Logo
Logo
×

বাতায়ন

মজলুম জননেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

Icon

গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। একসাগর রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আর লাল-সবুজের পতাকা। পরের বছর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানে কারাবাস শেষে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নয় মাসের সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে তার দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়েই বাঙালির বিজয় কিছুটা পূর্ণতা লাভ করে। তবে এ পূর্ণতার মধ্যেও ছিল বিশাল শূন্যতা। কারণ, তখনো স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার দেশের মাটিতে আসেননি।

প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১২ দিন পর যখন ঢাকায় পত্রপত্রিকায় মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে নানা ধরনের লেখালেখি শুরু হয়, তখন ভারতের সরকার মওলানা ভাসানীকে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে। তিনি যখন নিজ দেশের মাটিতে ফিরছিলেন, তখন তার স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। দিল্লি থেকে দেশে ফেরার আগে তিনি আসাম যান। সেখানে তার পরিচিতজনদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছিলেন ভারত সরকারের কাছে। ভারত সরকার তাতে সম্মতও হয়েছিল।

১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি আসামের ফরিদগঞ্জে তিনি এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস, পাকিস্তানের বর্বরতা ও ২৩ বছরের শোষণের একটি চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ২২ জানুয়ারি মেঘালয় থেকে তিনি ভারত সরকারের একটি জিপে বাংলাদেশের হালুয়াঘাটে পৌঁছান। তার সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক ছিলেন। হালুয়াঘাটে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা মহান এ জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে মামুলি অভ্যর্থনা জানিয়েছিল ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক খসরুজ্জামান চৌধুরীসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও তার ভক্তমণ্ডলী।

সড়কপথে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে সেদিন শেষ রাতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলে পৌঁছান। রাতে সার্কিট হাউজেই থাকেন তিনি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি সকালে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তাকে দেখতে সমবেত হন সার্কিট হাউজে। বহুদিন পর পরিচিত মানুষ ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন মজলুম জননেতা। পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে একজনকে দিয়ে বললেন, সন্দেশ নিয়ে এসো। ওই ১০ টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ করে আনা হলো সন্দেশ। সবাইকেই মিষ্টিমুখ করালেন তিনি।

দেখতে দেখতে অসংখ্য মানুষ জড়ো হলো, যেন ছোটখাটো জনসমাবেশ। ফুটপাতের এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নাতিদীর্ঘ স্বভাবসুলভ ভাষণ দেন তিনি। বহুদিন পর টাঙ্গাইলবাসী শুনতে পায় তাদের পরিচিত কণ্ঠ। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন উপস্থিত জনতা। এরপর টাঙ্গাইল থেকে তিনি যান সন্তোষের নিজ বাড়িতে। তার পোড়া ভিটায় গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখেন সব, কোথায় কী ছিল তা শনাক্ত করেন। তার যেসব প্রিয় বস্তু খোয়া গিয়েছিল, সেগুলোর জন্য আপসোস করেন। তার গভীর অথচ চাপা দীর্ঘ নিশ্বাস গোপন থাকল না উপস্থিত মানুষের কাছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে উঠে আসে : সেদিন দলে দলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করতে লাগলেন তাদের প্রিয় মানুষটিকে। মাটির মানুষের পরমাত্মীয় এ মহামানবও এলাকার কে কোথায় মারা গেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা কেমন আছেন-সে খবর নেন। ঘনিষ্ঠ কারও কারও নিহত হওয়ার খবর শুনে তারও চোখ অশ্রুসিক্ত ও কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়।

মওলানা ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত তারই স্বপ্নের ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো দালানের একটি কক্ষে তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আগেই খিচুড়ি রান্না শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। কলার পাতায় যার যেমন খুশি খাচ্ছে। সবার সঙ্গে মওলানা ভাসানীও খেলেন বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে। শীতের ছোট দিন, তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, দর্শনার্থীদের ভিড় কমল কিছুটা। ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র বিছানা, কাঁথা-বালিশ পর্যন্ত ভস্ম করে দিয়েছিল ইয়াহিয়ার ফৌজ। তীব্র শীত পড়েছিল সেদিন। ভক্তেরা নেতার বিছানাপত্রের ব্যাপারে সত্যি সত্যি পুরু করে নাড়া বিছিয়ে তার ওপর একটি চট দিয়ে বিছানা করে দিলেন তাকে। আশপাশের কারও বাড়ি থেকে জোগাড় হয়েছিল একটি জীর্ণ কাঁথা। অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি সেদিন শুয়ে পড়েন মওলানা। স্বাধীন দেশে ফিরে এসে মাটির শয্যায় প্রথমবার স্বাধীনভাবে পরম শান্তিতে ঘুমালেন এ মাটির মানুষটি।

পরদিন অবশ্য তার ভক্তরা একটি লেপ ও একটি তোশক তৈরি করে দেন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেদিন এটাই কি প্রাপ্য ছিল মওলানা ভাসানীর? এ প্রশ্নবাণ তার অনেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও বিদ্ধ করে। প্রত্যাবর্তনের দুদিন পর স্বাধীন দেশে প্রথম সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দেশবাসীকে আহ্বান জানান সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যতদিন কাজ করবে এবং দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেবে, ততদিন তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাবেন। এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে অতীতের স্বৈরাচারী সরকারগুলোর মতো তার সরকারেরও পতন অনিবার্য।

মজলুম জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন মওলানা ভাসানী। যতদিন মেহনতি মানুষের সংগ্রাম চলবে, ততদিন মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকবেন। মওলানা ভাসানী ক্ষমতায় যাননি বটে, তবে তিনি ছিলেন ক্ষমতার পালাবদলের অনুঘটক। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৭২-৭৫ পর্যন্ত অপশাসন, স্বৈরশাসনসহ সফল নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়ক। আর এ কারণেই ১৯৫৭ সালের কাগমারি সম্মেলনেই পাকিস্তানিদের প্রতি সালাম জানিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন, যার বাস্তব রূপই হচ্ছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ক্ষমতায় না গিয়েও কীভাবে দেশ-জাতির কল্যাণ করা যায়, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন তার প্রমাণ বহন করে। তাকে শুধু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, তাঁতি-জেলে-চিরকাল স্মরণ রাখবে তাদের এ আপন মানুষটিকে। তাদের মুক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল যার গোটা জীবন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ ও দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য মওলানা ভাসানী যে ঐক্যের বাণী রেখে গেছেন, তা আজও আমাদের কাছে অবশ্যই স্মরণীয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, উপমহাদেশের অত্যাচারিত ও নির্যাতিত মিহনতি জনগণের নয়নমণি, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার জন্য তাই সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

গোলাম মোস্তফা ভুইয়া : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম