Logo
Logo
×

বাতায়ন

শুধু সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধনই যথেষ্ট নয়

Icon

জেহসান ইসলাম

প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল যে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল, তা ছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপ্রধান করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। বিজয় লাভের পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে, সে ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন। অর্থাৎ আমরা পেলাম মন্ত্রিপরিষদশাসিত সংসদীয় সরকার। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হলো, তাতেও একই পদ্ধতি বহাল থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের আগেই আওয়ামী সরকারের সময় সংবিধানের চারটি সংশোধনী হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত কখনো সামরিক, কখনো বেসামরিক পোশাকে সামরিক শাসনের ব্যবস্থা দেখেছি আমরা। তবে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল থাকে।

১৯৯০-এর গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতির অধীনে। ১৯৯১ সালের ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে কোনো দলই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১ আসন পায়নি। বিএনপি সবচেয়ে বেশি আসন পায় এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি সরকার গঠনের পর এ পদ্ধতিই বহাল রাখার পক্ষে থাকলেও তখন মূলত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবির মুখে সংবিধান সংশোধন করে আবার সংসদীয় সরকারব্যবস্থা বহাল করা হয় এবং গণভোটে তা পাশও হয়। শোনা যায় তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষেই ছিলেন এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় বিএনপিকে তা মেনে নিতে হয়।

১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার অধীনে করার দাবি তোলে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধীদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বিএনপি ছাড়া সব রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেয়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কোনোমতে একটা নির্বাচন সম্পন্ন করলেও বিএনপি আন্দোলনের গতিবিধি ও তীব্রতা লক্ষ্য করে বুঝতে পারে যে, এ অবস্থায় ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে না। ফলে, সংসদ অধিবেশন ডেকে রাতারাতি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করে এবং সংসদ ভেঙে দেয়। দেশের ইতিহাসে প্রথম বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি কোনো মহল থেকেই কোনো অভিযোগ না থাকলেও বিএনপি নির্বাচন স্বচ্ছ হয়নি বলে দাবি করে। তবুও তারা নির্বাচন মেনে নিয়েছে বলে মনে হলো।

দেশের মানুষ ভাবলেন এবার একটা ব্যবস্থা হলো এবং আশা করল জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আর কোনো রাজনৈতিক ঝামেলা তৈরি হবে না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫১ আসন পায়নি। ফলে ইতোমধ্যে ভেঙে যাওয়া জাতীয় পার্টির একাংশ ও জাসদসহ (রব) কয়েকটি দল নিয়ে সরকার গঠন করে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এরপরও রাজপথের আন্দোলন ও হানাহানি বন্ধ হয়নি। ছোট-বড়, গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বহীন নানা ইস্যু নিয়ে রাজপথের আন্দোলন চলতে থাকে। তবে বড় কোনো ঘটনা ছাড়াই ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে বিএনপি বিপুলসংখ্যক আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ বেজায় রকম হেরে গিয়ে এ নির্বাচনে ‘কারচুপির’ অভিযোগ আনে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও তারা ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ করেছিল। বিএনপি এককভাবে সরকার গঠন করার মতো আসন সংখ্যা পেলেও তাদের চারদলীয় রাজনৈতিক জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতের দুজন মন্ত্রিত্ব লাভ করেন।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিএনপি ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার কথা। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতা অব্যাহত রাখার জন্য একটি চালাকি করে। বিচারপতি কে এম হাসান অবসরে গিয়েছেন ২০০৪ সালের ২ জানুয়ারি। তখন বিচারপতিদের বয়স ৬৫ হলে অবসরে চলে যাওয়ার বিধান ছিল। কিন্তু বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ করে। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তোলে যে, বিচারপতি কে এম হাসানকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার উদ্দেশ্যে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের আগে সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হবেন। বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো না হলে কে এম হাসানের পরিবর্তে বিচারপতি সৈয়দ জে. আর. মোদাচ্ছির হোসেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হতেন। বিচারপতি কে এম হাসানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। অতএব, তিনি নিরপেক্ষ হবেন না এবং নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্যই বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭ করেছে। ২০০৪ সালে সংবিধানের এ সংশোধনীর পর থেকে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদের শেষ দিন দেশ দুই রাজনৈতিক জোটের (চারদলীয় ও চৌদ্দদলীয়) রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অবশেষে বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে আরেক জটিলতা তৈরি হয়। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখার জন্য কৌশল অবলম্বন করে। তারা তাদের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য আনঅফিসিয়ালি প্ররোচিত করে এবং রাষ্ট্রপতি সংবিধানে বিধৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে নিয়োগের যে ছয়টি অপশন ছিল, তার প্রথম পাঁচটি অপশনকে পাশ কাটিয়ে ছয় নম্বর অপশন অনুযায়ী নিজেই তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। বিরোধী দলগুলো হোঁচট খায়। তারা প্রথমে এটা মেনে নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করলেও বোঝা যাচ্ছিল তা আন্তরিক ছিল না। নানা ঘটনার পরিক্রমায় জনাব ইয়াজউদ্দিনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নে ওঠে এবং তিনি বিএনপির পরামর্শে সরকার পরিচালনা করছেন মর্মে অভিযোগ তোলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে এবং আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। দুই রাজনৈতিক জোট যুদ্ধংদেহী হয়ে পড়লে অনেকে দেশে গৃহযুদ্ধেরও আশঙ্কা করেন। দেশের এ করুণ পরিস্থিতিতে ১/১১-এর সরকার আসে। তিন মাসের পরিবর্তে এ সরকার দুবছর ক্ষমতায় থেকে অবশেষে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি এ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করে।

এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হলে বহুল বিতর্কিত এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার এ সুযোগে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর আমরা দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন ও তার ফলাফল দেখলাম।

এ তো গেল দেশের কথা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বারবার সে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করে ও বিরোধী মত দমন করে এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন। চীনেও সংবিধান পরিবর্তন করে শি জিন পিং-এর ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যেসব দেশে স্বৈরশাসক ছিল বা আছে, সব দেশেই কম বেশি একই অবস্থা। সংবিধান কেটে-ছিঁড়ে স্বৈরশাসকরা নিজেদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশেও এ যাবৎ তাই হয়েছে।

ওপরের দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, কাগজে ছাপানো সংবিধানে যত ভালো পদ্ধতিই থাকুক না কেন, তা স্বৈরশাসক সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে অবশ্যই সংবিধানে এমন ভালো কিছু বিধান থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের পদ্ধতি আমাদের দেশের জন্য যেভাবে যতটুকু খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়, তা করা যেতে পারে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানমতে, মন্টেস্ক্যু ও অনুরূপ মনীষীদের দর্শন অনুসরণ করে প্রণীত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথক ও যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ।

তবে সবশেষের হলো সংবিধানকে হেফাজত ও রক্ষণাবেক্ষণ করার যে শপথ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, স্পিকার ও সংসদ সদস্যরা নিয়ে থাকেন, তারা যাতে তা মেনে চলেন সে জন্য জনগণকেই সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। কোনো বিচ্যুতি হলে এবারের ছাত্র-জনতার মতো সবাইকে একযোগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে হবে। ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন’-এর মতো বলা যায় ‘ভালো সংবিধান রচনার চেয়ে সংবিধান সংরক্ষণ করা ও মেনে চলা’ আরও কঠিন। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা সহজেই দেখতে পাই, জনতা চুপ করে থাকলে চাটুকার, পদলোভীদের পাল্লায় পড়ে একজন ভালো শাসকও স্বৈরশাসক হিসাবে আবির্ভূত হতে সময় লাগে না।

জেহসান ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম