চেতনায় বুদ্বুদ
১৫ আগস্ট এবং এর আগে ও পরে
বদিউর রহমান
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আগস্ট মাসটাই বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল। পাকিস্তান আমলে আমরা ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করতাম, ভারত করত ১৫ আগস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে মোটা দাগে তিন-তিনটি ঘটনায় আগস্ট খ্যাত থেকে কুখ্যাত হয়ে গেল। এ মাসে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হলো। তখন টের পাওয়া গেল বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী গ্রুপ কত শক্তিশালী।
এতে আরও প্রমাণ হলো যে, বিএনপি সরকার জঙ্গি পোষণে বেশ এগিয়ে। অবশ্য শায়েখ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাইয়ের কাজকর্মে তা বেশ আগেই টের পাওয়া গেল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সেই আমলটাই এক ভিন্নরূপের বাংলাদেশ হিসাবে দেখলাম আমরা। দশ ট্রাক অস্ত্র খালাস তো আরও পরিষ্কার করে দিল আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছি এবং তখনকার শিল্পমন্ত্রী নিজামী যেভাবে শিল্প সচিব নূরুল আমিনকে বোবা বানিয়ে দিলেন-তাও আমাদের অবাক করল। ধরতে গেলে পুরো দেশটাই তখন জঙ্গি প্রভাবে প্রভাবান্বিত। কিন্তু আগস্টের মূল ঘটনা ১৫ আগস্ট, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। ২১ আগস্টের গ্রেডেন হামলায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা তো মূলত ১৫ আগস্টেরই ধারাবাহিকতা। জার্মানিতে থাকায় হাসিনা-রেহানা যে বেঁচে গেলেন, এটা হত্যাকারীদের কাছে অসহ্য। অতএব, বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যার কত চেষ্টা! আমরা এখনো বিশ্বাস করি যে, সুযোগ পেলেই শেখ হাসিনা এবং রেহানাকে ওরা মেরে ফেলবে। তারা জানে, শেখের রক্ত কত ভয়ানক হতে পারে তাদের জন্য। কপালগুণে বেঁচে যাওয়া এক শেখ হাসিনাকে মারতে না পেরেই তারা এখন কী ভীষণ বেকায়দায়!
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কত বড় প্রস্তুতি। আমরা তখনও হল ছাড়িনি। এ অনুষ্ঠান শেষে হল ত্যাগ করব। সকাল ৮টার দিকে আমরা প্রথম শুনলাম যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। রেডিওতে ডালিম ঘোষণা দিচ্ছে বিশ্রী ভাষায়। এসএম হলের ওয়েস্ট হাউজের বারান্দায় ছাত্রলীগের শাহ আলম মল্লিককে ছুটতে দেখলাম। ফারুককে খুঁজতে গিয়েও পেলাম না। ইস্ট হাউজে গিয়ে আতাউর রহমানকে পেলাম, ওর বিকালে হল ত্যাগের কথা ছিল। ঢালি, জাহিদকেও দেখলাম না। মাসুদকেও পেলাম না। কেমন এক ভীতিকর অবস্থা। তখনও বোধহয় সবাই খবরটি জানতে পারেনি। তারপর দেখলাম, সবাই হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আতাউরও বেরিয়ে গেল, আমিও বেরোলাম। পরে শুনলাম খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিচ্ছেন। তার প্রতি তিন বাহিনী প্রধানের সমর্থন। কিন্তু রাস্তায় কোনো প্রতিবাদ নেই, কেউ সাহস করেনি বোধকরি। এখন শেখ হাসিনা প্রায়ই দুঃখ করেন, এত বড় সংগঠন আওয়ামী লীগের কেউই তো বেরুল না, কোনো প্রতিবাদই হলো না। কিন্তু কেন? আমি মনে করি, দুই কারণে এমন হয়ে থাকতে পারে। এক. ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। দুই. আওয়ামী ঘরানার সবাই ভেবেছে যে, খোদ বঙ্গবন্ধু এবং তার পুরো পরিবার তো শেষ করে ফেলেছে, অতএব তারা এখন আর কার জন্য বেরোবে? বরং সবাই ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’তে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমার কেন জানি মনে হয়, খোদা নাখাস্তা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানাকে হত্যা করা হলেও আওয়ামী লীগ বোধকরি বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়ের মতোই আচরণ করবে। এক-এগারোর তিন উদ্দিনের সরকারের সময়েও তো আমরা আওয়ামী লীগের বড় কিছু নেতার হাসিনাকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ দেখেছিলাম। নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে তারা স্টার (STAR) হতে চাইলেও শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক কৌশলে STAR-কে পেছনদিক থেকে অক্ষর সাজিয়ে RATS বানিয়ে দিয়েছেন। একটু ছোট্ট পর্যালোচনা করা বোধকরি অসংগত হবে না যে, কেন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর এমন করুণ পরিণতি হলো।
সংক্ষেপে আমরা যা বুঝতে পেরেছি তাতে মনে করা অসমীচীন হবে না যে, এক. আন্তর্জাতিকভাবে অনেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। তারা প্রথম থেকেই এদেশকে আবারও পাকিস্তানি করতে কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনজাতীয় কিছু করতে, কিংবা দেশটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করে অস্তিত্বহীন করতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বেশকিছু বড় দেশের বিলম্বিত স্বীকৃতি এটার প্রমাণ। দুই. মুসলিম দেশ হিসাবে পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় অনেক মুসলিম দেশ এটা মেনে নিতে পারেনি। সৌদি আরবসহ অন্য কিছু মুসলিম দেশের ভিন্নতর ধারণা হয়েছিল যে, ভারতের হস্তক্ষেপে এবং কোটি ঊর্ধ্ব শরণার্থীর ভারতে আশ্রয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেহেতু মাত্র নয় মাসে অর্জিত হয়ে গিয়েছিল, হয়তো বাংলাদেশ ভারতঘেঁষা হয়ে যাবে। মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশকিছু দেশের স্বীকৃতি পাওয়া প্রমাণ করে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় তারা প্রকৃতই খুশি হয়েছে। তিন. স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য একক অবদান অনস্বীকার্য। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি যখন বলে যান-আমি যদি হুকুম দেওয়ার নাও পারি..., তিনি যখন নির্দেশ দেন-তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে..., ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল..., কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলি, সর্বশেষ যখন বলেন-এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-তখন তো আর বলার কিছু বাকি থাকল না। তার নেতৃত্ব এত শক্তিশালী ছিল যে, তার অনুপস্থিতেও তার নামেই, তার নির্দেশেই দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু তার শাসনামলে জাসদ তাকে অস্থির করে তুলেছে, ছাত্রলীগের বিভাজন তাকে দুর্বল করেছে, সিরাজ সিকদারের হটকারী সর্বহারা আন্দোলন অসহিষ্ণুও করেছে। আবার দলের নেতাকর্মীদের লুটপাট, দখল, সন্ত্রাসে বড় বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। খোদ বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণেই আওয়ামী লীগের তখনকার রূপ ফুটে উঠে-‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পাই চোরের খনি’, ‘গাজী আমার কম্বলটি কোথায়’, ‘সব চাটার দল খেয়ে ফেলে’...। এমন বাস্তব অবস্থায় আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমতে থাকল। চার. বিদেশি ষড়যন্ত্রে আমেরিকার খাদ্যের জাহাজ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলে সৃষ্ট ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধুর সরকারকে আরও সমালোচনায় ফেলে। পাঁচ. ১৯৭৩-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তেমন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, জাসদ তেমন সুবিধাও করতে পারেনি, তারপরও অযথা কিছু অনিয়ম করে রাজনীতিকে কলুষিত করা হয়েছে, ঢাকায় ব্যালট বাক্স নিয়ে এসে খন্দকার মোশতাককে জয়ী করানোর ঘটনা বড় বেশি দৃষ্টিকটু ছিল। স্বাধীন দেশে তিনি একটা স্বচ্ছ নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার সামান্য ব্যর্থতা ‘পচা শামুকে পা কাটে’ অবস্থায় সরকারকে অজনপ্রিয় করেছে। ছয়. সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে হঠাৎ তার একদল বাকশাল করা এবং ৩ মিনিটের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে আবার পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া, পত্রিকা সীমিত করে ফেলা জনগণ মেনে নেয়নি। সাত. বাকশাল গঠনের ফলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার দ্রুত পতনে ষড়যন্ত্রকারী দেশি-বিদেশি উভয়ে-বঙ্গবন্ধু প্রশাসন নিয়ে নানা রকম ব্যাংক ডাকাতির অপপ্রচার চালায়। ১৯৭৪-এর ১৬ ডিসেম্বর শেখ কামালের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালানো হয়। এমনও বলা হয়, রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির দ্বারা সেনাবাহিনীর সুযোগ-সুবিধা কমানো হয়েছে। পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ভেতরে ভেতরে একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আওয়ামী কিছু বিশ্বাসঘাতক নেতার যোগদান একটা ভয়ংকর রূপ নেয়। যার ফলে বিশ্বের এ নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড ঘটে। অবিশ্বাস্য যে, মোশতাক আমৃত্যু তার আগামসি লেনের বাড়িতে নিরাপদেই ছিলেন, কেউ একটা ঢিলও ছোঁড়েনি।
খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বের সরকারের বিরুদ্ধে খুব কম আওয়ামী নেতাই সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে জিয়ার ভূমিকা নিয়েও কথা রয়েছে। ক্ষমতালিপ্সু জিয়া কায়দা করে মোশতাককে সরানোর প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যায়। একজন প্রধান বিচারপতি সায়েমও হয়ে যান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, চিন্তা করা যায় যিনি সংবিধান রক্ষণ করবেন, তিনিই হয়েছিলেন সিএমএলএ! পরে সায়েমকেও সরালেন, জিয়া নিজেই প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। গণভোটে তা জায়েজও করে নিলেন। ৩ নভেম্বরের পালটা ক্যুতে খালেদ মোশাররফ যে ভুল করেছিলেন, জিয়া কিন্তু ৭ নভেম্বরের পর সে ভুল আর করেননি, যখন যাদের প্রয়োজন শেষ করে দিয়েছেন, এমনকি তাকে রক্ষাকারী তাহেরকেও। সামরিক পোশাক থেকেই জিয়া বিএনপি করলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দায় বিমোচন দিয়ে বিদেশে পদায়ন করলেন, আওয়ামী অজনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি-মানসিকতার লোক দিয়ে দল শক্তিশালী করলেন, গোলাম আযমকে নাগরিকত্বের সুবিধা দিলেন, নিজের ভিত শক্ত করলেন এবং অস্বীকার করা যাবে না যে, বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠলেন। আমরা বলি, প্রাকৃতিক প্রতিশোধে বা প্রাকৃতিক বিচারে জিয়াও কিন্তু রেহাই পেলেন না, তাই সেনাদের হাতেই খুন হলেন। সাত্তার প্রেসিডেন্ট হলেন, কিন্তু ২৪ মার্চ, ১৯৮২ আবার সামরিক আইন। শেখ হাসিনা ১৯৮৬-র নির্বাচনে যে যাবে জাতীয় বেইমান হবে বললেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউটার্নে গেলেন, ভোটে এলেন, এরশাদকে এগিয়ে দিলেন। জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যায় ভূমিকা রেখেছেন, হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি দিয়েছেন; অতএব, বিএনপির সরকার থেকে এরশাদের ক্ষমতা নেওয়া অবশ্যই আওয়ামী লীগের পছন্দনীয় ছিল। আওয়ামী লীগ এ সেনা শাসনের আর বিরোধিতা করেনি-‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ নীতিতে। শেষতক গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদও বিদায় হলেন।
আমরা কী দেখলাম? আমরা দেখলাম, সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, নিয়মতান্ত্রিক সরকারকে উচ্ছেদ করে যে অনিয়মের সরকার শুরু হলো, তাতে গণতন্ত্র অনেক পিছিয়ে গেল। এরশাদের পতনের পর আমরা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সরকারের অধীনে এলাম। কিন্তু রাজনীতিকরা সুষ্ঠু ভোটের পথে সমঝোতায় না গিয়ে আবার জনগণকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে আমরা অনেক পিছিয়ে গিয়েছি-এটা মনে রেখে হলেও আমাদের রাজনীতিকরা যেন দেশ এবং দেশের জনগণকে অগ্রগণ্য বিবেচনা করেন-এটাই এখন আমাদের প্রত্যাশা। একটা ভালো লক্ষণ যে, খালেদা জিয়া এখন আর ১৫ আগস্ট তার কয়েকটি জন্মদিনের একটা হিসাবে পালন করছেন না। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা দিবস হিসাবে আমি গত ৪৬ বছরে একবারও বিবাহবার্ষিকী পালন করলাম না, বাকি জীবনেও করব না।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
