দেশে ‘আদিবাসী’ বিতর্কের সমাধান হওয়া উচিত
ড. মো. রফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
৯ আগস্ট ছিল বিশ্ব আদিবাসী দিবস। বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুরক্ষার জন্য প্রতিবছর ৯ আগস্ট বিশ্বে এ দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেও এ দিবসটি বিভিন্ন সংগঠন পালন করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে এক প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে বলা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করা হয়, কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর আগেও ২০১০ সালে আরেকটি প্রজ্ঞাপনে একই বিষয়ের অবতারণা করা হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা ২০০০ সালে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে ‘বিশ্ব আদিবাসী’ দিবস পালন শুরু করেন। পরে তারা দেশের সমতলের বিভিন্ন উপজাতীয় ও তফশিলি জনগোষ্ঠীকেও এতে শামিল করে ৪৫টি মতান্তরে ৭৫টি জনগোষ্ঠীকে একত্রে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বীকৃতি দাবি করেন। কিন্তু বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর এ আদিবাসী দাবি শুরুতেই দেশে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। এ লেখায় আদিবাসীসংক্রান্ত এ বিতর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এখন দেখা যাক, আদিবাসী কারা, বা শব্দগত অর্থ কী? অভিবাসীর বিপরীত শব্দ আদিবাসী। আন্তর্জাতিক অভিবাসন হলো, যখন মানুষ নিজ রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে এবং গন্তব্য দেশে ন্যূনতম সময়ের জন্য অবস্থান করে। আবার আদি শব্দের অর্থ প্রথম, আর বাসী শব্দের অর্থ বাসিন্দা; অর্থাৎ ‘আদিবাসী’ শব্দের অর্থ হলো যারা প্রথম থেকেই বসবাস করে আসছে। আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ Indigenous people. আদিবাসীবিষয়ক সংজ্ঞাটি হলো ‘আদিবাসী’ তারা, যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছেন বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির শুরু থেকে বসবাস করছেন; এবং যারা তাদের কিছু বা সব নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে রাখে। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী, যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই। আভিধানিক সংজ্ঞানুসারে কোনো দেশ বা স্থানের আদিম অধিবাসী বা অতিপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসরত জনগোষ্ঠীই ওই অঞ্চলের আদিবাসী।’
আদিবাসী বিষয়টি নির্ধারিত হয় সম্পূর্ণ ভূখণ্ডের ওপর, আবার বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক। যেমন, ভাওয়াল রাজার পরগনাখ্যাত গাজীপুরে অন্তত তিন ধরনের মানুষ বসবাস করে। প্রথমত, শত শত বছর আগে থেকে যেসব মানুষ বসবাস করছে, তারা ওই অঞ্চলের আদিবাসী। সমগ্র বাংলাদেশকে ভূখণ্ড ধরা হলে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্য জাতি। তখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চাকমা, মারমা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারোরই অস্তিত্ব ছিল না। যদিও এখন আর্য জাতির অস্তিত্ব নেই। এজন্যই বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আদিবাসী বা আদি-বাসিন্দাদের উত্তরসূরি হওয়ার প্রথম দাবিদার এ দেশের কৃষক সম্প্রদায়। যারা বংশপরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। আদিবাসীর আভিধানিক সংজ্ঞানুসারে সেই অর্থে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত বাঙালিরাই আদিবাসী। বর্তমানে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বিভিন্ন সময় আগত অন্যান্য নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অধিবাসী বটে, আদিবাসী নন।
আদিবাসীসংক্রান্ত দুটি কনভেনশন, একটি জাতিসংঘ ও আরেকটি আইএলও কর্তৃক প্রণীত হয়েছে। আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত-Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169), এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে The United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples. এ দুটি কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। তবে কনভেনশন দুটি যেভাবে আদিবাসীদের সংজ্ঞা প্রদান করেছে, তা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে ও সুবিধামতো ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, Indigenous and Tribal Peoples Convention, 1989 (No. 169)-এর আর্টিকেল ১-এর (a)-তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদের উপজাতি বলা হয়।’ বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী যেমন-চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ইতিহাস ৫০০ বছরের বেশি নয়। যদিও তারা ওই অঞ্চলে প্রথম থেকে বসবাস করে আসছেন। বাংলাদেশে যারা আদিবাসী হিসাবে এতদিন পরিগণিত হয়ে আসছিলেন, তারা আদতে বার্মিজ রাজাদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন এবং ১৪০০ সালে রাজা ম্রো ইউর সময় থেকে নানা কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত বাংলায় শরণার্থী হিসাবে আগমন করেন এবং তৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স দ্বারা পুনর্বাসিত হয়ে এ অঞ্চলে বসবাস করেন। জাতিসংঘ ও আইএলও কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুসারে তারা পার্বত্য অঞ্চলে আদি বাসিন্দা। কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক হিসাবে তারা আদিবাসী নন।
আদিবাসীসংক্রান্ত আলোচনা নৃবিজ্ঞানের একটি মূল উপজীব্য বিষয়। নৃবিজ্ঞানে ‘আদিবাসী’ ও ‘আদিবাসিন্দা’ এ দুটি শব্দ বহুল আলোচিত ও পঠিত। আদিবাসী হলো তারা, যারা ঐতিহাসিকভাবে কোনো স্থানে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ধর্ম ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বসবাস করেন। আর আদিবাসিন্দা হলেন তারা, যারা কোনো কোনো স্থানে শুরু থেকে বসতি স্থাপন করছেন, যাদের একই ধরনের অথবা ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায় ওই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা দাবি করতে পারে, কিন্তু আদিবাসী দাবি করাটা প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার সরকারিভাবে পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। অনেক নৃ-বিজ্ঞানীও পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বলে আখ্যা দেন।
বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চার হাজার বছরের পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবারত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ১৬ শতকে ভারত, মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে আসা শুরু করে। তাছাড়া সব ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করছেন না। সেজন্য তারা সেখানকার আদিবাসী নন। আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, আদিবাসী হতে হলে কলোনিয়াল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কলোনাইজেশন হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কিছুই হয়নি। যদি আইএলও ও জাতিসংঘের সংজ্ঞাও বিবেচনা করা হয়, তাহলেও তারা আদিবাসী নন, ওই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা।
আদিবাসী বিতর্ক নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনা আছে এবং থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা আদিবাসী দাবি করে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সভা, সেমিনারসহ অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করে চলেছে। তাদের দাবির সঙ্গে সুশীল সমাজ ও একাডেমিশিয়ানদের অনেকে সহমত পোষণ করেন। তবে বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির ভিত্তিতে কতিপয় গোষ্ঠীকে যদি আদিবাসী বলে আখ্যা দেওয়া হয়, তাহলে সমাজের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মর্যাদা কী হবে সেটা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে সব জাতি-গোষ্ঠীর সমান সম্মান ও সুযোগ তৈরি করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বর্তমান সরকার এ লক্ষ্যকে সামনে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আদিবাসী বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের মানবিক অধিকার সমুন্নত রাখা আমাদের সবার কর্তব্য। বাংলাদেশ সরকার সব জাতি-গোষ্ঠীকে ধারণ করে দেশ পরিচালনা করবে, এটা আমাদের সবার প্রত্যাশা।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, শান্তি সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
