স্বদেশ ভাবনা
আমনের উৎপাদন কি বোরো ওঠা পর্যন্ত চাহিদা মেটাতে পারবে?
আবদুল লতিফ মন্ডল
প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
নব্বইয়ের দশকের শেষদিক থেকে দেশে চাল উৎপাদনে শীর্ষস্থানটি দখল করে আছে বোরো। দেশে উৎপাদিত মোট চালের কমবেশি ৫৫ শতাংশ উৎপন্ন করছে বোরো। কমবেশি ৪০ শতাংশ চাল উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমন। বাকিটুকু আসে আউশ থেকে। গত অর্থবছরে বোরোর ভালো উৎপাদন এবং ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন চাল আমদানির ওপর নির্ভর করে চলতি অর্থবছরে এ যাবৎ কোনো চাল আমদানি হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে চাল আমদানি না করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আমন ধানের কাটা-মাড়াই প্রায় শেষের দিকে। কৃষকদের মাঝে বোরো চাষের প্রস্তুতি চলছে। মে মাসে শুরু হবে বোরো ধান কাটামাড়া। এখানে যে প্রশ্নটি উঠতে পারে তা হলো, এবারের আমন ফসলের উৎপাদন আগামী বোরো ওঠা পর্যন্ত সময়ে কি চালের প্রয়োজন মেটাতে পারবে?
সাধারণভাবে আমন ধান কাটা-মাড়াই শুরুর সময় থেকে বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে আমন চালের ব্যবহার হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক চাল ভোগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭৭.২ গ্রামে, যা ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন কমবেশি ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) আশা করছে, চলতি আমন মৌসুমে চালের উৎপাদন হবে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার (১ কোটি ৭২ লাখ টন) চেয়ে ৩ লাখ টন বেশি। এদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে একদিকে যেমন আমন রোপা কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়, তেমনি অন্যদিকে আমন চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৫৭ দশমিক ৫০ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। তাছাড়া নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর দণ্ডায়মান ধান ফসলের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ইউএসডিএ বাংলাদেশে এ বছর আমনের উৎপাদন আগের প্রাক্কলন থেকে ১ লাখ টন কমিয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ টনে নির্ধারণ করেছে (ডেইলি স্টার, ২৯ ডিসেম্বর)। দেশে খাদ্যশস্যের, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে ডিএই’র হিসাবের সঙ্গে বিবিএস ও ইউএসডিএ’র হিসাবের গরমিল নতুন নয়। উদাহরণস্বরূপ, ডিএই’র হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে চালের মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে, যা বিবিএসের হিসাবে ছিল ৩ কোটি ৬৬ লাখ টন। বিবিএসের হিসাবের সঙ্গে ডিএই’র হিসাবের পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ২১ লাখ টনে। আবার ইউএসডিএ’র হিসাবের সঙ্গে পার্থক্য দাঁড়ায় ২৮ লাখ টনে। শুধু প্রধান খাদ্যশস্য চালের ক্ষেত্রে নয়, দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গম ও অন্যান্য মাইনর ক্রপসের ক্ষেত্রেও হিসাবের গরমিলের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
আমনের উৎপাদন যদি দেড় কোটি টনেও দাঁড়ায়, তবু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট মনে করা সঙ্গত হবে না। বাফার স্টক হিসাবে চালের মজুত সক্ষমতা জরুরি বিবেচনায় বাড়াতে হবে। বিবেচনায় রাখতে হবে বিশ্ববাজারে চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়টি। ভারতীয় একটি পত্রিকার বরাত দিয়ে ২৯ ডিসেম্বর বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে নভেম্বরে চালের দাম বেড়েছে ৭-৮ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের ইতিহাসে খাদ্যপণ্যটির দাম সর্বোচ্চ উঠেছে। উচ্চ চাহিদা ও সীমিত সরবরাহ এ মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসাবে কাজ করছে। ভারত সাদা ও ভাঙা চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। বিক্রি কম হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামি চালের দাম ২০০৮ সালের পর এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ উঠেছে। এদিকে এল নিনোর প্রভাব, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও বন্যার মতো সমস্যার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় খাদ্যশস্যের ফলন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একদিকে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে তখন চাল আমদানিকারক দেশগুলো থেকে চালের চাহিদা বাড়ছে।
আমাদের অনেক নীতিনির্ধারকদের বলতে শোনা যায়, সরকারি গুদামে যথেষ্ট পরিমাণে চাল মজুত আছে। সুতরাং চিন্তা নেই। আসলে সরকারি গুদামে যে চাল মজুত থাকে, তা দেশে চালের সার্বিক প্রয়োজন মেটাতে বা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ জানুয়ারি সরকারি গুদামে চাল মজুতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ লাখ টন। এ চাল বড়জোর দেশের জনগণের ২ সপ্তাহের প্রয়োজন মেটাতে পারে। যেসব কারণে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে ধান-চাল ক্রয় করে বা আমদানির মাধ্যমে চাল সংগ্রহ করে সরকারি গুদামে মজুত করে সেগুলো হলো-এক. সরকারি গুদামে ধান-চালের ভালো মজুত গড়ে তোলার মাধ্যমে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের চালের দাম বাড়াতে নিরুৎসাহিত করা; দুই. বাজারে চালের দাম বাড়লে সরকারি মজুত থেকে খোলাবাজারে ও ন্যায্যমূল্যের দোকানে চাল বিক্রির মাধ্যমে এর দাম স্থিতিশীল রাখা; তিন. সরকারের লক্ষ্যমুখী খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা; চার. খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে দুস্থদের মাঝে চাল বিতরণ করা।
গত ডিসেম্বরের ৭ থেকে ৯ তারিখে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে বলা হয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে মারাÍকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছেন। সম্ভাব্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় যে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে তার একটি হলো জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্যের লভ্যতা। দেশে খাদ্য লভ্যতার মূল উৎস হলো কৃষি খাতে (শস্য উপখাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপখাত এবং বন উপখাত নিয়ে কৃষি খাত গঠিত) উৎপাদিত খাদ্যপণ্য। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি জমির অকৃষি খাতে ব্যবহার এবং উন্নতমানের চাষাবাদের অভাব ইত্যাদি কারণে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতের ৬.৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩.০৫ শতাংশে। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ২.৬১ শতাংশে। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে শস্য উপখাতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসল এবং আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধান তথা চাল এবং দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের ওপর। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত চাল উৎপাদনের গড় প্রবৃদ্ধি হার ছিল ১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো ১ শতাংশ বা এর আশপাশে থাকবে বলেই ধারণা করা যায়। এদিকে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ১.৩৭ ও ১.৩ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ ও ২০২৩)। এর অর্থ দাঁড়ায়, চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। এতে চাহিদার তুলনায় চালের ঘাটতি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় খাদ্যশস্য গমের উৎপাদন ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরের ১৯ লাখ টনের তুলনায় সাম্প্রতিককালে ১১ লাখ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
দেশে খাদ্য লভ্যতার দ্বিতীয় উৎস হলো আমদানি। চলতি আমন থেকে যে চাল পাওয়া যাবে, তা আগামী বোরো ফসল ওঠা পর্যন্ত দেশের চাহিদা মেটাতে পারবে না এমনটা ধরে নিয়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ টন চাল আমদানির জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে। সেই সঙ্গে গম আমদানির ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে হবে। সম্ভাব্য খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বা দুর্ভিক্ষ এড়াতে একদিকে যেমন খাদ্যশস্যের লভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি খাদ্য সংগ্রহের জন্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব
latifm43@gmail.com
