Logo
Logo
×

বাতায়ন

এ বৈষম্য অমানবিক, দৃষ্টিকটুও বটে

Icon

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার ও খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম

প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি মাধ্যম ও বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এ দুই ধরনের স্কুলের মধ্যে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পার্থক্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ পার্থক্যগুলো শিক্ষার মান, অভিজ্ঞতা এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে। ঢাকা শহরের প্রধান কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের ওয়েবসাইট, বার্ষিক রিপোর্ট এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে জানা যায়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গড় মাসিক বেতন ১০,০০০-৩০,০০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যম স্কুলের গড় বেতন ৫০০-৫,০০০ টাকা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে গড় মাসিক বেতন বাংলা মাধ্যম স্কুলের তুলনায় প্রায় ৬-১০ গুণ বেশি। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভর্তি ফির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য লক্ষ করা যায়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ভর্তি ফি ৫০,০০০-২,০০,০০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যম স্কুলের ভর্তি ফি ১,০০০-২০,০০০ টাকা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো প্রায়ই উচ্চ ভর্তি ফি নির্ধারণ করে, যা অনেক পরিবারের জন্য আর্থিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ইওএউ) তথ্যমতে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বার্ষিক অতিরিক্ত খরচ হিসাবে ২০,০০০-১,০০,০০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যম স্কুলে বার্ষিক অতিরিক্ত খরচ ৫,০০০-২০,০০০ টাকা আদায় করা হয়।

এ পার্থক্যগুলোর প্রধান কারণ হিসাবে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও বেতন চিহ্নিত করা যায়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সাধারণত উচ্চশিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ও বিদেশি ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা পড়ান, যাদের বেতন অপেক্ষাকৃত বেশি। এ ছাড়া ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো সাধারণত উন্নত ভৌত অবকাঠামো ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে, যা বেতন বৃদ্ধির একটি কারণ। আন্তর্জাতিক পাঠ্যক্রম ও উচ্চমানের শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারের কারণেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের খরচ বেশি। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো সরকারি অনুদান পায়, যা তাদের খরচ কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এ ধরনের অনুদান পায় না, যা ছাত্রছাত্রীদের বেতন বৃদ্ধির একটি কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চমানের শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতি শিক্ষার্থী পিছু বার্ষিক খরচ প্রায় ১,৫০,০০০-২,০০,০০০ টাকা। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এ মান বজায় রাখার চেষ্টা করে, যা তাদের বেতন কাঠামোকে প্রভাবিত করে।

ইংরেজি মাধ্যম ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা সাধারণত বেশি বেতন পান। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির শিক্ষক বেতন সমীক্ষামতে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা সাধারণত ৩০,০০০-৫০,০০০ টাকা, বাংলা মাধ্যম (সরকারি) শিক্ষকরা ১৬,০০০-২৫,০০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যম (বেসরকারি) শিক্ষকরা ৮,০০০-১৫,০০০ টাকা বেতন পান। এ ছাড়া ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইওএউ)-এর তথ্যমতে, শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা ৪০,০০০-৭০,০০০ টাকা, বাংলা মাধ্যম (সরকারি) শিক্ষকরা ২৫,০০০-৪০,০০০ টাকা এবং বাংলা মাধ্যম (বেসরকারি) শিক্ষকরা ১২,০০০-২০,০০০ টাকা বেতন পান। জাতীয় শিক্ষক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, অতিরিক্ত সুবিধা হিসাবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষকরা বার্ষিক বোনাস, স্বাস্থ্যবিমা, পেনশন স্কিম পান। আর বাংলা মাধ্যম (সরকারি) শিক্ষকরা সরকারি নীতি অনুযায়ী সুবিধা এবং বাংলা মাধ্যম (বেসরকারি) শিক্ষকরা সীমিত সুবিধা পান বা কোথাও তাদের অতিরিক্ত কোনো সুবিধা নেই।

এ বেতন কাঠামোর পার্থক্যের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইংলিশ মাধ্যম স্কুলগুলো সাধারণত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয় এবং তারা প্রাইভেট ফান্ডিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাদের উচ্চমানের শিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক রাখতে উচ্চ বেতন কাঠামো প্রয়োজন। অন্যদিকে, বাংলা মাধ্যমের অনেক স্কুল সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং তারা জাতীয় বেতন স্কেল অনুসরণ করে। এ ছাড়া বাংলা মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকদের সংখ্যা সাধারণত বেশি হয়, যা বেতন কাঠামোকে প্রভাবিত করে।

উচ্চ বেতন কাঠামোর কারণে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো সাধারণত উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সীমাবদ্ধ থাকে। এটি সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি করে এবং শিক্ষার সুযোগে অসমতা তৈরি করে। তাই সরকারের উচিত ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের মধ্যে বেতন ব্যবধান কমানোর জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা। মেধাবী, কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বৃত্তি কর্মসূচি চালু করা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে উচ্চমানের শিক্ষা কম খরচে প্রদানের ব্যবস্থা করা। বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক শিক্ষাসামগ্রী প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা।

দেশে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের বেতন কাঠামোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য কমানো এবং সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। তাই, উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন কাঠামো নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার মানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সারা দেশে একই মানদণ্ডে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা, নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন, দূরবর্তী এলাকায় যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা প্রয়োজন। সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলে একই বেতন কাঠামো প্রবর্তন, পর্যায়ক্রমে ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম স্কুলের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর করা এবং কর্মদক্ষতাভিত্তিক বোনাস ব্যবস্থা চালু করা দরকার। প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা, গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল ল্যাব ও লাইব্রেরি স্থাপন এবং দুর্গম এলাকায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত। এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সব এলাকায় একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব, যা শিক্ষার্থীদের নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রবণতা কমাবে এবং সামগ্রিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে।

শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন ও পেশাগত সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে হাউজ রেন্ট ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি করা উচিত। দেশে সম্প্রতি একটি যুগোপযোগী ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। এ নতুন কারিকুলামের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা পদ্ধতি, দক্ষতা ও মূল্যবোধের ওপর গুরুত্বারোপ, প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শিক্ষার সমন্বয়, ব্যবহারিক ও প্রয়োগমুখী শিক্ষা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শিখন ফলাফল অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ। তবে এ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে; যেমন-শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা, মূল্যায়ন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অপ্রতুলতা ইত্যাদি। বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে বেতনের বৈষম্য দূর করার জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রণীত নতুন কারিকুলামের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সবার জন্য একটি সমন্বিত জাতীয় বেতন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে এবং শিক্ষকদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে গ্রেড নির্ধারণ করে পেশাগত উন্নয়ন (উচ্চশিক্ষা) নিশ্চিত করা উচিত।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সমতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। সর্বত্র একই মানের শিক্ষক, বেতন কাঠামো ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব। পাশাপাশি, শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের সফল বাস্তবায়ন ও বেতন বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠবে-এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

খাজা মোহাম্মদ মুস্তাকিম : সহযোগী অধ্যাপক, হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম