ঈদ পোশাকের বাজার হোক দেশীয় উদ্যোক্তাদের
হাসান মামুন
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গেল ঈদে পোশাক কেনাকাটায় মানুষ কত ব্যয় করেছে, সেটা আলাদা করে খতিয়ে দেখা দরকার বৈকি। কারণ রোজার ঈদে যা কেনায় প্রায় সব শ্রেণির মানুষ সাধ্যানুযায়ী যোগ দেয়, তা হলো পোশাক। সবাই গয়নাগাটি কেনে না; সেলফোন না; সবাই বেড়াতেও যায় না, এমনকি গ্রামের বাড়িও যায় না সবাই; তবে সবাই কেনে বা কিনতে চায় পোশাক। ভিখিরিও চায় অন্তত তার সন্তানকে ফুটপাত থেকে একটা জামা কিনে দিতে। বিত্তবান অনেকে আবার এদের নতুন পোশাক দান করে থাকে। দানের এ অর্থনীতিও ক্রমে বাড়ছে। এ অবস্থায় গেল ঈদে শিশুদের জামা ও বড়দের শাড়ি-লুঙ্গি, থ্রি-পিসসহ পোশাক বিক্রি কতটা বাড়ল, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
রোজার শেষদিকে ঈদের পোশাক বেচাকেনা কেমন হচ্ছে, সে বিষয়ে কিছু রিপোর্ট হয়েছিল। ব্যবসায়ীদের কোনো কোনো সংগঠন তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী কিছু বক্তব্য দিচ্ছিল এ বিষয়ে। এটাও বলা হচ্ছিল, চলমান মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যপণ্য বাবদ নিয়মিত ব্যয় সামলে মানুষ তেমন কেনাকাটা করতে পারবে না। দুটির বদলে একটি জামা বা নিজেরা কিছু না কিনে শুধু সন্তানদের জামাকাপড় কিনে দেবে অনেকে-এমনটিও বলা হচ্ছিল। তাতে পরস্পরকে উপহার দেওয়ার প্রবণতাও কমার কথা। এ অবস্থায় ঈদের পোশাকের বাজার যতটা বাড়ার কথা বা বেড়ে আসছিল, সে প্রক্রিয়া কিছুটা স্তিমিত হওয়াই স্বাভাবিক। ঈদ পালনের পর এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলতে পারেন কিংবা তাদের কাছে জানতেও চাওয়া যেতে পারে, এবারকার অভিজ্ঞতাটি আসলে কেমন।
একটা সময় পর্যন্ত বলাবলি হতো যে, ঈদের পোশাকে আমরা বিপুলভাবে আমদানিনির্ভর। পাঁচ-সাত বছর আগে ঈদের সময়ে হওয়া রিপোর্ট পড়লেও দেখা যায়, এ বিষয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা কিছু অভিযোগ করছেন। তারা ক্রেতাদের বিষয়েও অভিযোগ করছেন যে, গুণমান বিবেচনা না করে, এমনকি বেশি দাম দিয়েও বিদেশি পোশাক কিনতে তারা উদগ্রীব। এমন অভিযোগও ছিল যে, ঈদের সময় আমদানির পাশাপাশি পোশাক চোরাচালান হচ্ছে। স্থলবন্দর দিয়েও অনেক পোশাক আসছে, যার যথাযথ রাজস্ব সরকার পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, এসব পোশাকের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া স্বভাবতই কঠিন। বলা বাহুল্য, বিশাল সীমান্তপথে ভারত থেকে পোশাক চোরাচালানের সুযোগ রয়েছে। মিয়ানমার থেকে ঈদের পোশাক আসার কথা অবশ্য শোনা যায়নি। পাকিস্তান থেকেও বরাবর অনেক পোশাক এসে থাকে ঈদে এবং দেশে এর ভালো বাজার রয়েছে। চীন, থাইল্যান্ড, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ থেকেও আসছে ঈদের পোশাক।
গেল ঈদে পোশাক খাতে ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে ধারণা দেওয়া হচ্ছিল। শেষতক সেটাই হয়ে থাকলে এ প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, কত টাকার ‘আমদানিকৃত পোশাক’ বিক্রি হয়েছে? ঈদের পোশাকে আমরা আর আগের মতো বিদেশনির্ভর নই, এ কথা ঠিক। তবে বিদেশনির্ভরতা কতখানি কেটেছে, সেটাও জানা প্রয়োজন। বেশ কবছর ধরে অনলাইনেও ঈদের পোশাকের কেনাকাটা বেড়ে চলেছে। ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকার পোশাক বেচাকেনা হয়ে থাকলে অনলাইনে কত হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে? কী না বিক্রি হচ্ছে অনলাইনে! বিদেশি পোশাকও বেচাকেনা হচ্ছে ঈদে। গতানুগতিক ব্যবসায়ীদের মতো এরাও রোজার ঈদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তাদেরও বিক্রি নাকি অনেক বেড়ে যায়। কোনো কোনো ঈদের বাজারে তো এমন কথাও রটে-অনলাইন ব্যবসায়ীদের কারণে শপিং মলে লোকের উপস্থিতি কম! এ অবস্থায় বড় ফিজিক্যাল স্টোরগুলোও অনলাইনে বিক্রি বাড়ানোর সুযোগ নিতে চাইছে।
যা হোক, ফুটপাত থেকে শপিংমল ও অনলাইনে ঈদের পোশাকের বিক্রি এবার কেমন হলো, এর একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া দরকার। আমদানির পাশাপাশি বিভিন্ন অস্বচ্ছ উপায়ে আরও কত পোশাক এসে বিক্রি হয়েছে, এর চিত্রটাও পেতে হবে। এবার ঈদের বাজারে কিন্তু নববর্ষের পোশাকও বিক্রি হয়েছে; যেহেতু ঈদের শেষেই ছিল উৎসবটি। এ উপলক্ষ্যেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পোশাক বেচাকেনা হয় এবং এ অর্থনীতিও বাড়ছে। তবে এবার এটি কিছুটা মার খাওয়ার কথা। মাঝে দুবছর করোনা পরিস্থিতিতে নববর্ষের পোশাক ব্যবসা মার খেয়েছিল। এটা ঘিরে দেশীয় বুটিক হাউজগুলো বরাবর ভালো ব্যবসা করে। করোনায় তারা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এবার তারা কেমন ব্যবসা করতে পেরেছে, সেটাও পৃথকভাবে জানতে পারলে ভালো। তাদের বিশেষ কিছু ‘পেইন’ রয়েছে। বিশেষত ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা মেয়েদের পোশাকের সঙ্গে এরা পাল্লা দিয়ে পারছে না ঈদে। নববর্ষের বাজারে হয়তো পারছে। মাঝে বুটিক হাউজের যেমন বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছিল, সেটি সাম্প্রতিককালে স্তিমিত বলেও মনে হয়। এ অবস্থায় তাদের বক্তব্য শোনা দরকার। তাদের ব্যবসার নেপথ্যে অনেক উৎপাদক আর কর্মী কিন্তু জড়িত।
অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর মতো ঈদের পোশাকের দামও বেড়েছে। আগেরবারও বেড়েছিল। এবার হয়তো বৃদ্ধির হারটা বেশি। পোশাক তৈরির উপকরণসহ মজুরি বাড়লে উৎপাদিত পণ্যে এর প্রভাব পড়বেই। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার সঙ্গে এর প্রাপ্যতা আবার কমেছে। বেড়েছে পরিবহণ ব্যয় ও স্পেস ভাড়া। পোশাক উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতদের কি বোনাসও দিতে হয় না? এসব কারণে ঈদে পোশাকের দাম বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে এ অভিযোগ এখনো ওঠে-অনেক ক্রেতা অন্য সময়ে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ঈদের বাজারে দেশীয় পণ্য কিনতে উৎসাহী নয়। দেশে উৎপাদিত পোশাকের মানের বিষয়ে অভিযোগ কিন্তু কমে এসেছে। তারপরও বিশেষত বিত্তবানরা দোকানে এসে বিদেশি পোশাক খোঁজেন। একেক ঈদে বিচিত্র নামের বিদেশি পোশাক নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হতেও দেখা যায়। এ অবস্থায় শুধু অভিযোগ না করে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কি উচিত নয় এর কারণ খতিয়ে দেখা? বাজার অর্থনীতিতে বিপজ্জনক বাদে কোনো পণ্য আমদানি তো বন্ধ করা যায় না। আমরাও আমেরিকাসহ অনেক দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করি এবং এটা আরও বাড়াতে চাইছি। এখানে চাহিদা থাকলে ভারত, পাকিস্তান ও চীন কেন চাইবে না ঈদের পোশাক পাঠাতে? ঈদে আমাদের চাহিদার প্যাটার্ন বিচার করেও তারা পোশাক তৈরি করে পাঠাচ্ছে বলে জানা যায়। মজবুত নেটওয়ার্কও গড়ে তুলেছে। এদেশের অনলাইন ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত।
এবার নাকি পাকিস্তানি থ্রি-পিস বেশি বিক্রি হয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো কারণ যুক্ত হয়েছে কিনা, কে জানে। তবে শাড়ির ব্যবহার কমে থ্রি-পিস ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে ঈদে এর বাজারটা আমরা দখলে নিতে পারছি না কেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আর শিশুদের পোশাকের বাজারে চীনা পণ্যের দাপটের কথা কেন এখনো শোনা যায়? আমরা তো বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। তবে যেসব পোশাক ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাই, সেগুলো ভিন্ন প্রকৃতির। আবার কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে বিশেষ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলো বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করে জনসাধারণের ব্যবহার্য পোশাক। অনেক ক্ষেত্রে তারা বিদেশে উৎপাদিত কাপড়ও ব্যবহার করে বানায় ‘দেশীয় পণ্য’। আবার দেশে উৎপাদিত কাপড়ে পোশাক বানিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের সিল মেরে দেয়। যা হোক, এদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা তৈরি হয়েছে ভালোই। অস্বচ্ছভাবে আসা পোশাকের সঙ্গেও পাল্লা দিতে এরা সক্ষম। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের নিয়মিত পোশাকের চাহিদাও মেটাচ্ছে তারা ভালোভাবে। ঈদের বাজারেও এদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পোশাকে আমদানিনির্ভরতা এরা কমিয়ে এনেছে অনেকখানি।
বিত্তশালীদের পোশাকের চাহিদা মেটাতে দেশে কিছু ব্র্যান্ড শপও গড়ে তোলা হয়েছে। এদের কেউ কেউ আবার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। দেশেও ক্রমবিকাশমান বাজার দেখে তারা সেটা ধরতে চাইছে। তবে এরাও ঈদের বাজারে বিদেশ থেকে আসা পোশাকের সঙ্গে তেমন এঁটে উঠতে পারছে না। শুধু আমদানিকৃত পোশাকের ব্র্যান্ড শপও গড়ে উঠেছে বড় বড় শহরে। ঈদে তাদের বিক্রিও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। এরই মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদকরা অবশ্য এগোচ্ছে জোরালোভাবে। যেমন, পাঞ্জাবির ক্রমবর্ধমান বাজারে অনেক উদ্যোক্তা সাফল্য দেখাচ্ছে। অর্জন করছে ক্রেতাদের আস্থা। শাড়ি-লুঙ্গি উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত এলাকাগুলোয়ও ‘ঐতিহ্যের নবায়ন’ হচ্ছে। ঈদের বাজারে এদের আরও জোরালো অংশগ্রহণ দেখতে চাইব। মানসম্মত জাকাতের কাপড় উৎপাদনেও এসব উদ্যোক্তাকে আমরা নিশ্চয়ই কাজে লাগাতে পারব আরও ভালোভাবে।
নিকটেই যে আরেকটি ঈদ রয়েছে, তাতে কুরবানির পশু কিনতেই মানুষ অর্থ ব্যয় করবে প্রধানত। পোশাক ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর কেনাকাটা তখন কম হবে। পরবর্তী রোজার ঈদ আসতে আসতে আমরা তাহলে দীর্ঘ সময় পাচ্ছি এর পোশাক বাজারের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করতে। ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকার পোশাকের বাজার তো চাট্টিখানি কথা নয়। সারা বছরের প্রায় ৫০ শতাংশ পোশাক বেচাকেনা নাকি হয় রোজার ঈদেই। কিন্তু এ বাজারের একটা বড় অংশ এখনো বিদেশি পোশাকের দখলে। এজন্য তো দুষ্প্রাপ্য ডলারও ব্যয় হচ্ছে; দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। এ অবস্থায় আমাদের জোর প্রস্তুতি নেওয়া দরকার রোজার ঈদের ক্রমবর্ধমান পোশাক বাজারটির অন্তত ৮০ শতাংশ দখলে নেওয়ার। ‘হাই এন্ডের’ কিছু পোশাক না হয় এলো বিত্তবানদের জন্য। আমদানিকারকদেরও তো ব্যবসা হতে হবে। তবে ঈদের পোশাকে থেকে যাওয়া আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে হবে আমাদের। এটা আত্মমর্যাদারও প্রশ্ন।
আমরা কিন্তু অনেক পণ্যেই আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে উঠেছি ক্রমে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সংযোজিত পণ্যও কম নেই। ঈদের পোশাকে আমাদের মূল্য সংযোজন কিন্তু অনেক বেশি হবে; যেহেতু এরই মধ্যে দেশে বস্ত্রশিল্পেরও বিকাশ ঘটেছে। ঈদসহ পালা-পার্বণে গজ কাপড় আমদানিও কমাতে হবে।
হাসান মামুন : সাংবাদিক, বিশ্লেষক
