মিঠে কড়া সংলাপ
দেখে এলাম সেই মূল্যবান কোহিনুর
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পথে এক সপ্তাহ লন্ডনে থেকে এলাম। তবে এবারের লন্ডন ভ্রমণ আমার জন্য তেমন সুখকর ছিল না; কারণ, এপ্রিলের শেষেও সেখানে প্রচণ্ড শীত থাকায় আমাদের শীতের মধ্যেই চলাফেরা করতে হয়েছে। তাছাড়া প্রায়ই বৃষ্টিসহ প্রচণ্ড বাতাস থাকায় কনকনে ঠান্ডায় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেত। এ অবস্থায় চলাফেরা আরামদায়ক না হলেও আমরা ঘরে বসে না থেকে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যতদূর সম্ভব এখানে-সেখানে ঘুরে বেরিয়েছি। আমরা মানে আমি এবং আমার স্ত্রী। এবার নিয়ে আমার জন্য তৃতীয় দফা ইংল্যান্ড ভ্রমণ হলেও আমার স্ত্রীর জন্য তা ছিল প্রথম। ফলে তাকে নিয়ে অন্তত লন্ডন শহরটা আমাকে বেশ ভালোভাবেই ঘুরতে হয়েছে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা হেঁটে ঘুরেছি বলে আমাদের সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই হয়েছে। আমার জন্য বেশ বড় যে অসুবিধাটি ছিল তা হলো, ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় ইংলিশম্যানদের বেপরোয়া সিগারেট ফোঁকার ধোঁয়া আমাকে ভীষণভাবে বিব্রত করেছে। ইংরেজরা যে রাস্তাঘাটের মতো খোলা স্থানেও এত বেশি সিগারেট টানে এর আগে তা আমি দেখতে পাইনি। যা হোক, এমন একটি অসুবিধাসহ সবচেয়ে বড় অসুবিধা ছিল বৃষ্টি এবং সেইসঙ্গে বাতাস। বৃষ্টির কারণে আমরা ট্যুরিস্ট বাসের খোলা ছাদে বসেও ভ্রমণ করতে পারিনি। দোতলা বাসের ডাউন স্টেয়ারে বসে আমাদের লন্ডন শহর ঘুরতে হয়েছে।
এবারে লন্ডন গিয়ে আমার সবচেয়ে বড অর্জন হলো, ‘কোহিনূর’ ডায়মণ্ড স্বচক্ষে দেখা! যে কোহিনূর হীরা নিয়ে এত কিছু, এত কথা, সেই হীরকখণ্ডটি আমার দেখার খুব ইচ্ছা থাকায় গতবার লন্ডন ভ্রমণের সময় যেসব জাদুঘরে আমি ঢুকেছিলাম, সেসব স্থানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমি তার সন্ধান না পেয়ে অনেকটা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছিলাম। এ অবস্থায় এবারে আটঘাট বেঁধে খোঁজ করে জানতে পারলাম কোহিনূর হীরা লন্ডন টাওয়ারব্রিজ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। খবরটি পাওয়ার পর কালবিলম্ব না করে টাওয়ারব্রিজ জাদুঘরে পৌঁছে বৃষ্টির কবলে পড়ায় ছাতা মাথায় হাঁটা রাস্তাটুকু পার হয়ে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দেখি সেখানে বিরাট লাইন। ভাবলাম, একটু বসে চা-কফি একটা কিছু খেয়ে ভিড় কমলে টিকিট কাটব। সে অনুযায়ী, একটি দোকান থেকে ফিশফ্রাই এবং কফি কিনে সামনের বেঞ্চে বসে দুজন খেয়ে তারপর উঠে গিয়ে দেখি, টিকিটের লাইনের ভিড় না কমে বরং সে লাইন আরও লম্বা হয়েছে! আর অপেক্ষা করা বোকামি হবে ভেবে স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে ছাতা নিয়ে আমি দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম এবং পনের মিনিট পর দুটি টিকিট নিয়ে আমরা মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম।
সেখানে ঢোকার পর দেখলাম, বাইরে থেকে অতটা বোঝা না গেলেও ভেতরে বিশাল এলাকাজুড়ে মিউজিয়ামটির অবস্থান। ইংল্যান্ডের রাজা-রানিদের পোট্রেট, পোশাক-পরিচ্ছদ, তরবারি, যুদ্ধাস্ত্র কী নেই সেখানে! বিশেষ করে মহারানি ভিক্টোরিয়া, রানি এলিজাবেথের ব্যবহার্য অনেক কিছুই সেখানে সংরক্ষিত আছে, যা দেখতে পুরো একটা দিন লেগে যাবে। এ অবস্থায় প্রায় ঘণ্টাখানেক এসব এটা-সেটা দেখে খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ায় একজন জাদুঘর কর্মীকে ‘কোহিনূর’ ডায়মন্ড কোথায় জিজ্ঞেস করায় তিনি বিশাল দুর্গের মতো অপর একটি ভবন দেখিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি আমরা সেদিকে ছুটলাম।
দুর্গের মতো ভবনটির কাছে গিয়ে দেখি সেখানে লোকে লোকারণ্য। প্রায় পাঁচশ লোক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং সে লাইনটি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন লাইনের মতো পেঁচানো। আমরা গিয়ে যখন লাইনে দাঁড়াই, সে মুহূর্তে লোক ঢোকা বন্ধ করে রাখা হয়েছে, কারণ ভেতরে লোকে ঠাসা। অতঃপর কিছু লোক সেখান থেকে বের হয়ে গেলে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হলো।
এবারে আমরা যেখানে ঢুকলাম সে স্থানটি হীরা, জহরত, মণি-মানিক্যময়। রাজা-রানির মণিমানিক্যখচিত পোশাক-পরিচ্ছদ, তরবারি, পিস্তল, বন্দুক ইত্যাদি দিয়ে ভরা ভবনটি ঘুরতেও অনেক সময় লেগে গেল। ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে আমরা বহু কাঙ্ক্ষিত সেই ঘরে প্রবেশ করলাম, যেখানে ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া কোহিনূর নামক হীরকটি সংরক্ষিত আছে। মণিমানিক্য, জুয়েলারিসমৃদ্ধ ঘরটিতে বেশ কয়েকটি মুকুট রয়েছে, যার প্রতিটির শীর্ষে একটি করে বড় আকৃতির হীরা শোভা পাচ্ছে। একলাইনে সাজিয়ে রাখা এমন ৫/৬টি মুকুটের সর্বশেষ মুকুটটিই হলো ‘কোহিনূর’ হীরকখচিত এবং সব মুকুটের মাথার সম্মুখভাগে একটি করে বড় আকৃতির হীরা থাকলেও তন্মধ্যে কোহিনূরই সবচেয়ে বড়। তাছাড়া কোহিনূরখচিত মুকুটের লাইনেই একটি ব্রেসলেট সাজিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেই ব্রেসলেটেও একটি বড় হীরা সংযুক্ত করা আছে, আর সেই হীরকটির নামও কোহিনূর বলে জানা গেল। এ পর্যন্ত পাওয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হীরকখণ্ডটিও এ মিউজিয়ামে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যা দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃক শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসাবে ইংল্যান্ডকে দেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃক প্রদত্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরকখণ্ডটি কোনো মুকুট বা অন্য কোনো পরিচ্ছদে সংযুক্ত না করে অবিকল এবং আনপালিশড্ অবস্থায় রাখা হয়েছে বলে তা দিয়ে আলো ঠিকরে বেরিয়ে দ্যুতি ছড়াচ্ছে না। তবে ভারত থেকে নেওয়া কোহিনূরকে ক্রিস্টাল কাটিং করে রানির মুকুটে লাগানোর ফলে সেখান থেকে দ্যুতিময় আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, আমাদের মোবাইলসহ ভেতরে ঢুকতে দিলেও প্রতিটি কক্ষে ‘নো ফটোগ্রাফি’ লেখা থাকায় কাউকে ফটো নিতে দেখা গেল না। তবে সে ক্ষেত্রে আমি খানিকটা সাহসিকতা এবং স্কুব নিউজ সংগ্রহের মানসিকতা নিয়ে গোয়েন্দার মতো পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হীরকখণ্ড এবং আর্মলেটে সংযুক্ত কোহিনূরের ছবি আমার মোবাইলে ধারণ করে ফেললাম। কিন্তু রানির মুকুটে সংযুক্ত কোহিনূরের ছবিটি ধারণ করার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করার দৃশ্যটি মিউজিয়ামে কর্তব্যরত এক ব্যক্তি দেখে ফেলায়, সেখান থেকে সরে এসে একটি পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে রানির মুকুটের কোহিনূরের ছবি ধারণ করতে জনৈক দর্শনার্থীর পায়ের ফাঁক দিয়ে শটটি নেওয়ার ফলে ছবিটি তেমন সুবিধাজনক হলো না বলে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাছাড়া মুকুটের কোহিনূর হীরক থেকে অতি উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় আলো ঠিকরে পড়ায় ছবিটি একটি ডিম্বাকার লাইটের মতো দেখাল। সে অবস্থায় মিউজিয়াম থেকে বের হয়েই বৃহৎ হীরকখণ্ড, আর্মলেটে সংযুক্ত কোহিনূর এবং রানির মুকুটে সংযুক্ত কোহিনূরের তিনটি ছবি আলাদা স্থানে সংরক্ষণ করে ঘরে ফিরে এলাম।
টাওয়ারব্রিজ মিউজিয়াম দর্শনের পরদিন আমরা লন্ডন সিটি থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা ট্রেন জার্নি করে উইন্ডসর সিটিতে পৌঁছে গেলাম। আর সেখানকার মূল আকর্ষণ ছিল উইন্ডসর ক্যাসল্ পরিদর্শন করা। উইন্ডসর পৌঁছেও আমরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে দুর্গের ভেতর প্রবেশ করে ৯০০ বছরের পুরোনো অসাধারণ দুর্গটি দেখা শুরু করলাম। উইন্ডসর দুর্গ হলো রানির প্রাতিষ্ঠানিক একটি বাসভূমি এবং বিশ্বের বৃহত্তম কার্যরত (অফিশিয়াল) দুর্গ। এখানে বিশ্বের বিরল শিল্পকর্ম ও চিত্রাঙ্কন রয়েছে। এ দুর্গের ভেতরে অত্যাশ্চর্য আসবাবপত্র, চিনামাটির বাসন ইত্যাদি রক্ষিত আছে।
উইন্ডসর দুর্গের সেন্ট জর্জেস কক্ষে ইংল্যান্ডের রানি একটি ঐতিহ্যগত রাষ্ট্রীয় ভোজসভার আয়োজন করেন, যা দেখার মতো একটি দৃশ্য! এ সময় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি ব্যক্তি রাজকীয় ঘোড়াগাড়ি করে এ অসাধারণ দুর্গোৎসব দেখতে আসেন। এ দুর্গের অভ্যন্তরীণ রাজকীয় সাজসজ্জা ছাড়াও দর্শক এখানে চেঞ্জিং গার্ড প্রদর্শনী দেখতে পারেন; যা এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত একদিন অন্তর প্রদর্শিত হয়।
উইন্ডসর ক্যাসেল পরিদর্শন শেষে আমরা টেমস্ নদীর অপর পারে অবস্থিত ঐতিহাসিক ইটন কলেজ পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা নাগাদ লন্ডন ফিরে আসি। ইটন কলেজটিও ইংল্যান্ডের একটি দর্শনীয় স্থান। উইন্ডসর, বার্কশায়ায়ারের কাছে ইংল্যান্ডের বৃহত্তম স্বতন্ত্র এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহু নামিদামি ব্যক্তি অধ্যয়ন করেছেন, যাদের মধ্যে জর্জ অরওয়েলসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি রয়েছেন।
এবারে ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় আরও কিছু স্থান পরিদর্শন করলেও স্থানাভাবে এখানে তা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। কারণ, এক সময়ে যাদের সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত ঘটত না, তাদের দেশ এবং রাজধানীতে যে অনেক কিছু দেখার এবং সেসব নিয়ে অনেক কিছু বলার আছে, সে কথাটি বলাই বাহুল্য। এ অবস্থায়, আমাদের ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের নিয়ে যাওয়া কোহিনূর হীরক সম্পর্কে সংক্ষেপে আরও দু-একটি কথা বলেই লেখাটি শেষ করব।
‘কোহিনূর’ হীরকখণ্ডটি বর্তমান ভারতের হায়দারাবাদ রাজ্যের কুল্লুর খনি থেকে উত্তোলিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন হাত ঘুরে শিখ সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। অতঃপর দ্বিতীয় ব্রিটিশ-শিখযুদ্ধে ১৮৫০ সালে ব্রিটিশরা শিখ সাম্রাজ্য দখল করে নেওয়ার পর লর্ড ডালহৌসির সঙ্গে লাহোর চুক্তি অনুযায়ী শিখ সাম্রাজের সব সম্পত্তি মহারানি ভিক্টোরিয়াকে সমর্পণ করা হলে কোহিনূর হীরকটিও ব্রিটিশদের দখলে চলে যায়। তারপর যদিও ১৯৪৭ বা ১৯৮১ সালে ভারত, ইরান, আফগানিস্তান, এমনকি বাংলাদেশও এ হীরক দাবি করে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছে; ব্রিটিশ সরকার লাহোর চুক্তির দোহাই দিয়ে সেসব দাবি নাকচ করে দিয়েছে। সুতরাং, ‘কোহিনূর’ লন্ডনের টাওয়ারব্রিজ মিউজিয়ামেই আছে এবং থাকবে এবং আমাদের কেউ কেউ হয়তো সেখানে গিয়ে টিকিট কেটে তা দেখে আসতে পারব।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
