পাটের উৎপাদন বাড়ানোর একটি উপায়
ড. মোহাম্মদ শাহীন পলান
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাট বাংলাদেশের দ্বিতীয় অর্থকরী ফসল। বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম। ২০২২-২৩ সালে দেশের ৭.৪২ লাখ হেক্টর জমিতে ১৪.৯৪ লাখ টন পাট উৎপাদন হয়েছে। পাটের এ উৎপাদন বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেসব কারণে পাটের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো কীটপতঙ্গের আক্রমণ। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ প্রজাতির পোকামাকড় পাট ফসলের ক্ষতি করে থাকে বলে বিবেচিত। হলুদ মাকড় তাদের মধ্যে অতিপরিচিত এবং খুবই ক্ষতিকর একটি বালাই।
পূর্ণাঙ্গ মাকড় আকারে খুবই ক্ষুদ্র (০.১৭ মিলিমিটার লম্বা ও ০.০৯ মিলিমিটার চওড়া) এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী মাকড় কচিপাতার উলটোদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একটা একটা করে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার ৩১ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়, এদের লার্ভা বলে। লার্ভা ঘোলাটে সাদা রঙের। এরা লার্ভা অবস্থায় ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা থাকে। ক্রমে ক্রমে আকারে বড় হয় এবং খোলস বদলিয়ে পিউপা হয়। ১২ থেকে ১৭ ঘণ্টা পরে এরা পূর্ণবয়স্ক মাকড়ে পরিণত হয়। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মাকড় ৫ থেকে ৯ দিন এবং স্ত্রী মাকড় ৮ থেকে ১৩ দিন বাঁচে। সাধারণত স্ত্রী মাকড় দিনে ৮টি ডিম পাড়ে এবং তাদের জীবদ্দশায় ২৪ থেকে ৭৪টি ডিম দেয় এবং সমগ্র পাট মৌসুমে এরা প্রায় ২৯ বার প্রজনন করে।
হলুদ মাকড় পাটগাছে আগার কচিপাতা আক্রমণ করে পাতার রস চুষে খায়। এতে কচিপাতা কুঁকড়ে যায় এবং তামাটে রং ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত সব আক্রান্ত পাতা পড়ে যায়, এমনকি গাছের ডগা মারাও যায়। এর ফলে শাখা-প্রশাখা বের হয়ে গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। হলুদ মাকড়ের আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি ১৫-৬০ সেন্টিমিটার কমে যেতে পারে। এ মাকড়ের আক্রমণে মাঠ পর্যায়ে পাটের ফলন ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। হলুদ মাকড় ফুলের কুঁড়ি ও কচি ফলকেও আক্রমণ করে। আক্রান্ত কুঁড়ি ঠিকমতো ফুটতে পারে না। ফুলের পাপড়ির রং হলদে থেকে কালচে হয়ে যায় এবং পরে ঝরে পড়ে। এতে বীজের ফলন কমে যায়। একটানা খরা/অনাবৃষ্টির সময় হলুদ মাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যায়। হলুদ মাকড়ের আক্রমণের তীব্রতার কারণে ৩ থেকে ৮ মন পর্যন্ত পাটের ফলন কম হয়।
এ মাকড় বিভিন্নভাবে দমন করা যায়। পরিবেশে অনেক উপকারী পোকা আছে, যারা এ হলুদ মাকড়ের উপদ্রব কমাতে পারে। যেসব উপকারী পোকা প্রাকৃতিকভাবে মাকড় দমন করে, তাদের মধ্যে Minute Pirate bug (Orius inssidiosus), Mirid bug (Cyrtorhinus lividipennis), Predatory mite (Amblysieus sp.), Ladz bird beetle (Stethorus sp.) Thrips (Scolothrips indicus), Tarnished bug (Adelphocoris sp.), Red bug (Boisea trivittata)-এ ছয়টি Predator (শিকারি পোকা) পোকার নাম উল্লেখযোগ্য। এরা হলুদ মাকড় খেয়ে তাদের সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
রাসায়নিক মাকড়নাশক যেমন এবামেকটিন ১.৮ ইসি, সালফার ৮০ ডব্লিউপি দ্বারা হলুদ মাকড় দমন করা যায়। কিন্তু রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করার ফলে উপকারী পোকাগুলোও মারা যায়। এতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অপরদিকে প্রাকৃতিক বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ নির্যাস দিয়ে হলুদ মাকড় দমন করা যায়। উদ্ভিজ্জ নির্যাসের মধ্যে নিমপাতা ও বীজের নির্যাস ব্যবহার করে প্রায় ৭২ শতাংশ পাটের হলুদ মাকড় দমন করা সম্ভব, যাতে একদিকে হলুদ মাকড় দমন হয়, অন্যদিকে পরিবেশের ওপর তেমন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। নিমপাতা ও বীজের নির্যাস দিয়ে পাটের হলুদ মাকড় দমনের প্রযুক্তি বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিবেশবান্ধব দুটি প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তিগুলোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো-১. এটি কৃষকের জন্য সহজলভ্য, ২. ব্যবহার পদ্ধতি খুবই সহজ, ৩. পরিবেশবান্ধব এবং ৪. অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক।
নিমপাতা ও বীজের নির্যাস প্রস্তুত প্রণালি : গাছ থেকে কাঁচা নিমপাতা সংগ্রহ করে হামান দিস্তা/শীল পাটা/গ্রাইন্ডারের সাহায্যে পেস্ট তৈরি করতে হবে। তারপর নিমপাতার পেস্ট পানিতে ১:২০ অনুপাতে (৫০ গ্রাম পাতা ১ লিটার পানিতে) মিশিয়ে নির্যাস তৈরি করতে হবে। তারপর নির্যাসটি ছাকনি দিয়ে ছেঁকে নিয়ে মাকড় আক্রান্ত পাটক্ষেতে কচিপাতার উলটোদিকে ছিটাতে হবে। অপরদিকে, নিম বীজের নির্যাস তৈরি করার জন্যা নিম ফল সংগ্রহ করে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে, যাতে সহজে বীজের খোসা দূরীভূত হয়। বীজের খোসা দূরীভূত হওয়ার পর বীজের কার্নেল বাতাসে ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে হামান দিস্তা/শীল পাটা/গ্রাইন্ডারের সাহায্যে পাউডার তৈরি করতে হবে। তারপর বীজের কার্নেল পাউডার পানিতে ১:২০ অনুপাতে (৫০ গ্রাম পাউডার ১ লিটার পানিতে) সারারাত ভিজিয়ে রাখলে নিম বীজের নির্যাস তৈরি হবে। তারপর নির্যাসটি ছাকনি দিয়ে ছেঁকে আক্রান্ত পাট পাতায় প্রয়োগ করতে হবে।
নিমের নির্যাসের কার্যকর উপাদান হলো-১. অ্যাজাডিরেকটিন, ২. স্যালানিন, ৩. ম্যালিয়েন্ট্রেয়াল, ৪. নিম্বিন, ৫. নিম্বিডিন। এগুলোর মধ্যে অ্যাজাডিরেকটিনের কার্যকারিতাই বেশি।
প্রযুক্তির উপযোগিতা : ১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ঘোষিত সবচেয়ে গুণসর্বস্ব ভেষজ বৃক্ষ হলো নিম। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এ গাছ সহজেই পাওয়া যায়। রাসায়নিক মাকড়নাশকের বদলে নিমপাতা বা বীজের নির্যাস দ্বারা সহজেই হলুদ মাকড় দমন করা যায়। ২. হলুদ মাকড় আক্রান্ত গাছের ডগার কচিপাতার উলটোদিকে নিমপাতা বা বীজের নির্যাস সরাসরি স্প্রে করলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। ৩. পাটচাষ উপযোগী বাংলাদেশের অঞ্চলগুলোয় এ প্রযুক্তি খুবই কার্যকর। ৪. এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পরিবেশের এবং উপকারী পোকার ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। এবং ৫. এ প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষকের কোনো ঝুঁকি নেই।
প্রযুক্তির আর্থিক সুবিধা এবং জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা : ১. নিমপাতা বা বীজ সংগ্রহ ও নির্যাস তৈরির খরচ : পাতা বা বীজ সংগ্রহ ও নির্যাস তৈরি বাবদ খরচ (একজন শ্রমিক) ৬০০ টাকা; প্রথমবার স্প্রে (দুজন শ্রমিক) : ১২০০ টাকা; দ্বিতীয়বার স্প্রে (দুজন শ্রমিক) : ১২০০ টাকা। মোট ৩০০০ টাকা। ২. এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের ফলে প্রতি হেক্টরে আট মন পাট ফলন বেশি পাওয়া যায়, যার বর্তমান মূল্য ৩০০০x৮=২৪০০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি হেক্টরে লাভ (২৪০০০-৩০০০)=২১০০০ টাকা। ৩. কৃষকের মাঠে হলুদ মাকড় আক্রান্ত গাছের ডগার কচিপাতার উলটোদিকে নিমপাতা অথবা নিম বীজের নির্যাস সরাসরি স্প্রে করে প্রায় ৭২ শতাংশ হলুদ মাকড় দমন করা সম্ভব এবং এতে প্রায় ১২-২০ শতাংশ পাটের আঁশের ফলন বৃদ্ধি পায়।
ড. মোহাম্মদ শাহীন পলান : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, কীটতত্ত্ব শাখা, পেস্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা
