Logo
Logo
×

বাতায়ন

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাদ্যনিরাপত্তায় স্বস্তি

Icon

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাদ্যনিরাপত্তায় স্বস্তি

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট প্রতিবেদন-২০২২ (গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস) অনুযায়ী, বিশ্বের ৫৮টি দেশ ও অঞ্চল বর্তমানে খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা খাদ্যশস্যের জন্য কিছুটা আমদানিনির্ভর। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও এখানে বেশি, প্রায় ৯ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এশীয় ৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান চতুর্থ। অন্য তিনটি দেশ হচ্ছে শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মিয়ানমার। ২০২৩-২৪ সালে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ সময় খাদ্য সংকটের মধ্যে থাকা দেশগুলোর অবস্থা আরও নাজুক হতে পারে। কারণ, এল নিনোর প্রভাবে আবহাওয়া চরম আকার ধারণ করবে। বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে অতিষ্ঠ হবে জনজীবন। উন্নয়নশীল যেসব দেশ কৃষিকাজ ও মৎস্য ধরার ওপর নির্ভরশীল, তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড খরতাপে পুড়ছে ইউরোপ-আমেরিকা। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, চলতি বছর বা আগামী বছর বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। ফলে দারুণভাবে বিঘ্নিত হতে পারে কৃষি উৎপাদন। এরই মধ্যে অতি সম্প্রতি ‘রাশিয়া-ইউক্রেন কৃষ্ণসাগরীয় শস্য রপ্তানি চুক্তি’ স্থগিত ঘোষণা করেছে মস্কো। ফলে বিশ্ববাজারে গম সরবরাহ হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে নন বাসমতী চাল রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত। বিশ্ববাজারে এক-তৃতীয়াংশ চাল সরবরাহ আসে ভারত থেকে। ফলে আমদানিযোগ্য চালের ঘাটতি হবে, আরও বৃদ্ধি পাবে খাদ্যশস্যের মূল্য। তাতে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। তবে সেদিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থা আপাতত ভালো। কারণ, গত আমন মৌসুমে ধানের উৎপাদন খুবই ভালো হয়েছে। এবার বোরো ধানের উৎপাদনও বেশ আশাব্যঞ্জক। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ বলেছে, বাম্পার ফলন হয়েছে। সংস্থাটির ধারণা, প্রাক্কলিত বোরোর উৎপাদনের চেয়ে প্রকৃত উৎপাদন এবার বেশি হয়েছে। এবার কোনো খাদ্য সংকট থাকবে না।

দেশে এবার বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। এ জমির পরিমাণ ইতঃপূর্বে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৪৯ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর থেকে বেশি। গত আমন মৌসুমে ধানের দাম ভালো পাওয়ায় কৃষক চলতি বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ করেছে বেশি। গত বছর ৪৮ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ২ কোটি ২ লাখ টন চাল। এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল। কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এবার চাল উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ লাখ টন বেশি। তবে এবারের বোরো মৌসুমে দীর্ঘ খরা, জ্বালানি তেলের মূল্য ও পানি সেচের খরচ এবং রাসায়নিক সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষক বোরো ধান আবাদে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তাছাড়া ব্লাস্ট রোগের কারণেও বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে বোরো ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এবার বোরোর আবাদ কিছুটা বেশি হলেও মোট উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ২ কোটি ১৫ লাখ টনের বেশি হবে বলে মনে হয় না।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আউশ ধানের উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ টন চাল। আমনের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭০ লাখ টন চাল। এর সঙ্গে বোরোর উৎপাদন ২ কোটি ১৫ লাখ টন চাল যোগ করা হলে মোট চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৪ কোটি ১০ লাখ টন। রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলে হবে ন্যূনপক্ষে ৪ কোটি টন। খাদ্য চাহিদা সর্বোচ্চ ৩ কোটি টন চাল। এর সঙ্গে বীজ, অপচয় ও পশুখাদ্য বাবদ ২৫ শতাংশ যোগ করা হলে দেশের সর্বমোট চাহিদা দাঁড়ায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টন চাল। সেদিক থেকে বাংলাদেশ চালের উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তবে গমের ক্ষেত্রে আমাদের আমদানিনির্ভরতা প্রায় ৬০ লাখ টন এবং ভুট্টার ক্ষেত্রে প্রায় ২৫ লাখ। আন্তর্জাতিক বাজারে এ পণ্যগুলোর মূল্য বেশি হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে গম ও ভুট্টার আমদানি হয়েছে কম। তাতে অদূর ভবিষ্যতে চালের ওপর চাপ বাড়বে। বেশি করে মানুষ চাল ব্যবহার করবে খাদ্য ও পশুখাদ্য হিসাবে।

ইতোমধ্যেই খাদ্য মন্ত্রণালয় বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকারিভাবে সংগ্রহ শুরু হয়েছে ৭ মে থেকে। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এবার ৩০ টাকা কেজি দরে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে ৪ লাখ টন। আর ৪৪ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে সাড়ে ১২ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় প্রতি কেজি ধানে ২ টাকা এবং চালে ২ টাকা বেড়েছে সংগ্রহ মূল্য। উৎপাদন খরচ বিবেচনায় ধানে কোনো লাভ হবে না কৃষকের। চালে লাভ হবে প্রতি কেজি প্রায় ৩ টাকা। তাতে লাভবান হবে ব্যবসায়ীরা, যারা সরকারি খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ করেন।

এবার ১৭ জুলাই পর্যন্ত ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৪৬ টন। চাল সংগ্রহের পরিমাণ ৮ লাখ ৬০ হাজার ৫০ টন। ধানকে চালের আকারে রূপান্তরের পর মোট সংগ্রহ দাঁড়ায় ৯ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টন। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়তো সম্ভব হবে।

গত অর্থবছর (২০২২-২৩) ৪৯ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন এবং গম ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। এর আগের বছর (২০২১-২২) মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে ছিল চাল ৯.৯ লাখ এবং গম ৪০.১ লাখ টন। গত ১৭ জুলাই পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ মজুত রয়েছে চাল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২ টন এবং গম ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৭ টন। ধানের মজুত ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৭ টন যোগ করে মোট খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৮ টন। এটি ন্যূনপক্ষে ২৫ লাখ টন হওয়া উচিত। সরকারের ধান/চাল সংগ্রহ অভিযান সফল হলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকেই বাকি প্রায় ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এবার সরকারের গম সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ টন। প্রতি কেজি ৩৫ টাকা মূল্যে তা কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব মিলে দেশের খাদ্যশস্য সরবরাহ পরিস্থিতি এবার সন্তোষজনক বলা যায়। চলতি আউশ এবং আগামী আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন ভালো হলে খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো ব্যাঘাত হবে না।

স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। বিগত ৫২ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষক আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন প্রায় স্বয়ম্ভর। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তাছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান কখনো প্রথম, আবার কখনো দ্বিতীয়। সবজি উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ, গমের উৎপাদন ২ গুণ, ভুট্টার ১০ গুণ, ফলের উৎপাদন ৩ গুণ ও শাকসবজির উৎপাদন বেড়েছে ৫ গুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন প্রভূত উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর এ দেশে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কম বেশি ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এর জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।

ড. জাহাঙ্গীর আলম : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অফ ইকনোমিকস; সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অফ গ্লোবাল ভিলেজ

কৃষি উৎপাদন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম