আওয়ামী লীগের এত প্রতিক্রিয়া দেখানোর দরকার কী?
এ কে এম শাহনাওয়াজ
প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জাতীয় নির্বাচনের দিনকয়েক আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমার দেড় মাসের সিরিজ বক্তৃতা শেষ হলো। সব সময় পাঠ গ্রহণকারী আলোকিত ছেলেমেয়ের মধ্যে এবারও কজনকে পেয়েছিলাম। এমন একজনের কথা বলছি; ও তারুণ্যের শুরু থেকেই কেন্দ্রের পাঠচক্রের সঙ্গে জড়িত। এখন সে পেশাজীবী। তবুও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাকে আকর্ষণ করে। ধরে নিই ওর নাম রাজু। শেষ দিনের বক্তৃতার পর রাজু আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাইল। এ সময় নির্বাচনি রাজনীতিতে উত্তাল দেশ। দেখলাম বিএনপির প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল সে। অর্থাৎ বিএনপিমনা। বলল ‘স্যার, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির প্রেক্ষাপট আমাদের এ প্রজন্মের কাছে তেমন স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে ১৯৯০-এর পর থেকে আমরা যারা স্কুল পর্যায়ের পড়াশোনো করেছি, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময় অনেকটা অস্পষ্ট। আবার পাঠ্যবইপত্রে যতটুকু পড়েছি তাতে নানা জটিলতায় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না।’ জানতে চাইল বঙ্গবন্ধু হত্যা, বিএনপির জন্ম ও বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে।
জিয়াউর রহমান প্রভাবশালী সেনা অফিসার থাকার সময়ই সামরিক অফিসারদের একাংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তখন অনেকেই বলছিলেন পরাজিত পাকিস্তান সরকারের অঙ্গুলি হেলনে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এর পেছনে হাত ছিল জিয়াউর রহমানের। যদিও এ অভিযোগের অকাট্য প্রমাণ নেই। তবে যুক্তি দাঁড়িয়েছিল, যখন বিএনপি সরকারের সময়ের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করে পুরস্কৃত করতে লাগলেন। আর ইনডেমনিটি নামের বর্বর আইন পাশ করলেন, যাতে কেউ হত্যাকারীদের বিচার না করতে পারে।
রাজুর কৌতূহলের জবাব দিতে গিয়ে আমি বললাম, ‘ইতিহাস লিখিত হয় তথ্যসূত্রের বিচারে। আমার বলা কথাকে ভরসা করবে না। তুমি আলোকিত মানুষ। নিজেই তথ্য-সূত্র ঘেঁটে সত্য খুঁজে নাও। তাতে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখবে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করে তার মন্ত্রিসভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে।’ আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবর বলছিলেন জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হলেও তার সঙ্গে গোপন আঁতাত ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার। এ বক্তব্যকে রাজনৈতিক বক্তব্য মনে করে সাধারণ মানুষ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু পরপর কয়েকটি ঘটনা সচেতন মানুষকে নতুন করে ভাবায়। প্রথমত ওপরে বর্ণিত বঙ্গবন্ধু হত্যা ও প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক হত্যাকারীদের রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো; দ্বিতীয়ত শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা এবং তৃতীয়ত প্রেসিডেন্ট জিয়া কর্তৃক গোপন বিচারে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। অনেকের মধ্যে বিশ্বাস হতে থাকে, জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ডা পূরণ করছেন যেন। এরপর আরেক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলে একপর্যায়ে দল ও রাষ্ট্রক্ষমতার নেতৃত্বে আসেন খালেদা জিয়া। এ পর্বে পাকিস্তানপন্থা আরও স্পষ্ট হয়। পাকবাহিনীর দোসর হিসাবে চিহ্নিত বেশ কজন আলবদর, রাজাকার খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেয়। জাতীয় পতাকা উড়তে থাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের গাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। চালু করা হয় পাকিস্তানি স্টাইলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান। বন্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্প্রভ করে দেওয়ার অভিপ্রায়ে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন স্বয়ং বেগম জিয়ার একটি নতুন জন্মদিনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। বেগম জিয়ার জন্মসনদ ও পাসপোর্টে দেওয়া জন্ম তারিখের কোনো মিল নেই এ নতুন জন্মদিনের সঙ্গে। স্পষ্ট হয়, প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রেরণা নিষ্প্রভ করে দেওয়ার জন্য এমন আয়োজন। যেখানে বিবেকবান মানুষ ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিয়ে, জন্মদিনের মতো উৎসব সাড়ম্বরে পালন করতে কুণ্ঠিত থাকে, সেখানে খালেদা জিয়া সেদিন কেক কেটে উৎসব পালন করেন। অনুসারীরা এ উৎসব ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে।
মিথ্যার ওপর বেশি দিন দাঁড়ানো কঠিন। তাই নানামুখী সমালোচনার মুখে এখন আর সাড়ম্বরে জন্মদিন পালনের কথা শোনা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ঔজ্জ্বল্য নতুন প্রজন্মের কাছে ম্লান করে দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নতুন তথ্যে জানানো হলো মুক্তযুদ্ধের ঘোষক ছিলেন জিয়াউর রহমান। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পর জন্ম নেওয়া বিএনপি নামের দলকে মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা নেওয়া হলো। এমন করেই বোকা বানানোর চেষ্টা করা হলো নতুন প্রজন্মকে। কিন্তু একবারও রচয়িতারা ভাবলেন না এ ধারার অপতৎপরতার জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন বিএনপিকে দাঁড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ঘোষণা পাঠ আর ঘোষণা দেওয়া যে এক কথা নয়, এ সত্য কতদিন আড়ালে রাখা যাবে! আর ইতিহাসের পাঠক নতুন প্রজন্ম তো বুঝবেই মুক্তিযুদ্ধের মতো এত বড় একটি ঘটনা কোনো তাৎক্ষণিক কারণে সংঘটিত হতে পারে না। দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের পরিণতি ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের আগে এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে জিয়াউর রহমান ছিলেন অচেনা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক ‘মেজর’ পদাধিকারী সামরিক অফিসারের একজন ছিলেন জিয়াউর রহমান। তবে মুক্তিযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জিয়াউর রহমানের অবদানকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। এসব বাস্তবতা ছিল বলেই বেঁচে থাকতে জিয়াউর রহমান নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বলে উদ্ভট দাবি করেননি। সম্ভবত তখনকার বিএনপি নেতাদের মাথাতেও এমন কুবুদ্ধি আসেনি।
কী নির্মম পরিহাস! জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা ঘরানা থেকে আসা বিএনপি নেতারা প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক তকমা লাগিয়ে অবমূল্যায়ন করলেন স্বয়ং জিয়াউর রহমানকে। এরপর লাঞ্ছনার কালিমা লাগালেন তাদের নেত্রী বেগম জিয়ার মুখে। মিথ্যা জন্মদিনের সনদ ঝুলিয়ে দিলেন বেগম জিয়ার গলায়। একবারও ভাবলেন না আগামীর ইতিহাস কীভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে বিএনপি নামের দলটিকে। রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি নেতাদের অর্বাচীন আচরণ এখানেই শেষ নয়। এ দলের ক্ষমতাকালেই স্কুল পাঠ্যবইতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হলো। নতুন প্রজন্মকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিল রাজু। এবার নড়ে উঠল। বলল, ‘স্যার, একে মূর্খতা বলছেন কেন, বিএনপি নেতারা চাতুরতার সঙ্গে অনেকটাই সফল হয়েছেন। আমরা এ বিকৃত ইতিহাস পড়েই বড় হয়েছি। দায়িত্ব থাকলেও এর বিরুদ্ধে সত্য উপস্থাপনে এগিয়ে আসেননি আওয়ামী লীগ নেতারা। আমাদের প্রজন্মের অনেকের কাছেই আওয়ামী লীগের নেতাদের খলনায়ক বানাতে পেরেছে বিএনপি। বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বকে অনেকটা ধোঁয়াটে করে ফেলা হয়েছে। এখন আমি নিজেকেই মূর্খ ভাবি। কেন আমি ইতিহাসকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলাম না।’ আমি বললাম, ‘রাজু এতে তোমার তেমন দোষ নেই। সারা দুনিয়াতেই ক্ষমতা দখলকারীরা নতুন প্রজন্মকে অন্ধ বানাতে ইতিহাস আড়াল করতে চায়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও পাঠ্যপুস্তকে বারবার ইতিহাস চর্চার সুযোগ সংকুচিত করা হয়েছে এবং হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়টি বারবারই থেকেছে অবহেলিত। দলীয়করণের বাতাবরণে যোগ্য মানুষেরা জায়গা পাননি।’
বিএনপি নামের দলটির নেতারা তো অন্তঃসারশূন্যতার কারণে সফল কোনো আন্দোলন দানা বাঁধাতে পারলেন না। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে হাঁটার আত্মবিশ্বাস না থাকায় পাকিস্তানপন্থি জামায়েতে ইসলামী দলকে সঙ্গে নিয়ে ভংয়কর অরাজকতা সৃষ্টি করেও তো অতীতে ক্ষমতায় আসতে পারেননি। সেই চোরাপথে এবারও ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলেন। বিএনপি নেতারা ২০১৩ সাল থেকে কত সহস বার সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন-মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এখনো নিরলসভাবে একই দাবি করে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ বোধহয় একে বিএনপি নেতাদের মজ্জাগত বুলি ভাবতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সব হারিয়ে এখন নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির হার কম, বিদেশিরা এ নির্বাচন গ্রহণ করছে না, বিএনপি নেতাদের ডাকে ‘জনগণ’ নির্বাচন বর্জন করেছে এসব বলে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ সম্ভবত এগুলোকে প্রলাপ বলেই মনে করছে।
আমরা মনে করি অদূরদর্শী রাজনীতির পরিণতিতে এবার বিএনপি যে ধাক্কা খেয়েছে, তাতে দলটির আলোতে আসা কঠিন ছিল। কিন্তু সৌভাগ্য বিএনপি নেতাদের। তাদের লাগামহীন বকে যাওয়া সব কথা আমাদের অনেক টিভি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়া প্রতিদিন সবিস্তারে প্রচার করে কর্মী সমর্থকদের দেহে রক্ত সঞ্চালন জারি রেখেছে।
বর্তমান দশায় সতর্কতার সঙ্গে যখন বিএনপি নেতাদের প্রলাপ অবজ্ঞা করার কথা, তখন আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়মমাফিক প্রতিটি কথার জবাব দিয়ে দলটিকে বাঁচিয়ে রাখছেন। বিএনপি কালো পতাকা মিছিল করে ঢাকায় জমায়েত করছে, করবে। বর্তমান দুর্বল বিএনপিকে নানা কৌশলে মোকাবিলা করতে পারতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু সে পথে না হেঁটে গতানুগতিক পথেই হাঁটছেন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। নির্বাচনের আগের ধারাই বজায় রেখেছেন। বিএনপির কর্মসূচির একই দিনে ‘শান্তি সমাবেশের’ আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। সামনে কালো পতাকার বিপরীতে লাল-সবুজের পতাকা মিছিল করবে। এ খবরে বিএনপি নেতাকর্মীরা প্রশান্তি অনুভব করতে পারেন। মনে করতে পারেন আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে এখনো তাদের সমান গুরুত্ব রয়েছে। বিএনপির ম্রিয়মাণ নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার উপাদান যেন দিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আমি জানি না এ কারণে এ দুর্দিনে বিএনপি নেতারা মিডিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন কিনা। আওয়ামী লীগ সরকার আত্মবিশ্বাসী হয়ে যদি দুর্নীতি কমানো ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান সাফল্য দেখাতে পারত, তবে বিরোধীদের চাপ নিয়ে ভাবতে হতো না। ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যেত এমন দুর্বল বিরোধী কণ্ঠ।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
