুঁজতে নেই, বরং না খোঁজার মাঝেই অচেনাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনার আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় ছবি কোনটি?’ খুব কঠিন একটা প্রশ্ন; কিন্তু উত্তরটা ছিল খুব সহজ। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি ছবি আঁকার সময়ই মনে হয়েছিল এর পরে যে ছবিটি আঁকব সেটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি।’ শিল্পীর মন পিপাসার্ত থাকে, এ পিপাসা আমৃত্যু থাকে। যতক্ষণ জীবন থাকে ততক্ষণ সেরা সৃষ্টির অতৃপ্তিটা থেকে যায়। যেমন থেকে যায় সত্যকে প্রমাণ করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মতো দুঃসাহস। সত্য প্রচারের জন্য সক্রেটিসের হেমলক পানে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। তার শিষ্যরা তার পালানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সক্রেটিস কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাননি। কারণ, তিনি জানতেন পালিয়ে গেলে তার বিশ্বাস চিরতরে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতো। কখনো কখনো সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে মৃত্যুকে বরণ করতে হয়। সক্রেটিসের দেহের মৃত্যু ঘটলেও বিশ্বাসের মৃত্যু ঘটেনি।

আহা, একসময় পাবলো পিকাসো, সক্রেটিসরা ছিলেন; এখন তাদের মতো তেমন মানুষের আর দেখা মেলে না। হয়তো সময়ের দেহের বিকাশ ঘটেছে, মাথাটা ফেলে এসেছে অনেক পেছনে।

২.

একজন গ্রিক মহাকবি। অথচ কী অদ্ভুত! কোথায় তিনি জন্মেছেন, কখন তার জন্ম হয়েছে, কখন তার মৃত্যু হয়েছে-কেউ তা জানে না। তিনি দেখতে কেমন ছিলেন, সেটা পর্যন্ত কেউ জানে না। ভাবা যায়, যে মানুষটার জীবন সম্বন্ধে গবেষণার পর গবেষণা করেও তেমন কিছু পৃথিবী জানতে পারছে না, সে মানুষটার এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যে চারটি কাব্য মহাকাব্যের স্বীকৃতি পেয়েছে এর মধ্যে দুটি হলো ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’!

আমাদের চারপাশেও হয়তো এমন কিছু মানুষ আছে, যারা স্বীকৃতির লোভে কাজ করেন না, বরং তারা পৃথিবীর জন্য কিছু করে যেতে চান। বিনিময়ে তারা কিছুই আশা করেন না, একটু সম্মান নিয়ে বাঁচতে চান। লোক দেখানো পৃথিবীতে এখন হয়তো তাদের কোনো মূল্য নেই, যেদিন সময়ের পর সময় পেরিয়ে মহাকালের স্রোতে ভেসে যাবেন তারা, সেদিন হয়তো তাদের সৃষ্টিগুলোকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে মানুষ তাদের নাম-পরিচয় খুঁজবে। তাদের নিয়ে গবেষণা হবে। সে গবেষণায় সে মানুষটাকে কতটা খুঁজে পাবে, তা হয়তো সময় বলে দেবে। কিন্তু এ সময় আর সে সময়ের মধ্যে তখন যোজন যোজন তারতম্য থাকবে। এ সময়ের মানুষরা তখন আর থাকবে না। খুব বিচিত্র এ পৃথিবী। চোখের সামনে থাকলে মানুষ খোঁজে না, ভালোবাসে না; হারিয়ে গেলে মানুষ খোঁজে, ভালোবাসে।

গ্রিক কবি হোমারের কথা বলছিলাম। মার্টিন ওয়েস্টের মতে, হোমার কোনো ঐতিহাসিক কবির নাম নয়, বরং কাল্পনিকভাবে সৃষ্ট একটি নাম। যে সময়ে মানুষটাকে মূল্যায়ন করার কথা ছিল, সে সময়ে সেটি করা যায়নি বলেই এমনটা হয়তো ঘটেছে। মানুষটা ছিল, কেউ একজন ছিল, সময়ের কাচের দেওয়ালে কুয়াশা পড়ে ঝাপসা হতে হতে এখন মানুষটাই কারও কারও কাছে হয়ে গেছে কাল্পনিক চরিত্র। খুব অদ্ভুত এক রূপান্তর-মানুষ নয়, কল্পনার মানুষ।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে যিশুখ্রিষ্টের বারোজন শিষ্যের ছবি আঁকতে পারলেও যিশুখ্রিষ্টের মুখটা আঁকতে পারছিলেন না। কেবল ভাবছিলেন, কেমন হতে পারে যিশুখ্রিষ্টের মুখ, কেমন হতে পারেন এ মহামানব! কল্পনার পর কল্পনা করে গেছেন, সময়ও কেটে গেছে অনেকটা। তারপর মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মুখটা আঁকলেন। কখনো কখনো কল্পনা বাস্তবতাকেও হার মানিয়ে যায় এভাবে। মন যখন ডাক দেয়, কল্পনা তখন সত্যে পরিণত হয়।

গ্রিক শব্দ থেকে ‘হোমার’ নামটি এসেছে, যার অর্থ অন্ধ ও পরাধীন। এ থেকে কেউ কেউ মনে করেন, হোমার অন্ধ ও গ্রিক ক্রীতদাস ছিলেন। হয়তো সবটাই সত্য, সবটাই মিথ্যা, সবটাই আংশিক সত্য, আংশিক মিথ্যা। যদিও হোমার বলেছেন, কিছু জিনিস আপনি নিজের সম্পর্কে ভাববেন...কিছু জিনিস ঈশ্বর আপনার মনের মধ্যে দিয়ে দেবেন।

প্রতিভাধর মানুষকে তাদের সময়ে মূল্য দিতে না পারলে মানুষগুলো হারিয়ে যায়। একবার হারিয়ে গেলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন কত মানুষ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেও হয়তো ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিতে পারেননি তখনকার মানুষের মনের দৈন্যের কারণে। অথচ তাদের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে যারা, তাদের হয়তো কোনো অবদানই ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা, অর্থ, আধিপত্যের মতো শোষণের হাতিয়ারগুলো ছিল। মানুষের কারণেই সময় হেরে যায়, মানুষ হেরে যায়, সত্যগুলো মাটিচাপা পড়ে যায় নীরবে, খুব সন্তর্পণে।

৩.

পরিস্থিতি পালটায়, চাকা ঘোরে। কথাটার মধ্যে কেমন যেন একটা ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান আছে। যেখানে পথ শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকেই আবার নতুন পথ গড়ার আকুতি আছে। সে নিঃশব্দ আহ্বান, নিঃসম আকুতিকে যারা শুনতে পায়, তারাই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে লড়তে একদিন অনুকূল পরিস্থিতির জন্ম দেয়।

মনে পড়ছে, তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এক ছেলের কথা। কোনোমতে খেয়েপরে বেঁচে থাকার মতো জীবনটা ছিল তাদের। বাবা নৌকা চালাতেন, ছেলেটা আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখত। কুপির নিভুনিভু আলোয় বইয়ের পাতাগুলো উলটে উলটে জ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে যেত। মা বুঝতেন ছেলেটার ভেতরের স্বপ্নগুলো কতটা ডানা মেলেছে; কিন্তু কখনো ভাবেননি সে ডানা একদিন সব অচলায়তন ভেঙে ‘উইংস অব ফায়ার’ হয়ে উঠবে। কারণ জীবনটা সে সময় ছিল লড়াইয়ের, অভাবের, অনিশ্চয়তার, অবহেলার। সময় বদলায়, পরিস্থিতি পালটায়, চাকা ঘোরে। একদিন সবার চোখের আড়ালে পড়ে থাকা ছেলেটাই ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হলেন। এরপর ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন। স্বপ্ন দেখতেন যতো, স্বপ্ন দেখাতেন তার থেকেও অনেকগুণ বেশি, ঠিক যেন কবির মতো, যে কবি কেবল কবিতা লিখেই নিজের দায়মুক্তির কথা চিন্তা করত না, বরং কবিতাকে বিজ্ঞানের কল্পনায় রূপান্তরিত করে সৃষ্টির নেশায় মেতে থাকত। তারপরও তো রক্ত-মাংসের মানুষ তিনি, তবুও সুখ-দুঃখের মধ্যে নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলতেন না; বরং নিজেকে অন্ধকারের ভেতরে ঢুকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করতেন। আত্মজীবনীতে তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘গভীর দুঃখে কিংবা প্রচণ্ড আনন্দেই মানুষ কেবল কবিতা লেখে।’

যে ছেলেটা যুক্তরাষ্ট্রের ইউটার লোগান শহরে, রকি পাহাড়ের দুই হাজার মিটার উঁচুতে তুষারপাত দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছিল, সে একদিন ভেবেছিল, বড় হয়ে বরফ সরানোর কাজ করবে। অথচ পরিস্থিতি পালটে গেল, চাকাটা ঘুরে গেল কেমন করে যেন। বড় হয়ে মহাকর্ষ তরঙ্গ চেনালেন তিনি, পৃথিবী অবাক হলো। মৌলিক আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও তার ভাগ্যে জুটল। এত বড় বড় গবেষণা শেষে লোকটা এখন কবিতা লেখায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন, ছন্দে ছন্দে আনন্দে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। খুব বিনয়ের সঙ্গে বলছেন, বিজ্ঞানের চেয়েও কঠিন কবিতা লেখা। তবে এটাও বিশ্বাস করেন, কঠিনের ভেতর স্বপ্ন থাকে, কল্পনা থাকে, সৃষ্টিও লুকিয়ে থাকে।

জীবন থেমে গেলেও মানুষকে থেমে যেতে নেই। পৃথিবী থমকে দাঁড়ালেও জীবনকে থামাতে নেই। সবার মনে রাখা দরকার, এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে, এই দিনকে নিয়ে যেতে হবে সেই দিনেরই কাছে, যেখানে পরিস্থিতি পালটানোর সাহস থাকে, দেহের সব শক্তি হাতে এনে চাকা ঘোরানোর ইতিহাসটাও নতুন করে লেখা যায়।

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী : অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

 

সময় পরিস্থিতি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম