Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষা কমিশন গঠনের গুরুত্ব

Icon

ড. শাফিউল ইসলাম

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষার গুরুত্ব কী তা আমরা সবাই জানি। এ প্রসঙ্গে চীনের সেই প্রবাদটি সবাই উল্লেখ করেন, ‘তুমি যদি এক বছরের পরিকল্পনা করো, তাহলে শস্য রোপন করো; তুমি যদি দশ বছরের পরিকল্পনা করো, তাহলে গাছ লাগাও; আর যদি হাজার বছরের পরিকল্পনা করে থাকো, তাহলে মানুষ তৈরি করো।’ মানুষকে মানুষ করার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা কি সঠিকভাবে সে পরিকল্পনা করতে পেরেছি? না। প্রথম স্বাধীনতা যদি ব্রিটিশ থেকে শুরু করি, তাহলে বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৭৮ বছর। আর যদি ৭১ সাল থেকে শুরু করি, তাহলে ৫৪ বছর। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন আমরা ‘মানুষ তৈরি’র একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলাম না? বিভাজন, দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থ, নাকি অন্য কোনো কারণ?

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের ‘আকাঙ্ক্ষা’ হচ্ছে বৈষম্যহীন সমাজ-রাষ্ট্র গঠন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফসল এ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। সবাই সংস্কারের ওপরই জোর দিচ্ছেন, যাতে করে আর কোনো স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ এদেশে কায়েম হতে না পারে। তাই এখন সংস্কারই অগ্রাধিকার। অন্যান্য খাতের সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা খাতের সংস্কারও অগ্রাধিকারমূলক জরুরি বিষয়। কিন্তু সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স দুমাস পেরিয়ে গেলেও শিক্ষা ও শিক্ষা প্রশাসন সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো সুখবর আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দেরি করার সময় হাতে নেই। দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের সময়ই ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা দরকার ছিল বলে সচেতন মহল অভিমত ব্যক্ত করছেন। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাও শিক্ষা কমিশনসহ আরও কিছু সংস্কার কমিশন গঠনের কথা বলছেন। কিন্তু জাতি দৃশ্যমান কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

যাই হোক, নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা প্রশাসনে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষা খাতে নৈরাজ্য দূর করতে হবে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে না। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার খবরই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২৮ সেপ্টেম্বর শনিবার ছুটির দিনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন’র জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করেছে। এতে কেউ কেউ খুশি হয়েছেন, আবার কেউ কেউ ‘নারাজ’ হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এ কমিটির তো সংস্কার চেয়েছি। কমিটিতে আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্ব চেয়েছি। যা আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতো। বাতিল চাইনি। কিন্তু বাতিল করল সরকার। আবার কেউ কেউ বলছেন, এখন ‘শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হবে। এরই মধ্যে ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে’ ৯ সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি আমলানির্ভর এবং এখানেও আলেম সমাজের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই বলে ইতোমধ্যে আলাপ শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন সিদ্ধান্তহীনতা আমরা দেখতে পেয়েছি। আবার বিতর্কিত কিছু ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ‘আকাঙ্ক্ষার’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনাও দৃশ্যমান। এসব ঘটনা দূর করার জন্য শিক্ষা প্রশাসনে সুশাসন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। শিক্ষা কমিশন গঠনের মাধ্যমেও সে সুশাসন নিশ্চিত করা যায়। আবার বিদ্যমান শিক্ষা প্রশাসনের বহু বিভক্ত সংস্থার মধ্যে একটি সুসমন্বয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেও করা যায়। তবে এ মুহূর্তে ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করে শিক্ষা প্রশাসনের বিদ্যমান সমস্যা ও দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করা দরকার। ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যেন এ কমিশনে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ শিক্ষা সংস্কার কমিশনকে অবশ্যই হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। আবার যেন বিতর্কিত না হয় তা বিবেচনায় নিয়েই কমিশনের একটি ‘কোর কমিটি’ গঠন করতে হবে। এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যবোধের যথার্থ প্রতিফলনও যেন থাকে এই সংস্কার কমিশনের কোর কমিটিতে। এ কোর কমিটি প্রয়োজনমতো বিভিন্ন উপকমিটি গঠন করবে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে কারিগরি, প্রকৌশল, মাদ্রাসা, কওমি, ইংরেজি মাধ্যমসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। শিক্ষা কারিকুলাম, গবেষণা, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সর্বস্তরের শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক মর্যাদার বিষয়েও সংস্কার প্রয়োজন।

২০২১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নায়েমে একটি গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেছিলাম। সেখানে বলেছিলাম শিক্ষা প্রশাসন কেমন হওয়া উচিত। যদিও সে গবেষণায় কারিগরি শিক্ষাকে ফোকাস করা হয়েছিল; তথাপি সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে একটি শীর্ষ মন্ত্রণালয় হিসাবে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে; শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘আমব্রেলা মন্ত্রণালয়’ হিসাবে গ্রহণ করে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের (বিশেষ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তার অধীনস্ত করে) সঙ্গে জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালার সংযোগ সাধন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন ও এই কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা সে গবেষণা প্রতিবেদনকে বিবেচনায় নিতে পারেন। প্রয়োজনে গবেষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আরও সুপারিশ বা মতামত গ্রহণ করার সুযোগও নিতে পারেন।

আমরা চাই, ‘মানুষ তৈরি’র মহাপরিকল্পনা। শিক্ষা প্রশাসনে সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এটি দেখতে চাই। দেখতে চাই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে উন্নতির উচ্চ শিখরে।

ড. শাফিউল ইসলাম : শিক্ষা গবেষক ও প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

shafiul.pad@gmail.com

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম