তীব্র দাবদাহ ও শহরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি
সামশাদ নওরীণ
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সারা দেশে চলছে মধ্য থেকে তীব্র দাবদাহ। যেখানে বৈশাখের আগাম বার্তায় পাওয়া যায় কালবৈশাখীর আভাস, সেখানে তীব্র ও অসহনীয় তাপমাত্রা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে করছে ব্যাহত। গত কয়েক দশকের মধ্যে ২০২৩ সাল ছিল প্রচণ্ড দাবদাহের বছর। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি বছরে আগের যে কোনো তাপমাত্রা এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের রেকর্ড ভঙ্গ হবে। গত ত্রিশ বছরে শুধু ঢাকার তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি হলে স্বাভাবিক মানুষের শারীরিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং যে কোনো অতিরিক্ত তাপমাত্রায় শরীরে অভিযোজন প্রক্রিয়া তৈরি হতে কয়েক প্রজন্মের প্রয়োজন হয়, সেখানে ঢাকার বর্তমান তাপমাত্রা কয়েক সপ্তাহ ধরে ৩৫-এর উপরে রয়েছে এবং বৃষ্টিপাতের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রয়েছে হিট অ্যালার্ট গোটা দেশে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বাড়ে হিট স্ট্রোকের প্রবণতা। এর ফলে বিভিন্ন বয়সের এবং শ্রেণি-পেশার মানুষকে নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, পেটের সমস্যা, খিঁচুনি, পেটে গ্যাসের সমস্যা ও পাতলা পায়খানা, হৃদরোগ এবং অন্যান্য অসুখের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। তীব্র দাবদাহের কারণে মানুষের নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত পানীয় সেবন, স্বাভাবিক কার্যকলাপের বৈপরীত্য দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটে। ক্ষেতে-খামারে কাজ করা কৃষকদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। রান্নাঘরে কর্মরত নারীদের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, একে তো গরম, অন্যদিকে দেশে রান্নাঘর বদ্ধ পরিবেশে তৈরি হওয়ায় তাপ আরও বেড়ে যায়।
দেশে কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অপ্রতুলতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থান নেমে যাচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে না। একই সঙ্গে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতির পাশাপাশি শহরের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়ছে। এছাড়া শহরাঞ্চলে গাছপালা ও জলাশয়ের অভাব, কংক্রিটের অবকাঠামোর আধিক্যের কারণে শহরে হিট আইল্যান্ড তৈরি হয়। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে গ্রিনহাউজ এফেক্ট বাড়তে থাকে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতেই থাকে। যদিও এ হিট আইল্যান্ডে একটি অভ্যন্তরীণ বায়ু প্রবাহিত হয়, সেটি যদি বিষাক্ত অথবা গরম বাতাস সংবলিত হয়, সেক্ষেত্রে শহরবাসীর জন্য ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের চেয়ে শহরের আশপাশের বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকায় তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি কম থাকে। শহরে যেহেতু বেশি মানুষ থাকে, সেহেতু সেখানে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চলে এবং বাইরে কায়িক শ্রমিকও বেশি দেখা যায়। তাই অতিরিক্ত দাবদাহে মানুষের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। আর তাৎক্ষণিক মৃত্যুঝুঁকি না থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যেতে থাকে।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মাইক্রো অর্গানিজমের বিস্তার অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। কারণ বেশি তাপমাত্রা মাইক্রো অর্গানিজম বৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। এর ফলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ বিস্তার লাভ করে তীব্র দাবদাহ। অন্যদিকে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুখ বাড়তে থাকে। অনাবৃষ্টি পারটিকুলেট ম্যাটার বা পিপিএমের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে দেয়। এ পিপিএম শুধু যে শ্বাসকষ্টেরই কারণ হয় তাই নয়, এটি মানুষের দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের অসুখ বা জটিলতা সৃষ্টি করে। দাবদাহের মধ্যে বসবাস করায় মানুষের মানসিক অবসাদ এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। এতে মন-মেজাজ খারাপ হতে শুরু করে। অনেকের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা দেখা যায়।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাংলাদেশের মতো আর্দ্রতাপূর্ণ দেশে দাবানলের সৃষ্টি করে না; কিন্তু দাবদাহপূর্ণ এলাকায় যদি আগুন লাগে, তাহলে তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। দাবদাহ থেকে বাঁচার জন্য জলাধারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৮০ শতাংশ কমেছে। এর প্রধান কারণ ভূমি দখল ও অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা।
বস্তুত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণেই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এ ধারা দেখে প্রতীয়মান হয়, আগামী ১০০ বছরে বাংলাদেশের বেশির ভাগ এলাকার তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে এবং খরাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ বাড়বে। অন্যদিকে অনুভূত তাপমাত্রার পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে। একই সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর অন্যান্য নিয়ামকের পরিবর্তন হবে। ফলে অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়ের আধিক্য, অসহিষ্ণু জলবায়ু, বজ্রপাত, বায়ুদূষণ থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের দূষণের মাত্রা বেড়ে যাবে। অন্যদিকে নদীর নাব্যতা ব্যাহত হয়ে পানি দূষণের মাত্রা বেড়ে যাবে।
এ তীব্র দাবদাহ থেকে এখনই উত্তরণের জন্য সবুজায়ন, নিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, জলাশয় উন্মোচন করা অতি জরুরি। এছাড়া প্রচুর পানি, বিশেষ করে মিনারেলসমৃদ্ধ পানি পান করতে হবে। গোসল করতে হবে। রোদে উন্মুক্ত স্থানে চলাচল যথাসম্ভব কমানো প্রয়োজন। শিশুদের স্কুলে নিয়ম করে পানি পান করার তাগিদ দেওয়া, বয়ঃবৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েদের তরল খাবার খাওয়ানোর বিকল্প নেই। এমনকি শারীরিকভাবে শক্তিশালী মানুষদেরও নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা যেন দাবদাহের ফলে অভিযোজনের অযোগ্য হয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খেটে খাওয়া দিনমজুরদের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা, পোশাক নির্বাচনে যত্নশীল হওয়া বর্তমান অবস্থায় অতি প্রয়োজন। তবে তীব্র দাবদাহে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অভিযোজনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশমনেরও দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। এর ফলে আমরা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মতো একটি পৃথিবী পাবো এবং পরবর্তী প্রজন্মকে একটি আবাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে পারব।
সামশাদ নওরীণ : সহযোগী অধ্যাপক, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
