Logo
Logo
×

বাতায়ন

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়স্থল

Icon

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়স্থল

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত ও নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কার্যক্রম এখনো শুরু না হওয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমে অবনতি হচ্ছে। চলমান প্রেক্ষাপটে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে ও অর্থায়নে ভাসানচরে তাদের জন্য নতুন ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলো থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৯ সালের মার্চে জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন যে, এ দ্বীপ মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে না। রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হলে তা নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মার্চে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের ১৮ সদস্যের একটি দলকে ভাসানচরে চার দিনের সফরে নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিন দেখার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ‘মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার চাহিদার’ স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়। পরে ২০২১ সালের ১৮ মে ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা এবং সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হন। পরিদর্শন শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর ৯ অক্টোবর ২০২১ একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর ভাসানচরে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে। বর্তমানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন-জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপি ও অন্যান্য এনজিও সেখানে তাদের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ণ-৩ নামের এ প্রকল্প হাতে নেয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নৌবাহিনী সফলতার সঙ্গে এ প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেল্টার স্টেশন রয়েছে। ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে আছে ১২টি হাউজ। এখানে সব মিলে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবং প্রতিটি কক্ষে দুটি ডাবল বাংকার বা দোতলা খাট আছে, যাতে একটি পরিবারের চারজন থাকতে পারে। পরিবারে সদস্যসংখ্যা চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য দুটি কক্ষ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী, আবাসনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গা দরকার, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশি জায়গা রাখা হয়েছে। প্রতি আটটি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দুটি গোসলখানা রয়েছে, নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে, সেখানে সিলিন্ডারে এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। রান্নায় গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একটা এনজিও বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করছে। রান্নাঘর, গোসলখানা ও টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে। প্রতিটি হাউজের ওপর রয়েছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল।

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য আছে একটি করে শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে বড় ধরনের ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা মোকাবিলায় গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ভাসানচরে পাঁচ তলাবিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় হলেও টিকে থাকতে সক্ষম এ শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে কর্মরত ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসির প্রতিনিধি জানান, কিছু দিন আগে সাইক্লোন মোখার সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে ভাসানচরের সবাইকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছিল এবং তারা সবাই নিরাপদ ছিল। এটি ভাসানচরের জন্য একটি বড় অর্জন।

ভাসানচরে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ, এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার আছে। সেসব বাজারে নোয়াখালীর হাতিয়া ও অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করছে এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় পুকুর ও লেক কাটা হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখানে মাছ ধরে। মাছের চাষও হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে ১০ ফুট গভীর একটি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টার একই আকৃতিতে বানানো হয়েছে, সব ঘর দেখতে একই রকম। ঘরের পাশের অল্প ফাঁকা জায়গায় মহিলারা শাকসবজি চাষ করছে। প্রতিটি ঘরের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সব গ্রামে এত সুন্দর, মজবুত ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখা যায় না। প্রকল্পের ভেতরে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার আছে। এনজিওদের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গারা সব আবর্জনা সেখানে এনে জমা করছে। এর ফলে এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে এবং এ আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে তা কৃষিজমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসানচরে ৪৩২ একর জমিতে রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য বাঁধের ভেতর ৯১৮ একর এলাকা খালি রাখা হয়েছে।

ভাসানচরে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেড ক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর তুলনায় অনেক টেকসই ও উন্নতমানের। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোয় বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাসানচরকে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ১৭০২ একর জমির চারপাশে ৯ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে তীর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সে পাশেই শোর প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে। শোর প্রটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক শক্তিশালী ঝড় এ চরের ওপর দিয়ে গেলেও মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।

১৩,০০০ একরের এ দ্বীপে সারা বছর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষিজমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদামঘর, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, একটি পুলিশ স্টেশন, বিনোদন ও শিক্ষাকেন্দ্র, খেলার মাঠ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে। ভাসানচরে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে, পাইলট প্রকল্প আকারেই ভাউচারের মাধ্যমে এখন ৫০০০ রোহিঙ্গাকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবাইকে এ সুবিধার আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। সেখানে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের চেয়ে নিরাপদ আর স্বস্তিতে আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যা দেশের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে ভাসানচরের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং কক্সবাজারের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির সুবাতাস হিসাবে দেখছে। ভোর থেকেই ভাসানচরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের কেউ সাগরে কিংবা চরের ভেতরের পুকুর বা লেকে মাছ ধরতে যায়। কেউ ভ্যান কিংবা রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেউ তাদের জন্য বরাদ্দ কৃষিজমিতে চাষ করতে চলে আসে। কিছু রোহিঙ্গা তাদের পশু নিয়ে চড়াতে বের হয়। এক সময় জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ভাসানচরের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, আজ সেখানেই নিরাপদে উন্নত পরিবেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা; যা বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের এখন গবাদিপশু লালন-পালন, মাছধরা ও চাষাবাদের মতো জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আছে। ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলো সেলাই, পাটজাত পণ্য তৈরি, ব্লকের কাজ, স্কিন প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং আরও নানারকম ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার নিশ্চয়তা, মৌলিক অধিকার, নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ভাসানচরের স্কুলগুলো এখন কলরবমুখর, শিশুরা সকালবেলা সেখানে যাচ্ছে এবং সামনে তাদের কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে পরের ধাপে যাওয়ার জন্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে। সবশেষে বলা যায়, নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছাপিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এক টুকরো বাংলাদেশ এ ভাসানচর, এখন যা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়স্থল। (ভাসানচর থেকে ফিরে)

ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক

রোহিঙ্গা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম