|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জীবদ্দশায় মানুষ যেমন তার মানবিক গুণাবলি ও কল্যাণমূলক কাজের জন্য হতে পারেন সম্মানিত, তেমনি মৃত্যুর পরও মানুষ তার ত্যাগ দিয়ে হয়ে উঠতে পারেন এক জ্বলন্ত মানবিকতার উদাহরণ। মৃত্যুর কিছু দিন আগেই সন্ধানীতে চক্ষুদান করে গিয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদপুরুষ- বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনো। এর কিছু দিন আগে সন্ধানীতে চক্ষুদান করেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস। তার চোখে এখন পৃথিবী দেখছে রংপুরের মশিউর রহমান এবং চাঁদপুরের আবুল কালাম। সন্ধানী বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ চক্ষুদাতা সালেহা সুলতানের কাছে, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির পুরোধা, সমাজসেবিকা এবং সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যার চোখে আলো ফিরে পেয়েছে ময়মনসিংহের খোকন রবি দাস এবং বগুড়ার তানিয়া আক্তার। জনকণ্ঠের সম্পাদনা পরিষদের সহকারী হারুনুর রশিদের চোখে পৃথিবী দেখছেন কেরানীগঞ্জের মুকিম শেখ এবং দাউদকান্দির আরব আলী। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আমরা যে সৈনিকদের কাছে কৃতজ্ঞ, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন। সেই মহান ভাষাসৈনিকের চোখে পৃথিবী দেখছে এখন রেশমা। আর সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য যিনি বাংলাদেশের প্রথম ক্যাটাবারিক অর্গান ডোনেশনকারী, যার দুটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে দুজন কিডনি রোগীর শরীরে, আবার তার দুটি চোখে দেখছে ফেরদৌসী আক্তার ও সুজন। আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে আমাদের মাঝে, যারা তাদের জীবনের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছে এ দেশের মানুষকে। এ সারিটা আরও অনেক লম্বা, তাদের নাম না লিখলেও তাদের প্রতি আমাদের অবিরাম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
সন্ধানীতে যাদের চোখদান করা আছে তাদের প্রতিও ভালোবাসা অবিরাম। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ডাক্তার দীপু মনি এমপি, আ ক ম মোজাম্মেল হক। এছাড়া আছেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, বাঁধন, কণ্ঠশিল্পী মেহেরিনসহ অনেকেই। বাংলাদেশের ১৪ লাখ অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে ৫ লাখ কর্নিয়াজনিত অন্ধ। বাংলাদেশে যেহেতু কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব নিয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তাই আমরা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে তুলনামূলক আলোচনা করছি। এ পাঁচ লাখ অন্ধ মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে হলে বর্তমানে দেশের যে পরিমাণ কর্নিয়া পাওয়া যায় এবং কর্নিয়ার অপারেশন হয়, তাতে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার বছর লাগবে। এ যুগে এসে এত মানুষকে অন্ধত্বের মধ্যে রেখে আমরা আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক কোনো মানদণ্ডেই নিজেদের উন্নত বলে দাবি করতে পারি না। তাই এ জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই, অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাই; তাহলে আমাদের অবশ্যই তাদের অন্ধত্ব নিবারণ করতে হবে এবং এটা নিয়ে ভাবতে হবে। আসুন আমরা আলোচনা করি কীভাবে কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং কীভাবে তাদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়?
সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ১৯৮৪ সাল থেকে এ অন্ধত্ব নিবারণের জন্য নিরলস কাজ করে আসছে। ৪০০০-এর অধিক কর্নিয়া কালেকশন করেছে এবং সাড়ে তিন হাজারের মতো কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষের চোখে আলো ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশাল এ অন্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য এ পরিসংখ্যানটা মোটেও কোনো রিমারকেবল সফলতা নয়। কর্নিয়া সংগ্রহ বাড়াতে হলে আমাদের কিছু স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা : ১. হাসপাতালে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের কাছে কর্তব্যরত চিকিৎসক নার্স ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা কর্নিয়ার জন্য আবেদন করা এবং হাসপাতাল থেকে কর্নিয়াটি সংগ্রহ করে তা আই ব্যাংকে প্রেরণ করা।
২. এক্সিডেন্টাল ডেথ কিংবা পোস্টমর্টেম হওয়া মরদেহ থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে প্রচুর পরিমাণে কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব। তাহলে অন্ধ ব্যক্তির চোখে তা সংযোজনের মাধ্যমে তাদের সুন্দর পৃথিবী দেখানো সম্ভব।
৩. যারা সচেতন তারা হাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে মৃত্যুর পর আবেদন করতে পারেন চোখের জন্য। তারা চোখ দিতে রাজি হলে সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংককে খবর দিলে দ্রুত তা সংগ্রহ করা।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : ১. পাঠ্যপুস্তকে চোখদান বা আই ডোনেশন সম্পর্কে গল্প অথবা প্রবন্ধ সংযোজন করা। বিখ্যাত চক্ষুদাতাদের গল্পগুলো সংযোজন করা হলে ছোট ছোট কমলমতি শিশু বুঝতে পারবে চক্ষুদান একটি ভালো কাজ।
২. ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদিতে চক্ষুদানের বিষয়ে একটি কলাম উল্লেখ রাখা, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রয়েছে।
৩. ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইমামদের যারা ট্রেনিং করছে তাদের অবহিত করা যে, মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই এবং এ কথাটি যাতে তারা মসজিদে মসজিদে প্রচার করেন খুতবার সময়। এতে করে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নেবেন।
আইনি সহযোগিতা : ২০১৮ সালের মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি চক্ষুদানের ক্ষেত্রে অনেকটা সহযোগী, যা মানবদেহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ সংশোধন কল্পে প্রণীত হয়েছে। এখানে অনেক কিছুই সহজীকরণ করা হয়েছে। তারপরও এক্সিডেন্টাল ডেথ অর্থাৎ যে মরদেহগুলোর পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন হয়; এগুলোর থেকে চোখ নেওয়ার বিষয়টি সংযুক্ত করলে আরও অধিক কর্নিয়া সংগ্রহের পথ উন্মুক্ত হবে এবং এ দেশের যে ৫ লাখ কর্নিয়াজনিত মানুষ রয়েছেন, তারা অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন।
সভাপতি : সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক
