উন্নয়নের স্বার্থে অর্থবছর পুনঃনির্ধারণ প্রয়োজন
মো. বেলায়েত হোসেন
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘অর্থবছর’ ধারণাটি বাজেটের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইতিহাসে প্রাচীন বা মধ্যযুগে বাজেট অথবা অর্থবছর বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও আধুনিক যুগে অর্থবছর ও বাজেট রাষ্ট্রপরিচালনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অর্থবছর হচ্ছে একটি দেশের এক বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, যেখানে থাকে সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের নির্দেশনা। এটি রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের কাছে এক ধরনের জবাবদিহিতা। এর মাধ্যমে জনগণ রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় সম্পর্কে জানতে পারে।
বর্তমানে কম-বেশি ৮০টি দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার প্রচলিত আছে বিশ্বজুড়ে। এ ছাড়া আছে ভারতীয় পঞ্জিকা ও হিজরি সালের হিসাব। বছরের শুরু-শেষ পরিবর্তন করতে না পারলেও অর্থবছরের বিষয়টি পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্র তার সুবিধাজনক সময়কে অর্থবছর হিসাবে নির্ধারণ করে নিতে পারে। গত কয়েক দশকে বহু দেশ প্রয়োজন অনুযায়ী এটি পরিবর্তন করেছে।
বিশ্বের একেক দেশে একেক সময় অর্থবছর শুরু হয়। বাংলাদেশ এখনো পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা অর্থবছরই অনুসরণ করছে। এখানে এক বছরের ১ জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থবছর ধরা হয়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিলে।
আমাদের প্রতিবেশী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতে অর্থবছর মোগল যুগ, এরপর ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এখন পর্যন্ত এপ্রিল-মার্চ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানে শাসকদের একচ্ছত্র সিদ্ধান্তে অর্থবছর করা হয় জুলাই-জুন, যা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে বিদ্যমান।
পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষি বা উৎপাদন মৌসুম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এর মূল কারণ, যা ছিল দূরত্ব ও আবহাওয়ার কারণে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সুবিধার্থে এপ্রিল-মার্চের স্থলে জুলাই-জুন অর্থবছর নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের কথা ভাবা হয়নি।
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ২৩৩টি দেশের মধ্যে ১৬৬ দেশের অর্থবছর হলো পঞ্জিকাবর্ষ (জানুয়ারি-ডিসেম্বর), ৩৬ দেশের এপ্রিল-মার্চ, ১৯ দেশের জুলাই-জুন এবং ১১ দেশের অক্টোবর-সেপ্টেম্বর। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে দেড় শতাধিক দেশের অর্থবছর শুরু হয় ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। অর্থাৎ জানুয়ারি মাসেই তাদের বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তানের অর্থবছর শুরু হয় ১ জুলাই থেকে। আর শেষ হয় ৩০ জুন।
১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর-এমন দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, রাশিয়া, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, স্পেন, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইডেন। এপ্রিলের প্রথম দিন বাজেটবর্ষ শুরু হয় ভারত, যুক্তরাজ্য, হংকং, কানাডা ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। শেষ হয় ৩১ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্র, কোস্টারিকা ও থাইল্যান্ডে অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর, আর শেষ হয় ৩০ সেপ্টেম্বর।
অনেক দেশ মাসের মধ্যবর্তী তারিখ থেকে অর্থবছর শুরু করে। এগুলোর মধ্যে ইরান ২১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ, ইথিওপিয়া ৮ জুলাই থেকে ৭ জুলাই। ইরানে অবশ্য হিজরি সন অনুযায়ী অর্থবছর হয়ে থাকে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। কোনো কোনো দেশ যেমন নেপাল (অর্থবছর চলে বিক্রম ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে, যা ১৬ জুলাই-১৫ জুলাই), ইরান (২১ মার্চ-২০ মার্চ), ইথিওপিয়া (৮ জুলাই-৭ জুলাই) মাসের মধ্যবর্তী তারিখ থেকে অর্থবছর শুরু করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটকেন্দ্রিক মতবিনিময় সভাগুলোয় অর্থবছরের মেয়াদ পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব আসে কয়েকবার। বিষয়টি পরীক্ষা-পর্যালোচনা করে অর্থবছর পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। তবে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। সেই সঙ্গে বাংলাবর্ষকে কেন্দ্র করার কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু সেই চিন্তাভাবনা আর বাস্তবতায় রূপ পায়নি। বাংলাদেশের মৌসুমি আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বার্ষিক কর্মযোজনার নিরিখে এটি স্পষ্ট যে, জুলাই-জুন অর্থবছর যথাযথ নয়। আমাদের দেশে মূলত মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর অবধি বৃষ্টি হয়। দেখা যায়, অর্থবছরের শেষে বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ শেষ করার তাগিদে কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানোর তাগিদে এবং ঠিকাদাররা বিল পেতে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করার জন্য মে-জুন মাসে দেশজুড়ে শুরু করে খোঁড়াখুঁড়ি।
শহরে পানির লাইন, স্যুয়ারেজ লাইন, নতুন রাস্তা, রাস্তা সংস্কারের কাজে খুব তড়িঘড়ি করে। গ্রামে দেখা যায়, মে-জুন মাসে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কাঁচা রাস্তায় নতুন মাটি দিয়ে সংস্কার কিংবা নতুন রাস্তার নির্মাণকাজ চলায় বৃষ্টির পানিতে হাঁটু সমান কাদা হয়ে রাস্তা চলাচলের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এতে সাধারণ মানুষের চলাচলেই শুধু চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় না, কাজটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। এতে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। শুধু কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অর্থবছরের বর্ষাকালীন ৪/৫টি মাস অর্থনীতির জন্য অনুকূল না হয়ে প্রতিকূল হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জুলাই মাসের প্রথম দিবসে অর্থবছর আরম্ভ হবে। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, জীবনযাপনের সময়চক্র, আর্থ-প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের আবহমান সংস্কৃতি বিবেচনায় অর্থবছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর বা এপ্রিল-মার্চ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথম মাসেই কাজ শুরু করে পরবর্তী ৪/৫ মাস বর্ষাকালে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে অক্টোবর-মার্চ-এই ছয় মাস পুরোটা সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করা সম্ভব হতে পারে। এতে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই অর্থবছরের বকেয়া সব কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের জন্য এ সময়টিই সব কাজের জন্য অনুকূল, সহনশীল ও উৎপাদনমুখী। সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্র ও মানুষের প্রয়োজনে তৈরি, সেহেতু প্রয়োজনে সময়ে সময়ে এটি সংশোধনের বিধানও আছে।
মহান স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও এমন প্রতিকূল একটি প্রথা প্রচলিত ও বহাল তবিয়তে আছে, যা শুধু নাগরিকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য নয়, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের অন্তরায়। এ নিয়ে অনেকেই আওয়াজ তুলেছেন বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে সফল হওয়া সম্ভব এবং তা উন্নত ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রয়োজনেই করা উচিত। স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার চারটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘স্মার্ট গভর্নেন্স’। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের উন্নয়নে সরকার ঘোষিত বাজেটের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকবে অর্থাৎ বাজেটের সঠিক ব্যবহার হবে। বাজেট/প্রকল্পের অপচয় রোধ এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রাক্কলিত বাজেটে কাজ শেষ করার কথাই স্মার্ট গভর্নেন্সের মূল ধারণায় বলা হয়েছে। মোদ্দাকথা, অর্থবহ অর্থবছর স্মার্ট গভর্নেন্সের অনুঘটক হিসাবে কাজ করবে। অর্থবছর পুনঃনির্ধারণ করা হলে যে বিশাল অঙ্কের টাকার অপচয় হতো, তা দেশের টেকসই উন্নয়নে ব্যয় করা যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
মো. বেলায়েত হোসেন : সহকারী তথ্য অফিসার
belayethussain42@gmail.com
