Logo
Logo
×

বাতায়ন

ক্যা ক্যা নিয়ে ‘ক্যাকোফোনি’

Icon

পবিত্র সরকার

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ক্যা ক্যা নিয়ে ‘ক্যাকোফোনি’

দোহাই প্রিয় পাঠক, নামে একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি বিদ্যে দেখানোর জন্য নয়, একটু নির্দোষ অনুপ্রাস লাগাতে। এ শব্দটাই বেশ লাগসই মনে হলো। এর মানে কর্কশ চ্যাঁচামেচি, রবীন্দ্রনাথ নামক অভিধান থেকে চুরি করে আরেকটা শব্দ বলতে পারি-‘কাংস্যক্রেংকার’। আমার লেখাটার চরিত্র বোঝানোর জন্য।

সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা ‘কা’ (CAA) নিয়ে দেশে প্রচুর হইহট্টগোল হচ্ছে। হওয়ারই কথা, কারণ অনেক মানুষ (যেমন মতুয়া বন্ধুদের কেউ কেউ বা ক্ষণিক পথের সাথী এক মুসলমান ট্যাক্সিচালক, যার বাড়ি মুর্শিদাবাদে) এ ভয় পাচ্ছেন যে, ওই আইন হলে তাদের নাগরিকত্ব চলে যাবে। আর নাগরিকত্ব চলে যাবে মানেই তারা গৃহহীন, দেশহীন, ভূমিহীন, আকাশহীন মানুষ হয়ে যাবেন। না, তারা ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এর সেই জাদুকরের মতো আকাশে ফট্ করে ফেটে বা বিকালের রোদের মতো ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যাবেন না। তারা রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে থাকবেন, তাদের এবং তাদের আত্মজনদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা-প্রেম-ঘৃণা সবই থাকবে, কিন্তু পৃথিবীর সব খাতা থেকে তাদের নাম কাটা যাবে, র‌্যাশন, আধার, প্যান, স্বাস্থ্যসাথী, এটিএম, পেট্রোল পাম্প, ক্রেডিট, ডেবিট, ইত্যাদি কোনো কার্ড থাকবে না, সব রকম ‘শ্রী’ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের উৎখাত করবেন। সে এক কীরকম ভয়ানক নিরস্তিত্ব তা কল্পনাতেও আসে না আমার। এমনকি আমি যে আমি, যে উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছিল (উদ্বাস্তু রেজিস্ট্রেশন নম্বরের কাগজ কোথাও আছে, খুঁজে দেখতে হবে), আমার বুকও দুরদুর করছে।

সত্যিই তো, এমন যদি হয়, কে নেবে আমাদের? কোন্ ভূমি, কোন্ সমাজ? কিনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ক্ষমাঘেন্না করে জায়গা দেবে, দুমুঠো খাদ্য সংস্থানের, শিক্ষার, চিকিৎসার, আইনের সুরক্ষার সুযোগ দেবে কে? পৃথিবীতে কোথায় আছে সে দেশ? আর সব দেশ চাইলেও কি আমরা যেতে পারব? চীন যদি বলে, এসো, আমাদের তিব্বতে প্রচুর জায়গা খালি আছে, চলে এসো বাছারা, বা রাশিয়ার সাইবেরিয়া যদি ডাকে, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে মরার শর্তে আমরা কি লাফিয়ে উঠে বলব, ‘চল্ মুসাফির, বান্ধো গাঠোরি? শুনেছি পরম সদাশয় ভারত সরকার নাকি ডিটেনশন ক্যাম্প আশ্রয়শিবিরে রাখার ব্যবস্থা করবেন এসব মানুষকে; কিন্তু যাদের রিফিউজি ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা আছে, তারা জানে সে কী ভয়াবহ জায়গা। তা থেকে হিটলারের ক্যাম্পের ইহুদিনিধন-শিবিরগুলোর দূরত্ব দু-পা মাত্র।

এসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই নিজেকে বললাম, ওরে মূর্খ, লোকের মুখের গুজব শুনলেই চলবে? কাকে কান (বড্ড ‘ক’ ধ্বনিটা এসে যাচ্ছে এ লেখায়) নিয়ে গেল বলে কাকের পেছনে দৌড়োবি? কেন, একটু পড়াশোনা করে দেখতে কী ক্ষতি? হায়, পড়াশোনা কবে ছেড়ে দিয়েছি, আবার এ বুড়ো বয়সে সেই ভীতিকর কর্ম? তা এখন পড়াশোনা করতে আর কোথায় যাব, গেলাম হাতের কাছে বিশ্বকোষ সেই উইকিপিডিয়ার কাছে। সেখানে ‘ক্যা’ (CA) আর ‘কা’ (CAA) বিষয়টা বুঝলাম একটু। দেখলাম, আমি যে ভয় করছিলাম সেটা খুব সম্ভবত ঠিক নয়। আমার নাগরিকত্ব না যাওয়ারই কথা। কেন, সেটা পরে বলছি। ‘ক্যা’ ছিল ‘নাগরিকত্ব আইন’ ১৯৫৫, ভারতীয় সংবিধানে বিধিবদ্ধ। তাতে জন্ম, বংশ, বিবাহ, স্বাভাবিকীকরণ (naturalization) ইত্যাদি কতভাবে ভারতের নাগরিক হওয়া যায় তার বিধান ছিল। তাতেও সমস্যা কিছু ছিল পাকিস্তানের নাগরিকদের নিয়ে, কিন্তু তা খুব প্রাসঙ্গিক নয়।

এখন ‘কা’ (CAA) ২০১৯ এসেছে ভারতে গত কয়েক বছরে ঢুকে পড়া বিদেশিদের ‘ভার্তীয়করণের’ আপাত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। এর উদ্দেশ্য, আপাতভাবে, অন্তর্ভুক্তি, বহিষ্করণ নয়। অর্থাৎ এর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ইত্যাদি দেশ থেকে নানা অত্যাচার ও নিপীড়নের ফলে যেসব ‘সেখানকার’ সংখ্যালঘু দেশ ছেড়ে অবৈধভাবে ভারতে এসে পৌঁছেছে, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া। বলে দেওয়া যে তোমরা আমাদের দেশেরই লোক, এখানে এসে পড়েছ বেশ করেছ, এখন এ মহান দেশে সুখে-শান্তিতে বাস করো। এখানে এই সেদিন অমৃত মহোৎসব হয়ে গেল, দ্যাখো সে অমৃতের ছিটেফোঁটা পড়ে আছে কিনা কোথাও। চমৎকার প্রস্তাব, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতিতে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন।

২.

এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। ইংরেজিতে যেমন বলে, So far, so good. কিন্তু এর এক জায়গায় খটকা বেধেছে। তা হলো, সেসব দেশের ‘সংখ্যালঘু’দের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ, শিখ, জৈন-এ চারটি ধর্মের লোকের কথা আছে, মুসলমানদের নাম নেই। তা এক দিক থেকে ঠিক, মিয়ানমার ছাড়া আর কোনো দেশে তো মুসলমান সংখ্যালঘু নেই। অন্য সব দেশ থেকে সংখ্যাগুরু মুসলমানরাও যে কেউ নানা কারণে (মূলত পেটের দায়ে) ভারতে আসতে পারেন, তা আমাদের শাসকরা ভাবেননি, এটা খুব আশ্চর্যের।

কিন্তু এখানেই ভারত সরকার একটা মুশকিলে পড়ল। মিয়ানমারে সামরিক শাসকদের অত্যাচারের ফলে হাজার হাজার আরাকানবাসী রোহিঙ্গা মুসলমান দেশ ছাড়া হয়ে বাংলাদেশে আর বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারতেও নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। মনে হয়, এ সংকট কাটানোর জন্যই প্রধানত ওই আইনের সংশোধন তৈরি করা হয়েছিল, যার সোজা অর্থ হলো, ভারতের মুসলমানের সংখ্যা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এমনিতেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আর তার দলবল ইসলাম সম্বন্ধে আতঙ্কে ভোগে, ইতিহাস থেকে মুসলমান শাসনের স্মৃতি মুছে দিতে চায় (এই সেদিন আহমেদাবাদ অহল্যানগর হলো বোধ হয়), কাজেই তার পক্ষে আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো বলা সম্ভব নয় যে, যারা আরও ভালো জীবন চাও তারা এসো আমার বুকে। বলা বাহুল্য, ওয়াল্ট হুইটম্যানের সুর ভারতের শাসনকর্তাদের বুকে বাজে না। তারা ভারতের একটি সীমাবদ্ধ চিত্রকল্প তৈরি করেছেন যে, ভারত মূলত অমুসলমান দেশ।

এই উইকিপিডিয়াতেই আর একটি মজার মামলার কথা পড়লাম। মহম্মদ কমর (Qamar) বলে একজন, তার ভারতেই জন্ম, ৭-৮ বছরে মায়ের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যায়, পরে পরিণত বয়সে ফিরে এসে ভারতে বিয়ে করে সংসার করতে থাকে, ছেলেপুলেও হয়। তারপর ভারতীয় পুলিশ তাকে ‘ক্যাঁক’ করে ধরে, অনুপ্রবেশকারী বিদেশি বলে এবং বিচারে সে সাত বছর জেল খাটে। তার ছেলেমেয়েরা হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করে। ততদিনে তার জেল খাটা হয়ে গেছে। এ আবেদনে সাব্যস্ত হয় যে, সে জন্মসূত্রে ভারতীয়, কাজেই তাকে অবৈধ ‘ঘুসবৈঠেঁ’ বিদেশি হিসাবে শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি।

‘কা’র ওই বিধানে বহিরাগতদের বা ভারতে আশ্রয়প্রার্থীদের ধর্মপরিচয়ের মধ্যে ইসলামের বহিষ্করণ নিয়ে এ প্রশ্নটি এখন অনেক ভারতীয়র মনকে তোলপাড় করছে। আমি জানি না, মতুয়ারা তাদের ধর্মকেও ওই সংস্করণে ‘বহিষ্কৃত’ দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন কিনা। কাকে কী প্রমাণ দেখাতে হবে সেও এক জটিল প্রক্রিয়া। আমি হয়তো বহিষ্কৃত হব না, কারণ আমার পূর্বপুরুষরা পূর্ববঙ্গে জন্মালেও তারা বুদ্ধিবিবেচনা করে হিন্দুই থেকে গিয়েছিলেন, রাজার ধর্ম গ্রহণ করেননি। তাদের মুসলমান প্রতিবেশীরাও ধর্মনির্বাচনে বা রক্ষণে কোনো বাধা তৈরি করেননি। শুধু দেশভাগের ভ্রষ্ট রাজনীতি এসে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। তার জন্য নেতারা যত দায়ী, মানুষ ততটা নয়।

সেসব দিনকে স্মরণ করে আর যে মানুষ এক মহাদেশে জন্মে, সারা পৃথিবীতে অবাধে ছড়িয়ে গেছে, রাজনৈতিক-ভৌগোলিক জাতিসত্তা বা স্টেট তৈরি হওয়ার আগে মানুষের এ অবাধ যাতায়াতের কোনো বাধা ছিল না। জাতীয়তার সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণ ঘটিয়ে আরও সমস্যা তৈরি হয়েছে, সীমানা শক্ত হয়েছে। তবু তো সৌদি আরবে না কোথায় হিন্দু মন্দির উদ্বোধন করে এলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। জানি না, এখনই আমাদের ভারতের সেই ‘দাদুর দস্তানা’র মতো অবস্থা হয়েছে কিনা, যাতে আমরা যে কোনো ধর্মের বহিরাগতদের ডাকতে পারব না, শুধু নির্বাচিত ধর্মের মানুষদেরই ডাকতে পারব। বাকিদের, শত বিপন্ন হোক, চুলোয় যাওয়ার বরাত দেব, and the Devil take the hindmost বলে!

৩.

ভাষার লোক হিসাবে আমি ভাবছিলাম যে, ‘নাগরিকত্ব’ কথাটার মধ্যেও একটা বহিষ্করণ আছে। মূল ‘সিটিজেনশিপ’-এর অনুবাদ করে নিয়েছি এটা, কিন্তু বাংলা কথাটায় নগরের গন্ধ যেন একটু বেশি। গ্রামের লোকেরা কোন্ অর্থে ‘নাগরিক’, কোন্ অর্থে ‘নাগরিক’ নয়? তারা যে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যান, সে কথা কে না জানে! জানি যে গ্রিক নগররাষ্ট্রের থেকে হয়তো এ নাগরিকতা কথাটা এসেছে, কিন্তু নাগরিকতার চরিত্র নির্ণয় কি আইন দিয়ে করা যায়? পৃথিবীর কোনো দেশ আর এখন এক ধর্মের নেই, এক ভাষার নেই, এক রঙের নেই। আমাদের নেতারা কথায় কথায় ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ বলে গাল ফুলিয়ে বক্তৃতা করেন, তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ‘কা’তেও এ নীতি কায়েম করুন।

পবিত্র সরকার : ভারতের খ্যাতনামা লেখক; সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

কর্কশ চ্যাঁচামেচি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম