স্মরণ
জিয়াউর রহমান : একটি সামগ্রিক পর্যবেক্ষণ
কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আজ শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর-উত্তমের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে আজ তিনি ৮৮ বছরে পা রাখতেন। মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের ৮ম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় একজন রাষ্ট্রপতি; যা প্রমাণিত হয়েছে তার জানাজায় সাধারণ মানুষের কান্নার রোল এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে। তার মৃত্যুর ৪৪ বছর পরও তার প্রতিষ্ঠিত দলটি বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় দল। এ কথা সর্বজনবিদিত; একজন বাঙালি হিসাবে জিয়াউর রহমান তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে অসাধারণ সাহসী ও দেশপ্রেমিক অফিসার হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন।
২. পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ১৯৬৫ সালের পূর্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের প্রবেশাধিকার ছিল খুবই সীমিত। ক্যাডেট কলেজ থেকে একাডিমেক রেজাল্টের মেধা তালিকার শীর্ষস্থান অধিকারীদের অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাই ও সর্বদিক বিচার-বিবেচনা করে সামরিক বাহিনীতে নির্বাচিত করা হতো। আর ১৯৫৩ সালে তো সেটা আরও কঠিন ছিল। কিন্তু ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির ১২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে জেনারেল জিয়া, জেনারেল সফিউল্লাহ, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল হামিদ, সাবেক কেবিনেট সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ হায়দার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ আবদুল হান্নান, মেজর জেনারেল আল মামুনসহ বেশ কয়েকজন মেধাবী যুবক নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৫ সালে তারা কমিশন লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়া চৌকশ অফিসার হিসাবে দাপটের সঙ্গে চাকরি করেছেন। ক্যারিশমেটিক লিডারশিপের কারণে জিয়া তখন থেকেই সিনিয়র-জুনিয়র সবার কাছে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। অত্যন্ত প্রিয় ও কাছের কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল হামিদ জিয়া সম্পর্কে বলেন, ‘বরাবরই জিয়া ছিল মেজাজী এবং প্রবল আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন সৎ ও সচেতন অফিসার। কিন্তু সে অসৎ অফিসারদের কানে ধরে কাজ করাতে সুবিধা হয় বলে মনে করত। তার সঙ্গে জেনারেল ওসমানী, মোশতাক আহমদ, জেনারেল খলিল প্রমুখদের বনিবনা না থাকা সত্ত্বেও যেভাবে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মেধা ও সাহসিকতার মাধ্যমে উপরে উঠে আসে, তা ছিল সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার, এটি ছিল লিডারশিপ কোয়ালিটির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।’
৩. পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে (পিএমএ) প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন জিয়া। বাঙালিদের মধ্যে অসাধারণ মেধাবী চৌকশ অফিসার ছাড়া কেউ এ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না। তিনি ক্যাডেটদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব; ক্যাডেটরা জিয়াকে তাদের রোল মডেল মনে করতেন।
৪. পেশাগত দক্ষতা ও অন্য সব যোগ্যতার মাপকাঠিতে জিয়ার অবস্থান অনেক উপরে ছিল বলেই তিনি ভালো ভালো পদবিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি সামরিক দক্ষতার অনন্য নজির স্থাপন করেন। খেমকারান যুদ্ধে জিয়া ছিলেন ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির নেতৃত্বে। দুর্ধর্ষ জিয়া ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নির্ভীক দামাল ছেলেদের নিয়ে ঝড়ের গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইন্ডিয়া বাহিনীর ওপর। পিছু হটে শিয়ালের মতো পালিয়ে যায় ইন্ডিয়ানরা, রক্ষা পায় লাহোর। সর্বাধিক বীরত্বসূচক পদক পায় জিয়ার কোম্পানি; তিনি ভূষিত হন ‘সিতানা-ই-জুরাত’ পদকে। বদলে যায় ইতিহাস। বীরত্বের এ অসাধারণ ইতিহাসে মুগ্ধ হয়ে পাকিস্তান সরকার ৭ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়। এরপর জিয়াকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যুদ্ধের ইতিহাসে দুঃসাহসী বীর হিসাবে তার নাম সংযুক্ত হয়। এসব যোগ্যতার কারণে তার অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণ অর্জনের সুযোগ পান।
৫. ১৯৭০ সালেই জ্যেষ্ঠতার তালিকায় তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতির জন্য প্রথমে ২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পরে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে উপ-অধিনায়ক হিসাবে যোগদান করেন। মহান আল্লাহর পরিকল্পনা অত্যন্ত সূক্ষ্ম; তিনি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার মতো একজন অসাধারণ দুঃসাহসী যোদ্ধাকেই বেছে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। আর এজন্যই হয়তো তিনি বদলি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম সেনাবিনাসে ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসাবে। দেশের স্বার্থে তার অধিনায়কের মতো সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি পিছপা হননি। এটি যে কত উচ্চমানের দুঃসাধ্য কঠিন কাজ, তা সামরিক বাহিনীর সদস্য ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে বোঝা সহজ নয়।
৬. দেশের সেই এক দুঃসময়ে জিয়া আরও দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে প্রথমে বললেন, ‘উই রিভোল্ট’ এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন দেশের স্বাধীনতা। যে ঘোষণা শুনে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা হলেন উজ্জীবিত। একের পর এক বিদ্রোহ ঘোষণা শুরু করল পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট ও সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তখন থেকেই দুই অক্ষরের ‘জিয়া’ নামটি সামরিক বাহিনী সদস্য ও বাঙালিদের মুখে মুখে। জিয়া ছিল এমন এক দুঃসাহসী নাম, যে নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেঁপে উঠত। একইভাবে বাঙালিদের কাছে তিনি ছিলেন অতিপ্রিয় একজন সামরিক নেতা। রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার ও ফোর্স প্রধান। এভাবেই হয়তো মহাপরিকল্পনাকারী মহান আল্লাহ জিয়াকে প্রস্তুত করেছিলেন সবচেয়ে সংকটময় সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য। স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে শহিদ জিয়া দেশের জনগণের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা, সম্মান ও মর্যাদাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, এখনো যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে বা সংকটের সময় দেশের মানুষ সামরিক বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
৭. ১৯৭২ সালে সিনিয়র জেনারেল জিয়াকে ডিঙিয়ে তার জুনিয়র জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলেও সামরিক বাহিনীতে জিয়া ছিলেন অধিক পরিচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয়। জেনারেল সফিউল্লাহও তাকে সম্মান করতেন। ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের অবস্থা যখন টালমাটাল, সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মোশতাক সরকার জিয়াউর রহমানকে সফিউল্লাহর স্থলাভিষিক্ত করলেন। সেনাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাসের মাথায় সংঘটিত হয় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা। জাতি তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে; রাজনীতিকরা বিচ্ছিন্ন-বিশৃঙ্খল অবস্থায় ও দেশ নেতৃত্বশূন্য ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে। দেশের সার্বভৌমত্বও প্রশ্নের সম্মুখীন। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
৮. এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার নিজ মেধা, কর্মধারা, দায়িত্ববোধ, সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাহস ও নিখাদ দেশপ্রেম দ্বারা দেশ পরিচালনা করে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অকল্পনীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। দেশ ও জাতির নির্ভরযোগ্য অভিভাবক হিসাবে তিনি রাষ্ট্রের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতিতে বৈপ্লবিক এক পরিবর্তন এনে দেশকে বিশ্বের দরবারে এমন এক উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেন, জনগণ ফিরে পায় তাদের জীবনের নিরাপত্তা, কথা বলার স্বাধীনতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা করার অধিকার, আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধ। কিন্তু শত্রুরা চুপ করে বসে থাকেনি। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি-মাতৃভূমি বাংলাদেশের এ অকল্পনীয় উন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সহ্য করতে না পেরেই দেশের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে শাহাদতবরণ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। কিন্তু শহিদ জিয়ার জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘শহিদি মৃত্যু নহেকো মৃত্যু নব জীবনের অভ্যুদয়’।
৯. কোনো প্রশ্নবিদ্ধ নীতি-নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি ছিলেন একজন সফল সামরিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। দুটি ভিন্ন দেশ থেকে দুবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের গভীরে এমনভাবে তিনি স্থান করে নিয়েছেন, এদেশ যতদিন থাকবে, শহিদ জিয়ার নাম স্বর্ণাক্ষরে অঙ্কিত থাকবে মানুষের হৃদয়ের গভীরে। মহান আল্লাহ এ মহান নেতাকে জান্নাতের উচ্চ আসনে স্থান দান করুন। আমীন।
কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি : নিরাপত্তা ও ইতিহাস বিশ্লেষক, সমাজসেবক ও লেখক
