Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাজার কারসাজি থামাবে কে?

Icon

এস এম নাজের হোসাইন

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিবছর আমরা দেখে আসছি, ঈদের আগে মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ে। একশ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ীও এ পণ্যগুলোয় তাদের অর্থ লগ্নি করেন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদুল আজহার অনেক আগে থেকেই মসলাজাতীয় পণ্যের মজুত ও দাম বৃদ্ধি শুরু হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এবার পবিত্র ঈদের পর থেকে বেশকিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়েছে। বিশেষ করে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ ও চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে।

নিত্যপণ্যের অস্থিরতা এতটাই বাড়ছে যে, কাঁচা মরিচের ঝাল ও পেঁয়াজের ঝাঁজে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন যেন ওষ্ঠাগত। ঈদে শুকনা মরিচের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি থাকে। আবার শুকনা মরিচের দাম বেশি থাকায় অনেকে কাঁচা মরিচে ভরসা করতেন। কিন্তু কাঁচা মরিচের দামও এখন ঊর্ধ্বমুখী, ফলে তারা নিরুপায়। গত সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে ২৮০ টাকা কেজি দরে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে। অথচ এক সপ্তাহ আগেও পণ্যটির দাম ছিল ১৬০ থেকে ২০০ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দাম বেড়েছে।

ঠিক একইভাবে ঈদের আগে যে পণ্যটির দাম বেশি বাড়ে, তা হলো পেঁয়াজ। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ঈদের পর পেঁয়াজের দামে অস্থিরতা শুরু হয়। যদিও বছরজুড়েই এ পণ্যটি নিয়ে কারসাজি দেশের আলোচিত ঘটনার অন্যতম। বছরজুড়ে দফায় দফায় পেঁয়াজের দাম বাড়লেও সরকারের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। পণ্যটির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু তারপরও দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। প্রতিনিয়তই আমরা এমনটি দেখছি। সম্প্রতি সপ্তাহের ব্যবধানে এর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা। এর ফলে বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। আগে দেখা যেত, পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন : আগে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়লে ভারত থেকে আমদানি করে বাজারমূল্য স্থিতিশীল করা হতো। কিন্তু এবার ভারতেও পেঁয়াজের দাম তুলনামূলক বেশি।

দেশি মধ্যস্বত্বভোগী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদন কম, খরচ বেশি ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখিয়ে দাম বৃদ্ধি করেন। অন্যদিকে ভারত তার দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন কম ও দেশীয় চাহিদা মেটানোর কথা বলে প্রথমে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে বাংলাদেশের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমদানির অনুমতি দিলেও তারা রপ্তানি শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে দেশে পেঁয়াজের বাজারে আরেক দফা আগুন লাগার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভোক্তা ও বাজার তদারকিতে যুক্তদের মতে, পেঁয়াজের বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি ও হাতবদল বন্ধ হলে দাম নিয়ে নৈরাজ্য কিছুটা হলেও ঠেকানো যাবে। অন্যদিকে দেশীয় কৃষকরা অগ্রিম ও দাদন নিয়ে আগেই পণ্যটি বিক্রি করে দেন। এ প্রবণতা রোধে প্রকৃত কৃষকদের মাঝে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা গেলে কিছুটা ফল পাওয়া যাবে। এছাড়া কৃষক যাতে সরাসরি পণ্যটি বাজারজাত করতে পারেন, সেজন্য কৃষকের হাট ব্যবস্থা প্রচলন করার সুপারিশ করা হলেও সেটি বেশিদূর এগোয়নি। এখন কৃষক পণ্যটি বিক্রির জন্য ফড়িয়া ও দালাল এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তা নেওয়ার কারণে তারা প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রকৃত কৃষকদের মাঝে ঋণ আর কারিগরি সহায়তা পৌঁছাতে সরকার ইচ্ছা করলে ক্ষুদ্র ঋণদান কার্যক্রমে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে (এমএফআই) যুক্ত করতে পারে। এক্ষেত্রে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথিরিটি ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করতে পারে।

খাদ্য নিরাপত্তায় চাল আমাদের অন্যতম পণ্য। তাই অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি চালের দামও বাড়লে সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। কুরবানির ঈদের পর ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং চালকলগুলো বন্ধ থাকায় প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। এ ব্যাপারে চাল ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, করপোরেট গ্রুপগুলো চালের বাজারে আসার পর থেকেই তারা বিপুল পরিমাণ ধান, চাল মজুত ও প্যাকেজিং করে চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়ায়। আমরা দেখতে পাই, করপোরেট গ্রুপগুলো চাল প্যাকেটজাত করে ৫ কেজির দাম কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার কৃষক পর্যায়ে ধান সংগ্রহ করে বিপুল মজুত করার পাশাপাশি ধানের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে ধান-চাল সংগ্রহ ও মজুত কতদিন চলবে এবং কতটুকু রাখা যাবে, সে বিষয়ে তদারকি নিশ্চিত করা গেলে এ খাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হতে পারে। অন্যদিকে সরকার বিভিন্ন সময়ে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করে। কিন্তু সে আমদানিকৃত চাল কোথায় রাখা হয় এবং তা কোথায় বিতরণ করা হয়, তার সুনির্দিষ্ট তদারকি না থাকায় প্রচুর চাল আমদানির পরও বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ে না।

ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার জন্য সাম্প্রতিক ভারি বৃষ্টি ও মৌসুমি বন্যার অজুহাত দিচ্ছেন। আবার অনেকে মৌসুম শেষ এবং শীতের মৌসুম আসার কথা বলছেন। এর বাইরে অতিপ্রয়োজনীয় আলুর দাম বৃদ্ধিকে সামনে নিয়ে আসছেন। কিন্তু বন্যা তো সারা দেশে হয়নি। সিলেট অঞ্চলের বন্যার কারণে সারা দেশে সবজির দাম এতটা বেড়ে যাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ নেই। তাছাড়া উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত সবজি দেশব্যাপী পরিবহণে তেমন কোনো সংকটও নেই। যদিও গেল সপ্তাহে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বগুড়ায় বাজার পরিদর্শনের সময় সবজির দাম দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘শায়েস্তা খার আমলের সবজি বাজার’। সত্যিকার অর্থে বগুড়ার বাজারে দাম অনেক কম হলেও ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে ভোক্তাদের অনেক বেশি দাম দিয়ে সবজি কিনতে হচ্ছে। আর এর পেছনে যে মহলবিশেষের কারসাজি আছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রতিনিয়তই সবজির বাজারে হাতবদল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজির কথা আলোচনায় এলেও এ সমস্যা সমাধানের চিত্র হতাশাজনক। যদিও পণ্য পরিবহণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চাঁদাবাজিকে সামনে আনা হয়, তবে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করা হয়। সম্প্রতি আলুকাণ্ড নিয়ে কারসাজি সফল হওয়ার পর দেখা যায়, এখন অনেক ব্যবসায়ী সবজি চাষিদের অগ্রিম দাদন নিয়ে পণ্য কিনে নিচ্ছেন। একই সঙ্গে কৃষকের মাঠ থেকেও তারা পণ্যটি সরাসরি সংগ্রহ করছেন। ফলে কৃষক ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভোক্তারা অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য হচ্ছেন।

ব্যবসায়ীরা মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে পণ্যের দাম বাড়ায়। সরবরাহ ও জোগান ঠিক থাকলে পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে জিকির করে। পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ থাকার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। কিন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি মানে যা খুশি তা করা নয়। আমরা হতাশার সঙ্গে লক্ষ করছি, নিত্যপণ্যের বাজারের ওপর সরকারের যে তদারকি থাকার কথা, সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। রমজান ও ঈদের সময় সরকারের মন্ত্রী-আমলারা কিছুটা তৎপরতা বাড়ান। কিন্তু পরে সে তৎপরতা আর অব্যাহত থাকে না। বাজার তদারকিতে কাগজে-কলমে ১১টি প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত থাকলেও শুধু ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। একটা সময় জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, র‌্যাব স্থানীয়ভাবে নকল-ভেজাল তৎপরতা রোধ ও বাজার তদারকিতে সম্পৃক্ত ছিল। এখন তারা আর সাধারণ মানুষের এ সমস্যা সমাধানে তৎপর নেই।

ফলে এর সুযোগ নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল তথা সিন্ডিকেট ইচ্ছামতো প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, বছরের শেষ নাগাদ নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল হবে এবং খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কমবে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা যেভাবে অপতৎপরতা চলমান রেখেছে, তাতে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে করে মূল্যস্ফীতি কমার পরিবর্তে বরং আরও বাড়বে।

সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছেন। এ কথাগুলো ভোক্তা ও বাজার বিশ্লেষকরা বারবার বলে এলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিসহ নানা বিষয় সামনে এনে সমস্যাটির সমাধানে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। সরকারের নীতিনির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয় যে, নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক ও সীমিত আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবসায়ীদের ওপর ছেড়ে দিয়ে সরকার তার রেগুলেটরি অবস্থান নিশ্চিত করতে তদারকি জোরদার করছে না। বরং ব্যবসায়ীদের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে মুক্তবাজারের দোহাই দিয়ে যাচ্ছে।

সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার অধিকার সুরক্ষায় বাজার তদারকি জোরদার করা, দেশে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহে মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা রোধ, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিশ্চিত করা, কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণের প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি টিসিবি ও খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল-ভোজ্যতেলের মতো পণ্যগুলোর বিতরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

cabbd.nazer@gmail.com

 

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম