ডেটা সেন্টার : প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
তথ্য যার পৃথিবী তার-যে দেশ যত তথ্যে সমৃদ্ধ, সে দেশ তত সমৃদ্ধ। আর তথ্যসমৃদ্ধ দেশই নেতৃত্ব দেবে আগামী পৃথিবীর। তাহলে প্রশ্ন আসে এ তথ্য কোথায় থাকে, কারা এর মালিক এবং সেটি কোন দেশে অবস্থিত; এসবের উত্তর হচ্ছে ডেটা সেন্টার, যার বাংলা প্রতিশব্দ হলো তথ্যকেন্দ্র বা ডেটা সংরক্ষণাগার। এটি হলো একটি নির্দিষ্ট বিল্ডিং, যেখানে সার্ভার ও ইন্টারনেট কানেকশনের মাধ্যমে ডেটা সংরক্ষণ ও পরিচালনা করা হয়। এর পরোক্ষ কাজ হলো ইন্টারনেট সচল রাখা ও প্রত্যক্ষ কাজ হলো ডেটা স্টোর করা। ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, এমন সব তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ডেটা সেন্টারের সার্ভারে জমা থাকে। একটি ডেটা সেন্টারে অনেক সার্ভার থাকে, যারা নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত থাকে। ব্যবহারকারীরা যখন ব্রাউজারে কোনো URL-এ প্রবেশ করে, তখন তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ডেটা সেন্টারে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে প্রসেস হয়ে ব্যবহারকারীর হাতে আসে। তবে ইন্টারনেট দুনিয়ায় ডেটা সেন্টারের অর্থ আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। ইন্টারনেটের একেকটি ওয়েবসাইটে অনেক ডেটা বা তথ্য-উপাত্ত থাকে, আর ওয়েবসাইটগুলো থাকে সার্ভার কম্পিউটারে। এ সার্ভারগুলো থাকে থরে থরে সাজানো র্যাকে। ওয়্যারহাউজ বা গোডাউনসদৃশ বড় বড় বিল্ডিংয়ের মধ্যে। এ বিল্ডিংগুলোকেই ডেটা সেন্টার বলা হয়। যেখানে হাজার হাজার সার্ভার লাখ লাখ ওয়েবসাইটের ডেটাগুলো সংরক্ষণ করে। একটি বড় ডেটা সেন্টারে হাজার হাজার সার্ভার কম্পিউটার থাকতে পারে। অধিকাংশ উচ্চমানের ডেটা সেন্টার ১ লাখেরও বেশি স্কয়ার ফিট জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে শুধু গুগলেরই প্রায় ৯ লাখ সার্ভার একটিভ আছে। বিশ্বের কয়েকটি বড় ডেটা সেন্টারের সাইজ নিুরূপ-
১. নেভাডা ডেটা সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র : ৭.২ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট ২. লাংফাং ডেটা সেন্টার, চীন : ৬.৩ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট ৩. ইউটাহ ডেটা সেন্টার, যুক্তরাষ্ট্র : ১.৫ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট ৪. মাইক্রোসফট ডেটা সেন্টার আইওয়া, যুক্তরাষ্ট্র : ১.২ মিলিয়ন স্কয়ার ফিট ৫. ওয়েলস ডেটা সেন্টার, যুক্তরাজ্য : ৭ লাখ ৫০ হাজার স্কয়ার ফিট।
প্রতিটি ডেটা সেন্টার কয়েকটি কমন নিয়ম অনুসরণ করে। যেমন-ডেটা সেন্টারে সাধারণত স্টোরেজ ডিভাইস নেটওয়ার্কিং ডিভাইসসহ অন্যান্য অনেক হার্ডওয়্যার থাকে। প্রথমত সার্ভারগুলো রেডি করার জন্য মাদারবোর্ড, প্রসেসর, র্যাম, স্টোরেজ ইত্যাদি সেটআপ করে নেওয়া হয়। পরে সেগুলো পর্যায়ক্রমে স্টোরেজ র্যাকগুলোয় সাজানো হয়। হোস্টিং প্রোভাইডাররা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ডেটা সেন্টারের এক বা একাধিক সার্ভার র্যাক ভাড়া নিতে পারে। তারপর রাউটার, সুইচ, ফায়ারওয়ালসহ অন্যান্য নেটওয়ার্কিং যন্ত্রাংশ দিয়ে সার্ভারগুলোকে ইন্টারলিঙ্কিং করে তা ইন্টারনেটের সঙ্গে জুড়ে দেয়। প্রতিটি সার্ভারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার শক্তিশালী নিরাপত্তার বেষ্টনীতে আবদ্ধ থাকে এবং কোনো ধরনের ঝামেলা বাদে সবসময় ইন্টারনেটের সঙ্গে কানেক্টেড রাখা হয়। তবে নিরবচ্ছিন্ন সেবা পরিচালনার জন্য আরও কয়েকটি কারিগরি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। সেগুলো হলো-১. বিদ্যুৎ : ডেটা সেন্টারে যেসব যন্ত্রাংশ থাকে তার প্রায় সবই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিদ্যুৎ ছাড়া সার্ভার, কুলিং সিস্টেম, নেটওয়ার্ক কোনো কিছুই কাজ করবে না। তাই প্রতিটি ডেটা সেন্টারে প্রাইমারি পাওয়ার সাপ্লাই সুবিধাসহ সেকেন্ডারি এবং ব্যাকআপ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট থাকতে হয়। ২. নেটওয়ার্ক : ইন্টারনেট হলো ডেটা সেন্টারের হার্ট। ডেটা সেন্টারগুলোতে যে সার্ভার বসানো থাকে, সেগুলো থেকে ডেটা আদান-প্রদানসহ যাবতীয় কাজ করার জন্য ইন্টারনেটের প্রয়োজন হয়। আর এ ইন্টারনেট কানেক্ট করার জন্য ঝামেলাহীন একটি নেটওয়ার্কিং অবকাঠামো থাকতে হয়। সার্ভারগুলো তাদের নিজেদের মধ্যে কমিউনিকেশন করার জন্য একটি নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। সঠিকভাবে নেটওয়ার্ক সেটআপ করতে না পারলে যেমন হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তেমনি সার্ভার এরর বা ডাউন হয়ে যেতে পারে। এ কারণে সেন্টারগুলোতে উন্নতমানের রাউটার, নেটওয়ার্ক সুইচ ও ফায়ারওয়ালসহ নেটওয়ার্ক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়। ৩. সিকিউরিটি : ডেটা সেন্টারে রক্ষিত ডেটাগুলো ডিলিট বা নষ্ট হয়ে গেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়। তাই ডেটাগুলো নিরাপদ রাখার জন্য অনলাইন ও অফলাইন-দুই ধরনের সিকিউরিটির ব্যবস্থাই রাখতে হয়। ডেটা সেন্টারগুলোতে সাধারণত মিলিটারি গ্রেড সিকিউরিটি স্থাপন করা হয়। এতে অনুমতি ব্যতীত কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া উউড়ঝ অথবা হ্যাকার প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্বসেরা সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। সিকিউরিটিসহ অন্যান্য ফিচার বিবেচনা করে ভালো ডেটা সেন্টার চিহ্নিত করার জন্য ১ থেকে ৪ মাত্রা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ টিয়ার-১ সার্টিফাইড ডেটা সেন্টার থেকে টিয়ার-৪ ডেটা সেন্টার অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ। ৪. কুলিং সিস্টেম : একটি ডেটা সেন্টারে একই সঙ্গে অনেক সার্ভার ২৪ ঘণ্টা সচল থাকে। এ অনবরত চলার কারণে প্রতিটি সার্ভারে তাপ উৎপন্ন হয়। এ তাপ নিয়ন্ত্রণ করা না হলে হার্ডওয়্যার নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া শর্ট-সার্কিট সমস্যার কারণে আগুন লেগে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে প্রতিটি ডেটা সেন্টারকে তাপ নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করতে হয়। অর্থাৎ তাপ নিয়ন্ত্রণ করার সব ধরনের হার্ডওয়্যার ইন্সটল করতে হয়। এতে পুরো বিল্ডিংয়ের ভেতর প্রয়োজনমতো কৃত্রিম তাপ মেইন্টেইন করা হয়। বর্তমানে ডাটা সেন্টারকে কুলিং রাখার জন্য সমুদ্রের তলদেশেও স্থাপন করা হচ্ছে। ৫. ব্যাকআপ : আধুনিক ডেটা সেন্টার কোম্পানিগুলো তাদের প্রধান ডেটা সেন্টারের পাশাপাশি মিরর ডেটা সেন্টার তৈরি রাখে। কখনো প্রধান ডেটা সেন্টারে কোনো ডেটা আপলোড বা মডিফাই হলে সঙ্গে সঙ্গে তা ওই মিরর সেন্টারেও মডিফাই হয়ে যায়। এর ফলে কোনো কারণবশত একটি সেন্টারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে তা ব্যাকআপ সেন্টার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভিস প্রদান করতে পারে। আবার প্রতিটি ডেটা সেন্টার তাদের তথ্য ব্যাকআপ রাখার জন্য ক্লাউড সিস্টেম ব্যবহার করে। মোট কথা, একটি ডেটা সেন্টারের কাজ হলো সার্ভারগুলোকে ৩৬৫ দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল থাকার জন্য পাওয়ার, নেটওয়ার্ক, সিকিউরিটি, কুলিং সিস্টেম এবং অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদান করা। বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক সংখ্যক ডেটা সেন্টার আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ক্লাউডসিন প্ল্যাটফর্মের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ডেটা সেন্টারের সংখ্যা দুই হাজার ৬৫৩টি এবং যুক্তরাজ্যে আছে ৪৫১টি। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের তুলনায় পাঁচ গুণেরও বেশিসংখ্যক ডেটা সেন্টার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, যা বিশ্বের ৩৩ শতাংশ। ৪৪২টি ডেটা সেন্টার নিয়ে তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি, চতুর্থ কানাডা ২৭৯টি, পঞ্চম নেদারল্যান্ডস ২৭৪টি, ষষ্ঠ অস্ট্রেলিয়া ২৭২টি, ফ্রান্সে ২৪৮টি, জাপান ১৯৯টি, রাশিয়া ১৪৫টি এবং দশম অবস্থানে রয়েছে ব্রাজিল ১২৮টি, ভারত ১২৩টি ডেটা সেন্টার নিয়ে তালিকায় দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে আর ছয়টি ডেটা সেন্টার নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৭৩তম অবস্থানে আছে। উন্নত দেশগুলো তাদের ডেটা সেন্টার নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বহির্বিশ্বেও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করে প্রচুর আয় করে থাকে। তবে এসব দেশের বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ ডেটা সেন্টার এখন বাংলাদেশের গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। এখানে আছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ৬০৪টি র্যাক, উচ্চগতিসম্পন্ন ডেটা কানেকটিভিটি, ইন্টারনেট সংযোগ, অত্যাধুনিক রাউটার, সুইচ, ফায়ারওয়াল, স্টোরেজ সার্ভার, ভার্চুয়াল মেশিনসহ প্রিসিশন এয়ার কন্ডিশন সিস্টেমস, সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ক্লাউডের জন্য বিশেষ সফটওয়্যার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক ও সিকিউরিটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মতো নানা প্রযুক্তি। সেন্টারটি ওরাকল সফটওয়্যারে পরিচালিত হচ্ছে এবং আরও ভালো সার্ভিস দেওয়ার জন্য আগামীতে জি-ক্লাউড স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। সেন্টারটিতে দেশের জাতীয় তথ্য সংরক্ষণের সুযোগ হওয়ায়, বছরে অন্তত ৩৫৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। পরিপূর্ণভাবে এ ডাটা সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ভবিষ্যতে বিদেশিদের কাছেও ভার্চুয়াল তথ্যভান্ডার হিসাবে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে।
ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
