স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হবে
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এ অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। আবার সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করাও কঠিন, কেননা স্বাধীনতার শত্রুর অভাব নেই। স্বাধীনতা হীনতায় বাঁচতে চায় কে? আবার অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে চায় না কে? মানব প্রকৃতির এ দুই ভিন্নধর্মী প্রবণতার দ্বন্দ্ব অহরহ চলে আসছে সেই অতীত থেকে। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের জনগণ শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, ইতিহাসের বহু পটপরিবর্তনে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণভাবে অর্জন করে তাদের আজন্ম লালিত সেই স্বপ্নসাধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিধি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই ভয়াবহ ৯ মাস বলে মনে হলেও মূলত তা নয়। তার পরিধি আরও ব্যাপক। এ ব্যাপকতার বিচারে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় বাংলাদেশের জনগণের জীবনে ইতিহাসে একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, চিরস্মরণীয় অধ্যায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, তার যথার্থ উদয় ঘটে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর। সহসা কোনো ঘটনা ঘটে না-তার পেছনে কার্যকরণ থাকে, আয়োজন থাকে, অনুষঙ্গের একীভবন হওয়ার মতো পর্ব থাকে। ঘটনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পর্যবসিত হওয়ার আগেও অনেক পটপরিবর্তন হয়। বলা যেতে পারে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের ভারত বিভাগের মাধ্যমে ক্ষমতাবদলের ঘটনা এ জাতীয় ইতিহাসে একটি পটপরিবর্তন মাত্র। উৎকর্ষ-পূর্ব পরিবেশ হলো পাকিস্তান আমলের ২৫টি বছর এবং ১৯৭১-এর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ হলো উৎকর্ষকাল; যার সফল পরিণতি ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছত্রছায়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড় হয়ে ইংরেজদের এদেশে আগমন ঘটে। অবশ্য তাদের আগে মগ ও পর্তুগিজরা এসেছিল এদেশে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনায় এরা পরস্পরের শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। সমকালীন শাসকদের সাহায্যে এগিয়ে আসে নৌযুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ইংরেজ বণিকরাও। ক্রমে তারা অনুগ্রহ ভাজন হয়ে ওঠে সমকালীন বিলাসপ্রিয় উদাসীন শাসকদের, আর সেই উদাসীনতার সুযোগেই রাজ্যপরিষদ-অভ্যন্তরে কূটনৈতিক প্রবেশ লাভ ঘটে ইংরেজদের। প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলীকে হাত করে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে। মীর কাসিম খান, টিপু সুলতান প্রমুখ সমকালীন স্বাধীনচেতা রাজন্য তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে চাঙা করেও ব্যর্থ হন। বলা বাহুল্য, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু সেখান থেকেই। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতির ফলে এদেশীয় স্বাধীনতাকামী জনগণের মধ্যে পৃথক পৃথক অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হয় এবং ব্রিটিশ শাসকের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায়। ১৭৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহেও ইংরেজদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল বেশ কাজ করে, দ্বিধাবিভক্তিতে আচ্ছন্ন হয় উভয় সম্প্রদায়। এরপর স্যার সৈয়দ আহমদের সমাজসংস্কারবাদী কর্মপ্রচেষ্টার ফলে মুসলমান সম্প্রদায় ধীরে ধীরে আধুনিক শিক্ষার আলো পেয়ে ক্রমান্বয়ে চাক্ষুষ্মান হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস’। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম লীগ’ নামে আরেকটি রাজনৈতিক সংগঠন। বৃহৎ ভারতবর্ষের ব্যাপারে না গিয়ে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে যে প্রধান ঘটনা স্থপতি হিসাবে কাজ করেছে, তা হলো ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পূর্ববাংলার নেতা শের-ই-বাংলা ‘উপমহাদেশের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্র’ গঠনের প্রস্তাব করেন। ১৯৩০ সালে চৌধুরী রহমত আলী ‘পাকিস্তান’ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম প্রকাশ করেন, তাতে বাংলা নামের কোনো শব্দ বা বর্ণ ছিল না। এমনকি ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের দার্শনিকভাব নির্মাতা স্যার মুহাম্মদ ইকবাল পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কল্পনা ব্যক্ত করেন, তাতেও বাংলা অন্তর্ভুক্তির কোনো কথা ছিল না। এতদসত্ত্বেও ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে ভারতবর্ষের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত সহস্রাধিক মাইল ব্যবধানে অবস্থিত পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে একীভূত হয়। এটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা ছিল না বরং উপনিবেশবাদের হস্তান্তর ছিল মাত্র, ক্রমেই পূর্ববঙ্গবাসীরা তা উপলব্ধি করতে পারেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যে, তাদের সংস্কৃতির ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত আসছে, যা আত্মপরিচয়কে নিশ্চিহ্ন করে দেবে; ফলে জাতি হিসাবে তাদের মৃত্যু হবে। বিভ্রান্তি তাদের কেটে যায় এবং প্রতিবাদে তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে, স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়নি। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে তারা তাদের সচেতনতার পরিচয় দেয়। এতদিনে পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তবাদী চক্রের আসল মুখোশ উন্মোচিত হয়। ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ। সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় সুনিশ্চিত হয়। তাই এ বিজয় ৯ মাসের সংগ্রামের বিজয় নয়, পূর্ববঙ্গবাসীদের স্বাধীনতা মনোবৃত্তির সুদীর্ঘকালের আকাঙ্ক্ষার বিজয়। ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং সুদীর্ঘকালের ‘বিশ্বাসঘাতকা ও বিভ্রান্তি’ অবসানের পর এ বিজয়।
বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। তারা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রের অধিকার নিজেরাই অর্জন করতে জানে এবং নিয়ন্ত্রণ করে। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় জনগণের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সত্যের আত্মপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের মৌলিক পরিচয় সমুন্নত করেছে এ বিজয়ের মাধ্যমে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তাই বাংলাদেশবাসীরও জীবন ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা; যা শুধু একটি তারিখই নয়, তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার বলিষ্ঠ বিকাশের ধারক ও বাহক।
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের দরবারে আমরা যে পরিচয়ে পরিচিত হয়েছি, তার আনুপূর্বিক ইতিহাস এবং এর অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা আমাদের আরও মহীয়ান করে তুলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ-আত্মত্যাগ অনন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে নজির আমরা স্থাপন করেছি, তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। নিঃসন্দেহে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে এক নবদিগন্তের সূচনা করেছে। সীমাহীন শোষণ ও সুদীর্ঘকালের অবজ্ঞায় নিষ্পেষিত ঔপনিবেশিক জীবনযাত্রা থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা আমাদের নিয়মে চলার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, বাঁচার অধিকার পেলাম। আমাদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রায়, সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রায় নতুনদিগন্ত উন্মোচিত হলো। আমাদের নিয়মে চলার পথে মাইলফলক হিসাবে দাঁড়িয়ে রইল মহান বিজয়। বিজয়ের মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন একাগ্রতা, আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস নিশ্চয়ই আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে সহায়তা করবে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমরা এ একাগ্রতার পরিচয় দিতে পিছপা যে হইনি, আমরা সত্যই বিস্মৃতির অতলে যে তলিয়ে যাইনি তার কিছু প্রমাণ আমরা দিয়েছি। পররাষ্ট্র ক্ষেত্রেও আমাদের সুমহান বিজয় দিন দিন বৃদ্ধিলাভ করছে। এগুলো যেমন আনন্দের কথা, তেমনি চারিত্রিক বলের অধঃপতন ও অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণ থেকে উৎসারিত দুর্নীতি আমাদের অর্থনৈতিক জীবনকে বিষময় করে তোলার প্রয়াস ঘটাচ্ছে, হতাশায় আমাদের অগ্রযাত্রায় বিঘ্ন ও বিভ্রাট সৃষ্টি করে চলেছে। এগুলোকে যথাযথ সচেতনতায় সজাগ দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
অতীতকে আঁকড়ে ধরে থেকে নয়, বরং অভিজ্ঞতার আলোকে বিজয়কে জীবনের সর্বস্তরে উদ্ভাসিত করে তোলার জাগ্রত চেতনায়, সমাজকে পরিছন্ন করে তোলার ব্রত নিয়ে ভৌগোলিক সীমানায় আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে এদেশ গড়ে তুলতে হবে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
