একটি সুন্দর নির্বাচনের প্রত্যাশা
বিমল সরকার
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
স্মৃতি বা অভিজ্ঞতা মানুষকে কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়, কখনো আবার বেশ ভাবায়ও। কিছু স্মৃতি মনের গভীরে একেবারে গেঁথে থাকে। এমন স্মৃতিসমুদ্রে অবগাহন করার মাঝেও রয়েছে ভিন্ন স্বাদ, ভিন্নমাত্রার এক অনুভূতি।
যে কোনো নির্বাচনে পক্ষ-প্রতিপক্ষ ও জয়-পরাজয় থাকবেই। তবে উৎসবের আমেজে কেন্দ্রে গিয়ে কারও দ্বারা কোনোরূপে প্রভাবিত না হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা কিংবা করতে পারাটা আমাদের দেশে দিনে দিনে অনেকটা অলীক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেওয়া বা ভোট দিতে পারা, আহা; ভাবতেও কী যে ভালো লাগে!
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচন। দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক হানাহানি, চরম বিশৃঙ্খলা ও বছরেরও অধিককাল (২০০৫-২০০৬) উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবসানের পর হঠাৎ করেই বেজে উঠে ভোটের বাদ্য-দামামা, শহর-বন্দর-গঞ্জ-গ্রাম সবখানে। এ নির্বাচনকে ঘিরে সর্বত্র বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। ভোটের হাওয়া বলে কথা! ‘ভোট চাই, ভোট দাও, ভোট দেব’ আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠে গোট দেশ। সবখানে সবার মুখে যেন প্রাণখোলা হাসি।
স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সবখানে ছুটি। ঘরবাড়িতেও বেশ প্রাণচাঞ্চল্য। কাজের গোছগাছ, সবকিছু সামাল দিয়ে ভোট দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে গিয়ে বেশ সকাল সকাল আমার স্ত্রী ভোট দেওয়ার কাজটি সেরে এসেছেন। ফাঁক বুঝে দুপুরের দিকে আমিও নিজের ভোটখানা দিতে যাই। শীতের পড়ন্ত বেলায় নারী ও পুরুষের সারিবদ্ধ সুশৃঙ্খল অবস্থান। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর কলেজ কেন্দ্রে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ; দেখে খুবই ভালো লাগল। এ কলেজেরই আমি শিক্ষক। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পরিবারসহ বাস করি ক্যাম্পাসে অবস্থিত কলেজেরই কোয়ার্টারে। উপজেলা স্তরের একজন সরকারি কর্মকর্তা এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার। ভোট নেওয়ার কাজে নিয়োজিত অন্য কর্মকর্তাদেরও অনেকেই আমার পরিচিত। সবার সহযোগিতায় খুব স্বাচ্ছন্দ্যে আমার ভোট দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন হয়। মাঝে হয় কুশল বিনিময়ও। এ সময়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে খুবই তৎপর দেখতে পাই। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ হলেও তার মাঝে টগবগে তরুণের মতোই কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ করি। মনে হলো ভদ্রলোক বেশ দায়িত্বশীল। অন্য সবাই যার যার আসনে বসে কাজ করে গেলেও প্রিসাইডিং অফিসারকে কখনো আসনে বসতে দেখিনি। এ-কক্ষ আর ও-কক্ষ, এভাবে আনাগোনাতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত।
আমি যে একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করি তা অনেকের জানা। সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটদান-গ্রহণের কাজ চলছে দেখে খুশিচিত্তে কক্ষ থেকে বের হয়ে এলেও একটু ফিরে আবার প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে গিয়ে ভোটদানের শতকরা হারটি জানতে চাই। আগ্রহের সঙ্গে বুক পকেট থেকে একটি নোটবুক বের করে তাতে নিজ হাতে লিখে দিলেন- বাজিতপুর ডিগ্রি কলেজ : মোট ভোটার ৩৯৮৪ জন। পুরুষ ভোটার : ১৯৩৩, মহিলা ভোটার ২০৫১ জন। ১টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত মোট কাস্ট : ২৭২৭ ভোট। ক্যালকুলেটরে চাপ দিয়ে হিসাব করে প্রিসাইডিং অফিসার নিজের হাতেই লিখে দিলেন ৬৮ শতাংশ।
জীবনে আমি অনেকবার ভোট দিয়েছি। ১৯৮৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অম্লমধুর যাই হোক বেশ অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে আমার (এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে আমি ভোট দিতে কেন্দ্রে যাইনি এবং নির্বাচন সম্পর্কিত কোনো দায়িত্বও পালন করতে হয়নি আমাকে)। মহানগর নয়, জেলা সদরও নয়, হাওড় ও চর মিলে দেশের প্রত্যন্ত একটি জনপদ। সংসদ নির্বাচনে উপজেলা স্তরের এমন একটি কেন্দ্রে বেলা দেড়টায় ৬৮ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়া এক বিরল অভিজ্ঞতা। ভোট চলাকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রাসঙ্গিক নানা কাজে খুবই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তাছাড়া কেন্দ্রটি ঝুঁকিপূর্ণ হলে তো কথাই নেই। এ সময় নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো খবর বা তথ্য তারা সহজে দিতে বা পরিবেশন করতে চান না। এক্ষেত্রে আমার কেন্দ্রে যা হয়েছে তা সত্যিই উল্লেখ করার মতো ব্যতিক্রম। এটাকেই বোধকরি বলে স্বতঃস্ফূর্ততা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা।
এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের মোট এগারোটি নির্বাচন হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে গড়ে ভোট পড়ে প্রায় ৮৮ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোটের হার! খুব কৌতূহলী হয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমাদের কিশোরগঞ্জ জেলায় ৬টি আসনে গড়ে ভোটদানের হার ৮৭ শতাংশ আর কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনে এ হার ৮৯ শতাংশ।
পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনেও ভোটার ও একজন সংবাদকর্মী হিসাবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচনের মতো উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমার স্মৃতিপটে আর নেই। দেশিবিদেশি পর্যবেক্ষকসহ সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ভোটকেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতির দিকে। দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই হন আশান্বিত। কিন্তু উচ্চাভিলাষী রাজনীতিকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক তৎপরতা ও অপতৎপরতায় সে আশাটি ভঙ্গের উপক্রম হয়। জানি না প্রত্যাশা অনুযায়ী আরও একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন আমরা দেখে যেতে পারব কি না।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
