|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মণিপুরের ঘটনা বহুমাত্রিক, তার একটা কোনো দিকে জোর দিলে হয়তো তা বিপজ্জনক হবে; কিন্তু আবার কোনোটার গুরুত্বকেই খাটো করে দেখা চলবে না।
অবশ্যই ৪ মে দুটি কুকি নারীকে গণধর্ষণ এবং তাদের বিবস্ত্র করে পথে হাঁটানোর বীভৎস, অমানবিক এবং পৃথিবীর কাছে ‘মেরা ভারত মহান্’ এ বাহবাস্ফোটকে নর্দমার কদর্য পঙ্কস্রোতে ডুবিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা দেশের (এবং সারা পৃথিবীর) মানুষকে গ্লানি, লজ্জা আর বিস্ময়ে উত্তাল করে তুলেছে এবং এ ঘটনার কলঙ্ক আমাদের কাছে চিরস্থায়ী হয়ে রইল। ভারতে নারী ধর্ষণ প্রায়ই ঘটে এটি ঠিকই, নারী ধর্ষণের রাজধানীই বলা যায় এ দেশকে, কিন্তু এ পৈশাচিক মাত্রার ধর্ষণ আর অত্যাচার, আমাদের দেশের গৌরব যদি কিছু থাকে, তাতে বিষ্ঠালেপন করেছে।
অবশ্যই এ ঘটনার মূলে আছে জাতি অর্থাৎ নৃগোষ্ঠী বিদ্বেষ। মণিপুরে যারা প্রধান নৃগোষ্ঠী তারা মেইতেই, তারা ধর্মে হিন্দু, বৈষ্ণব। মূলত চৈতন্য-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুসারী। তারা মণিপুরী ভাষা বলেন, সে ভাষার লিপি এতদিন বাংলাই ছিল, এখন সম্ভবত তারা আস্তে আস্তে নিজেদের লিপি গ্রহণের দিকে এগোচ্ছেন। তাতে বাঙালির দুঃখ করার কিছু নেই। বাঙালি বৈষ্ণব সংস্কৃতির কাছাকাছি হলেও তারা মানবগোত্রের দিকে থেকে মঙ্গোলীয়, অর্থাৎ ওই অঞ্চলের কুকি, নাগা, বড়ো ও ত্রিপুরীদের সগোত্র। মণিপুরী মেইতেইরা হিন্দু, কিন্তু কুকি আর নাগারা বহুলাংশে খ্রিষ্টান। মেইতেইরা মণিপুরের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ, শতকরা সাতান্ন ভাগের মতো, বাকিরা, অর্থাৎ কুকি ও নাগারে ৪৩ শতাংশ, আর কুকিরা আবার দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এবারের দাঙ্গা ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক কারণে নয়, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে যা ঘটে বা ঘটানোর চেষ্টা চালানো হয়, তেমনই। এ দাঙ্গা জাতিগত বা ‘এথনিক’ এবং তারই প্রতিক্রিয়ায় আঘাত ও হত্যা, সম্পত্তি ধ্বংস, ত্রাণশিবির, রাজ্যের সীমানা থেকে বিতাড়ন, রাজ্যের সীমানা ছেড়ে পলায়ন এবং সব যুদ্ধ ও দাঙ্গায় যাকে নরম লক্ষ্য বা ‘সফ্ট টার্গেট’ বলে-তা হয় নারী ও শিশুরা। মণিপুরে শিশুদের খবর কেউ রাখেনি, কিন্তু নারীদের খবর আমাদের পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে দিয়েছে।
কেন এ দাঙ্গা? বাইরে থেকে মানুষের পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল। বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকলেই দাঙ্গা হবে, ‘আমরা’ আর ‘তোমরা’ কোনো দিন মিলবে না-এ হলো হতাশের কথা। এটি ঠিক যে, আমি যতদূর জেনেছি, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশ আপাতত শান্ত হলেও, সেখানে নানা অশান্তির অন্তঃস্রোত ছিল। এখানে হয় কোনো বিদেশি শক্তি, না হয় বিশ্বব্যাপী ড্রাগ আর চোরা অস্ত্রের বাজার সক্রিয়, তারা, হয়তো বিদেশি শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে এখানে একটা অস্থির অবস্থা জিইয়ে রাখার চেষ্টায় ছিল, সেটাতেই হয়তো একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে। মিয়ানমারের উদ্বাস্তুরাও তাতে যুক্ত হয়েছে পার্শ্বিকভাবে। কিন্তু তা কখনো এবারের মতো হাতের বাইরে যায়নি। আমি এ শতাব্দীর গোড়ার বছরগুলোতে বহুবার মণিপুরে গেছি। সেখানে আপাতত শান্তির আড়ালে উত্তেজনার আভাস পেয়েছি। শুনেছি যে, ফেরারি বিদ্রোহীরা মন্ত্রী, ব্যবসায়ী আর নানা শাঁসালো চাকরিজীবীর কাছে মাসিক তোলা আদায় করে, সেই তোলার বিনিময়ে তারা তাদের জীবনযাপনের স্বস্তি কেনে। ভারতীয় সৈন্যদের অত্যাচারের খবরও আমরা পড়েছি, মণিপুরে নারীদের অভিনব প্রতিবাদ বা ইরম শর্মিলা চানুর দীর্ঘস্থায়ী অনশনের কথা। সেগুলো এসেছে, আবার চলেও গেছে। তাহলে এ তীব্র, আত্মঘাতী বিস্ফোরণটা ঘটল কেন? যা এখনো থামছে না? এই এতদিনেও? এর পেছনে কাদের হাত আছে? শুধু বিদেশি শক্তি আর ভেতরকার বিদ্রোহীদের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত থাকব? এখনকার সরকারের কি কোনো দায়ই নেই? অনেকেই সুনিশ্চিত যে, একটা নিগূঢ় পূর্বপরিকল্পনা করে এ দাঙ্গা বাধানো হয়েছে। এ পরিকল্পনার পেছনে বর্তমান সরকারের কি কোনো হাত ছিল? দাঙ্গা দমনে তার হতবুদ্ধি আর নিরুপায় অবস্থা দেখে এক ধরনের ইচ্ছাকৃত উদাসীনতার সন্দেহ করছে কেউ কেউ, তার মূলে কি কোনো সত্য আছে? ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন রাজ্যকে দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে (‘রাজধর্ম পালন’ কথাটা আপনাদের মনে পড়বে) বাধ্য করলেন না, তা-ও যেমন বিস্ময়ের, তেমনই বিস্ময়ের ওপরে আরও প্রচণ্ড এবং চূড়ান্ত বিস্ময়ের ঘটনা হলো ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৭৭ দিন স্থায়ী নৈঃশব্দ্য। এর মধ্যে তিনি দেশ-বিদেশে (ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিসর) গেছেন, রাষ্ট্রপ্রধানদের হাসিমুখে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু দেশে বা বিদেশে মণিপুর নিয়ে একটা কথা বলেননি। দাঙ্গা নিয়ে না, নারী ধর্ষণ নিয়ে না। নারী ধর্ষণের খবর আগে তার বশংবদ খবর-বরদাররা তাকে জানায়নি, এ তো হতে পারে না। শুধু বিষয়টি যখন জনসমক্ষে চাউর হলো, আর গোপন রাখা সম্ভব হলো না, তখনই তিনি তার পবিত্র ও প্রজ্জ্বলিত ক্রোধ প্রকাশ করলেন, বললেন, অপরাধীরা ক্ষমা পাবে না। ওই ইতর অপরাধীরা কী শাস্তি পায় শেষ পর্যন্ত, তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকব। পাঠকরাও লক্ষ রাখুন। আজকের কাগজে (২৭ জুলাই) দেখলাম তিনি দিল্লিতে অনুভব মণ্ডপ নাকি একটা কনভেনশন সেন্টার উদ্বোধন করতে গিয়ে সাড়ম্বরে পুজো দিয়েছেন, আর হিন্দিতে কবিতা আউড়েছেন, যে কবিতার মূল কথা হলো-‘দেশে নতুন প্রভাত, নতুন বাণী, নতুন আলো, নতুন উদ্ভাস, নতুন আশা-আকাক্সক্ষা, নতুন ঢেউ, নতুন প্রাণ, নতুন স্ফূর্তি’ ইত্যাদি। বলাবাহুল্য, সারা দেশ গভীর অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অনেকের মনে পড়বে রোম যখন পুড়ছিল, তখন রোমের সম্রাট নিরোর বেহালা বাজানোর কথা।
দাঙ্গার কারণের একটা ওপরকার ব্যাখ্যা দেওয়াই যেতে পারে যে, নানা গোষ্ঠী থাকলেই এবং প্রশাসন দুর্বল বা পক্ষপাতী হলেই, দাঙ্গা হবে। এটা সোজাসুজি ‘টং’ আর ‘Them’-এর ব্যাপার। তার বাইরেও কি কিছু আছে? হোয়াট্সঅ্যাপে একটি আলোচনা ছড়াচ্ছে, তা হয়তো পাঠকরাও কেউ কেউ লক্ষ করেছেন। তা হলো মণিপুরে প্রচুর খনিজসম্পদ আছে মাটির নিচে। এ মাটির অধিকার মণিপুরের মানুষের, আইন হলো যে, বাইরের কেউ এসে উত্তর-পুব ভারতের আদিবাসী-উপজাতিদের জমি কিনতে পারবে না। কিন্তু কোনো একটা ছুঁতো করে যদি জমির এখনকার মালিকদের উৎখাত করা যায়, তাহলে তো ওই জমি সরকারের হাতে আসবে। আর সরকার তখন তার উত্তর বা পশ্চিম ভারতীয় শিল্পপতি বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানাতেই পারে বিনিয়োগের জন্য; অবশ্যই তার বিনিময়ে সরকারও কিছু পাবে, সরকারে নিযুক্ত ব্যক্তিরাও পাবে। আমি জানি না, এ বক্তব্য অতি ক্ষুদ্র অংশেও সত্য কিনা। সত্য হলে ভয়ানক ব্যাপার।
পাঠকদের বলেছি, আমি মণিপুরে নানা কাজে বহুবার গেছি, তাদের সৌজন্য আর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। প্রয়াত লেখক নীলকান্ত সিংয়ের স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার পরে তার বাড়িতে আমাকে থালার পাশে পঁয়ত্রিশটি বাটিতে নানা ব্যঞ্জন পরিবেশন করা হয়েছিল। এ রাজ্য কঠোর সাধনা ও বিপুল প্রতিভার উৎস। মণিপুরী মা আর শর্মিলারা তো আছেনই; কিন্তু সেই সঙ্গে আছে বিশ্বনন্দিত মণিপুরী নাচ (যার বিস্তারে রবীন্দ্রনাথের দানের কথা তারা এখনো ভোলেনি), আছে বিপুল কবিতা ও সাহিত্য, আছে চিত্রকলা, আছে কান্হাইয়াল, সাবিত্রী হেসনান, রতন থিয়মের মতো নাট্যস্রষ্টা। ওই অঞ্চলে একসময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ছিল, সেদিনও নারীদের শক্তি ও মর্যাদা দেখে এসেছি, ইম্ফলে শুধু মেয়েদের পরিচালিত ‘মা বাজার’ তার প্রমাণ।
সেখানে কী করে দাঙ্গা আর নারীর ওপর এ পৈশাচিক নির্যাতন ঘটে, কোন্ প্রবল প্ররোচনা কাজ করে তা অবিলম্বে উদ্ঘাটিত হওয়া দরকার। কারণ, আজই আমরা অন্যত্র যেমন বলেছি, মণিপুরের অস্তিত্ব ভারতের জাতীয় অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। নানা ধর্ম, নানা নৃগোষ্ঠী, নানা মানবিক আত্মপরিচয় নিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিনা-সেটাই ভারতের গণতান্ত্রিক অস্তিত্বের মূল পরীক্ষা। এ পরীক্ষার ব্যাপারটি সারা পৃথিবী লক্ষ করছে; কারণ, সারা পৃথিবীতে দেশগুলো আর একরঙা, একমাত্রিক থাকছে না। দেশ-বিদেশ থেকে উদ্বাস্তু আর অভিবাসীর দল গিয়ে দেশগুলোর এক ভাষা, এক রং, এক সংস্কৃতি, এক ধর্মের মধ্য আরও কত ভাষা, রং, ধর্ম, সংস্কৃতি যোগ করছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা তাদের জাতীয় চরিত্র কী হতে চলেছে তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন। সেখানে ভারত হাজার বছর ধরে, নানা ঐতিহাসিক এবং কবিদের ভাষায় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের’ সাধনা করে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ তার সুরটি বেঁধে দিয়েছেন আমাদের জাতীয় সংগীতে। সেই ভারত কি এবার ব্যর্থ হবে তার সাধনায়? শাসকদের স্বার্থপর মূঢ়তা আর উদাসীনতায়?
যে দেশগুলোতে বহু গোষ্ঠী আছে বা তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী থাকতেই পারে, ভারতে বা বাংলাদেশে বা আমেরিকায় যেমন আছে। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের পবিত্র দায় হচ্ছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া আর তাদের স্বার্থরক্ষা করে। অপরাধী সব গোষ্ঠীতেই থাকে। কিন্তু অপরাধীদের ব্যবস্থা নেওয়া মানে গোষ্ঠীকে দায়ী করা নয়। এ সত্যটা বোঝার জন্য আমাদের আর কত ক্ষতি স্বীকার করতে হবে, কে জানে?
মণিপুরের ভবিষ্যতের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জাতীয় অস্তিত্বের।
পবিত্র সরকার : খ্যাতনামা ভারতীয় লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
