Logo
Logo
×

বাতায়ন

নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে হবে

Icon

মো. নূরুল আমিন

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে ‘কপ২৮’-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পৃথিবীকে বাঁচাতে এখনই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান জানান। উদ্বোধনী ভাষণে ব্রিটিশ রাজা চার্লস বলেন, ‘পৃথিবী আমাদের নয়, আমরা পৃথিবীর অন্তর্গত। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার ক্ষমতা বিপন্ন হবে, যদি না আমরা প্রকৃতির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করি।’

বর্তমানে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১ হাজার ১৯৪ দশমিক ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে জ্বালানি রূপান্তরের মাধ্যমে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলেছেন। জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ছে দেশে দেশে। হিটস্ট্রোকে বয়স্কদের মৃত্যুর হার বাড়ছে। তাই এ বিষয়ে এখনই মনোযোগ দিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে পরিবেশে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্রমবর্ধমান ঘনত্ব এ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। সে কারণেই বিশ্বনেতারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা তিনগুণ করতে সম্মত হয়েছেন।

বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা যায়, সরকারের নীতি হলো ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাওয়া এবং সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎসহ মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ ২০২৫ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করা। বর্তমানে উৎপাদিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের মধ্যে সোলারভিত্তিক ৯৬০ দশমিক ৭০ মেগাওয়াট, হাইড্রো ২৩০ মেগাওয়াট, বায়ুভিত্তিক ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, বায়োগ্যাসভিত্তিক শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন লাইসেন্স প্রবিধানমালা ২০০৬ অনুযায়ী ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স ওয়েভারের সুযোগ রাখা হয়েছে।

আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসছে। বড় কোনো নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কয়লা দিয়ে। আর এসব উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, যার জন্য ব্যয় হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।

কয়েক মাস আগে কয়লা আমদানি করতে বিলম্ব হওয়ায় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়; ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সরকার জরুরিভিত্তিতে কয়লা আমদানি করায় এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই আমদানিনির্ভর উপকরণের ওপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ, ব্যয়বহুল এবং টেকসই উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই আমাদের উচিত এখনই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে অধিকতর বিনিয়োগ করা; বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোকে এ প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে আমাদের বড় বড় নদীর তীরে অনেক স্থানে যেসব চর পড়ে রয়েছে, সেই জমিগুলো পরীক্ষা করে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মজুতকরণ, সঞ্চালন ও বিতরণে ব্যয় সাশ্রয়ী অনেক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক টেকসই বিদ্যুৎব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভবিষ্যৎমুখী স্মার্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

আমি ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে দেখেছিলাম প্রতিটি দালানের ছাদে রয়েছে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, এমনকি অনেক দালানে দেখেছি গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ভবনের ছাদ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, তবে এর ব্যাপকতা কম। আমাদের ধীরে ধীরে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আমি মে-তে সিরাজগঞ্জে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পাই পাওয়ার প্ল্যান্টের দক্ষিণ পাশে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হয়েছে; চরের জমিতে তা থেকে ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। ডিসেম্বরে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড পরিদর্শনে গেলে সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, তবে সোলার পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যক্রম তারা নিয়েছেন, তাদের পর্যাপ্ত জমি রয়েছে। তারা আরও জানান, গাছ লাগানো শুরু হয়েছে, আগামী দুই বছরে পুরো এলাকা সবুজায়ন করা হবে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রাহকদের দেওয়া হচ্ছে।

চীনের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় জামালপুরের মাদারগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি সোলার পাওয়ার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার জন্য মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। আমাদের দেশে ইডকলের নবায়নযোগ্য শক্তি কর্মসূচি কয়েক বছর আগে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। সোলার হোম সিস্টেম প্রকল্পের অধীনে বিদ্যুৎ সুবিধা নেই এমন এলাকায় হোম সিস্টেম স্থাপন করে মানুষকে মৌলিক বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান করা হয়। পরিবেশে কার্বনডাই অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হলে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের বিকল্প নেই। দেখা যায়, বাংলাদেশে ইরিগেশন প্রকল্পগুলোতে রাত ১১টায় বিদ্যুৎ দেওয়া হয়; কিন্তু আমাদের দেশে দিনের বেলা সূর্যের আলো পর্যাপ্ত, যদি ইরিগেশন পাম্পগুলো সৌর সেচের আওতায় আনা যায়, তাহলে দিনের বেলা জমিতে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস যেমন-প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে নিঃশেষিত হয়ে যায়। অপরদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন-সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদির ব্যবহার সহজে নিঃশেষিত হয়ে যায় না। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহার উভয় ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে, যা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।

মো. নূরুল আমিন : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন; সাবেক সিনিয়র সচিব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম