Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ব জগতের রহমত হজরত মুহাম্মাদ (সা.)

Icon

মাহমুদ আহমদ

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব জগতের রহমত হজরত মুহাম্মাদ (সা.)

বিশ্ব জগতের রহমত হজরত মুহাম্মাদ (সা.)

পবিত্র রবিউল আউয়াল আরবি বছরের তৃতীয় মাস। পবিত্র এ মাসে বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠ নবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম, নবুয়ত, হিজরত ও ওফাতের মাস। বিশ্বময় শান্তির বার্তা দিয়ে আল্লাহতায়ালা এ মহান নবি (সা.)কে আশীর্বাদস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্য কেবল এক রহমত রূপেই পাঠিয়েছি।’ (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)। ‘আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা সাবা, আয়াত: ২৮)।

যুগ যুগ ধরে যারা বিকৃত ও ভ্রষ্ট, তাদের উন্নত আচার-ব্যবহার শেখানোর জন্য, সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে-তা ঘোচানোর জন্যই আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবিকে প্রেরণ করেছেন। কীভাবে নিজের প্রভুর ভালোবাসা অর্জন করা যায় আর তার সৃষ্টির প্রাপ্য অধিকার কীভাবে প্রদান করতে হবে, মহানবি (সা.) তা শিখিয়েছেন। বিশ্বনবীর প্রতি আল্লাহতায়ালার নির্দেশ ছিল, তুমি উপদেশ দিতে থাক, নিশ্চয় উপদেশ প্রদান মুমিনদের কল্যাণ সাধন করে থাকে। (সূরা আয যারিযাত, আয়াত: ৫৫)। তিনি (সা.) যে-রূপ সহানুভূতি, ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও পরিশ্রম করে নিরন্তর এ উপদেশ প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে উল্লেখ রয়েছে: হে মুহাম্মাদ (সা.) তারা মুমিন হচ্ছে না বলে তুমি কি নিজ প্রাণ বিনাশ করে ফেলবে? (সূরা আশ শোয়ারা : ৪)।

তিনি (সা.) আমাদের সামনে এ আদর্শ স্থাপন করেছেন, যদি সমাজের সংশোধনের জন্য উন্নত মান প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে নিজের ঘর বা পরিবার থেকে সংশোধনের কাজ আরম্ভ করো। এর প্রভাবও পড়বে আর আল্লাহতায়ালার নিদের্শও এটিই; নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা কর। মহানবি (সা.) তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর বিষয়ের প্রতিও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন আর তাদের শেখাতেন; কিন্তু তা পরম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে।

মহানবি (সা.) তাঁর বাড়িতে স্ত্রী-কন্যাদের ও সেখানে নিয়মিত যাতায়াতকারী বহু শিশু-কিশোর ও যুবকদের, যেমন হজরত আলী (রা.), হজরত যায়েদ (রা.), হজরত হাসান (রা.), হজরত হোসাইন (রা.), হজরত উসামা (রা.), হজরত আনাস (রা.), হজরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) এবং হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) প্রমুখদের অত্যন্ত স্নেহ, ভালোবাসা ও দোয়ার সঙ্গে এমন উন্নত শিক্ষা দিয়েছেন যে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছেন। কিন্তু এ পুরো শিক্ষা-দীক্ষার সময় তিনি (সা.) কখনো কারও গায়ে হাত তোলেননি, কখনো রাগ করে বাড়িতে কাউকে বকাঝকা করেননি। বিশেষভাবে নারীদের সম্মান ও ইসলামের উন্নত শিক্ষা দিয়ে তিনি এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন যে, কয়েক বছরের মধ্যেই আরব সমাজে নারীদের এমন সম্মান অর্জিত হয় যে, মহানবি (সা.)-এর সাহাবিরাও জটিল সমস্যার সমাধান করার জন্য সহধর্মিণীদের কাছ থেকে মতামত নিতেন। মহানবি (সা.)-এর অনিন্দ্য সুন্দর নৈতিক গুণ ও নৈতিক চরিত্রের এমনই প্রভাব ছিল যে, তাঁর সহধর্মিণীরা তাঁর বাড়ির সাদামাটা ও দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের মোকাবিলায় পার্থিব শোভা-সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের সব প্রলোভন বা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এছাড়া মহানবি (সা.) শত্রু সৈন্যের লাশ বিকৃত করার প্রাচীন রীতিকে নিষিদ্ধ করেছেন এবং সেসব মৃতদেহের প্রতি যত্নশীল ও সম্মানজনক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি (সা.) আরও শিখিয়েছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি নেই এবং নারী-শিশু, বৃদ্ধ ও অন্যান্য নিরীহ নাগরিকদের ওপর আক্রমণ করা যাবে না। একইভাবে পাদরি, ধর্মযাজক অথবা অন্য ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না বা তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে কোনোরূপ বাধা প্রদান করা যাবে না। এছাড়া মহানবি (সা.)-এর নির্দেশনা হলো-মুসলমান সেনাদের যুদ্ধের সময় বেসামরিক জনগণকে ভীত ও শঙ্কিত করা বা তাদের মাঝে কোনো ধরনের আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না, বরং সব নিরস্ত্র ও বেসামরিক জনগণের সঙ্গে দয়ার আচরণ করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচার করা যাবে না। এমন কোনো শহরে বা এলাকায় সৈন্য ঘাঁটি স্থাপন করা উচিত নয়, যেখানে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তিনি এ শিক্ষাও দিয়েছেন যে, যুদ্ধের সময় বিপক্ষ দলের সৈন্যদের মুখে যেন আঘাত করা না হয়। কেউ যুদ্ধবন্দি হলে তাদের বন্দি আত্মীয়স্বজনকে তাদের থেকে পৃথক করা যাবে না। যুদ্ধবন্দিদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে; এমনকি তাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রয়োজনকে বন্দিকারীর নিজের ওপর প্রাধান্য দিতে হবে। যদি কোনো মুসলমান কোনো যুদ্ধবন্দির প্রতি কোনো ধরনের নিষ্ঠুরতা বা কঠোরতা প্রদর্শন করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে প্রায়শ্চিত্ত বা ক্ষতিপূরণ হিসাবে যুদ্ধবন্দিকে তৎক্ষণাৎ মুক্ত করে দিতে হবে।

মহানবি (সা.)-এর আরেকটি নির্দেশ হলো, অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি অথবা বার্তাবাহকের সঙ্গে অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করতে হবে। যদি তাদের পক্ষ থেকে কোনো ভুলত্রুটি বা অশোভন আচরণ হয়েও যায়, তবু শান্তি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখার স্বার্থে সেগুলো উপেক্ষা করতে হবে।

মহানবির সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলি ও ব্যাকুল চিত্তের দোয়া আর অনবরত সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশের ফলে প্রত্যেক হৃদয়ে, পরিবারে ও পরিবেশে পবিত্র পরিবর্তন আসা আরম্ভ হয়ে যেত। তাঁর সুন্দর ব্যবহারে এমন হৃদয়কাড়া ও আকর্ষণ-আবেদন ছিল, তাতে এমন জ্যোতি ছিল; যা হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করত। সাহাবা রেযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি ও সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যেক মুসলমানের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় থেকে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেওয়া হয়, তা অসুন্দর হয়ে যায়। একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবি (সা.)-এর পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তাঁর প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তাঁর লাঠি দিয়ে একথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা ক্ষতবিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি। পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন। আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তাঁর সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাব। কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সঙ্গে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম, এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এ আশিটি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ কর আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ. ৫৭)।

মহানবি (সা.)-এর সুন্দর আচার-ব্যবহারের সুখ্যাতি শুনে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ, বিশেষ করে যুবক শ্রেণি বিভিন্ন অঞ্চল হতে দলে দলে এসে দিনের পর দিন মদিনায় অবস্থান করত আর তাঁর সঙ্গে নামাজ পড়ত এবং পবিত্র কুরআন আর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিখত। তারা সবাই এ কথাই বলত, তিনি অত্যন্ত কোমলমতি ও নরম হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং পরম স্নেহের সঙ্গে তাদের ধর্মের শিক্ষা দিতেন। মহানবির কথায় এমন প্রভাব ছিল যে, সাহাবিরা তাঁর ভালোবাসা, সন্তুষ্টি ও দোয়া লাভের জন্য ছিলেন পাগলপারা। তাঁর প্রতিটি কথার ওপর আমল করার জন্য তারা থাকতেন সদা ব্যাকুল। তারা নামাজ পড়ার ও রোজা রাখার ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন। অনেক সময় মহানবি (সা.)কে তাদের এ কথাও বুঝাতে হতো যে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমাদের দেহেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের চোখেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের স্ত্রী এবং পরিবার-পরিজনেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরও তোমাদের ওপর প্রাপ্য আছে। (সহিহ বুখারি, কিতাবুন নিকাহ)।

কতই না চমৎকার শিক্ষা ছিল আমাদের প্রিয় নবি (সা.)-এর। আসুন, শ্রেষ্ঠ নবির উম্মত হিসাবে তাঁর ভালোবাসায় পবিত্র এ মাসে আমরা অঙ্গীকার করি, মহানবি (সা.)-এর আদর্শ নিজ জীবনে বাস্তবায়ন এবং পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার। আল্লাহতায়ালা আমাদের এর তৌফিক দান করুন, আমিন।

মাহমুদ আহমদ : ইসলামি গবেষক ও লেখক

masumon83@yahoo.com

হজরত মুহাম্মাদ (সা.)

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম