টিকে থাকুক মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী
বিনয় দত্ত
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৮, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যশোর রোডের শতবর্ষী বৃক্ষ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
জনপ্রিয় গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের ‘যশোর রোড’ গানটা আমাদের কাছে অতি পরিচিত। এ গানে যশোর রোডের সঙ্গে মিশে থাকা মানবতার বিপন্ন দশার এক মর্মস্পর্শী চিত্র উঠে এসেছে, উঠে এসেছে আর্তমানবতার কথা, পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে পালিয়ে বেঁচে ফেরা বাঙালি জনগোষ্ঠীর কথা; যারা দীর্ঘদিন ধরে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের অভাবে ছুটছে তাদের কথা।
আমরা অনেকেই ১৯৭১ সালে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে, প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছি এই যশোর রোড ধরে, ভারতে শরণার্থী হয়েছি।
সময়ের কালক্রমে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়, অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়, অনেক গণজোয়ার আসে। আমাদের এখন অনেক উন্নয়ন হচ্ছে এবং আরও উন্নয়ন দরকার। পুরনো অনেক স্মৃতি, অনেক তথ্য, অনেক শিকড় আমরা চাইলেই মুছে ফেলতে পারি, ভুলে যেতে পারি। এখন বাইরের কোনো দেশ চাইলেই আমাদের দেশে আক্রমণ করতে পারবে না। এখন আমাদের আর প্রাণের ভয়ে যশোর রোড ধরে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে হবে না। এখন আমরা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক।
২.
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সাড়া জাগানো কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এ কবিতার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষ জেনেছে ১৯৭১ সালে এ দেশের পরিস্থিতি কী ছিল। কেমন ছিলেন এখানকার মানুষ। সেসব মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজের চোখে দেখতে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যশোর রোডে ছুটে এসেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ।
তিনি দেখেছিলেন বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত যশোর রোডে শরণার্থীর ঢল। ঘর হারানো এসব অসহায় শরণার্থীর কান্নায় কবি নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি তাই সফর শেষ করেই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে নিউইয়র্কে টানা তিন দিন বসে লিখেছিলেন ঐতিহাসিক সেই কবিতা- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। পরবর্তী সময়ে কবিতাটি তিনি বিভিন্ন স্থানে পাঠ করেন। বাংলাদেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে সবার কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। মুক্তিযুদ্ধকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এ কবিতার মাধ্যমে তিনি বিশ্ব জনমত গড়ে তোলেন।
বিখ্যাত এ কবিতা নিয়ে গান গেয়েছেন আরেক জনপ্রিয় মার্কিন শিল্পী বব ডিলান। তিনি এই কবিতা পড়ে কেঁদেছেন, গান গেয়েও কেঁদেছেন। স্বাধীনতার পর খান মোহাম্মদ ফারাবী কবিতাটি বাংলায় অনুবাদ করেন। তার অনবদ্য অনুবাদ মানুষকে ভাবিয়েছে, কাঁদিয়েছে। পরবর্তী সময়ে কবিতাটিকে গানে রূপান্তর করার প্রয়োজনে বিশিষ্ট শিল্পী মৌসুমি ভৌমিক কবিতাটির ওপরে বাংলা ভাবানুবাদ করেন। ‘যশোর রোড’ নামের সেই গানের গল্প সবার জানা।
এ ইতিহাস বলার একটাই কারণ- যশোর রোড সড়কটি এশিয়ান হাইওয়েতে অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছে। সে লক্ষ্যে যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়ককে চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মহাসড়কটির দুই পাশের বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ২৩০০ গাছ কাটার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার পর থেকেই শুরু হয় মূল জটিলতা।
যশোর রোডের গাছ কাটার পরিকল্পনা শুনে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এর সমালোচনা করছে। পত্রিকা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সব ক্ষেত্রেই যশোর রোড আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
যে গাছগুলো কাটার জন্য যশোরের জেলা প্রশাসক পরিকল্পনা করেছেন সেই গাছগুলো এই সময়ের নয়। এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর যশোর থেকে কলকাতার মানিকতলা পর্যন্ত এ সড়কটির নামকরণ হয় যশোর রোড।
যশোরের জমিদার কালী পোদ্দার তার মাকে সোজা পথ দিয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয়ে ১৮৪২ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদিয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেছিলেন। আর ৮০ কিলোমিটারের ওই রাস্তায় ছায়ার জন্য কালী পোদ্দার বিদেশ থেকে অতিবর্ধনশীল রেইনট্রির চারা এনে দু’ধারে রোপণ করেছিলেন। সেই বৃক্ষগুলো যশোর-বেনাপোল সড়ককে এখনও ছায়া দেয়ার পাশাপাশি অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার মহাসড়কের দু’পাশে রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। এর মধ্যে ১৭৪ বছরের পুরনো তিন শতাধিক মেঘ শিরীষও রয়েছে। বর্তমানে যশোর রোড মানেই এসব প্রাচীন বৃক্ষের সমাহার। গাছগুলো বাদ দিয়ে সড়কটির অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।
৩.
উন্নয়নের জন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। কোনো এলাকায় অনেক বড় উন্নয়ন শুরু হলে সেই জায়গার অল্প কিছু ক্ষতি হবে এটা স্বাভাবিক। সেই ক্ষতি বড় ধরনের উন্নয়নের কাছে কিছুই নয়।
যশোর রোডের এই কথিত উন্নয়নের আরেক অর্থ মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় উপাখ্যান বিস্মৃত হওয়া। এত বড় ক্ষতি কি আমরা করব? যশোরের জেলা প্রশাসক বলেছেন, গাছের জন্য চার লেনের রাস্তা করা যাচ্ছে না। তাই গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয় তিনি আরও বলেছেন, যে পরিমাণ গাছ কাটা হবে তার চেয়ে অনেক বেশি গাছ দু’পাশে লাগানো হবে। গাছের বিপরীতে গাছ এই উদ্যোগটা ভালো কিন্তু সেই স্মৃতি? যে গাছগুলো শত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে সময়কে ধরে রেখেছে সেই গাছের বিপরীতে নতুন গাছ কি সেই স্মৃতি, সেই ইতিহাস ধরে রাখতে পারবে? বা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গাছগুলো কালের সাক্ষী হয়ে ছিল সেই গাছের অভাব কি নতুন গাছগুলো পূরণ করতে পারবে? বিষয়টা নিয়ে আমার ধারণা সহজ সমাধান আছে।
পৃথিবীর কোনো দেশে তাদের অতীত স্মৃতি মুছে ফেলা হয় না। তা সযত্নে আগলে রাখা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আনা ফ্রাঙ্ক যেসব জায়গায় ছিল, তা এখনও তারা যতœ করে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
কলকাতার তালতলার স্মিথ লেনে অবস্থিত সরকারি বেকার হোস্টেলের কথা সবার জানা। এই হোস্টেলের ২৪ নম্বর রুমের আবাসিক ছাত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখনও তার স্মৃতি সংরক্ষণ করে রেখেছেন তারা। শুধু আমরাই নতুনত্বের ছোঁয়া নিয়ে, আধুনিক হতে গিয়ে আমাদের পুরনো স্মৃতি মুছে ফেলতে চাইছি। এটা আমাদের জন্য ভয়ানক আত্মঘাতী হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই দেশটির জন্মের জন্য কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, রক্তসংগ্রাম, কত প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে তা আমরা জানি। আমরা যতদিন এই ইতিহাস নিজেরা মনেপ্রাণে ধারণ করব এবং তরুণদের জানাব, ততদিন আমরা নিজেদের ভিত্তি আরও শক্ত করে গড়ে তুলতে পারব।
৪.
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ২০১৭ সালে ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ যুক্ত হয়েছে।
যশোর রোডের ইতিহাসও কিন্তু একদিক থেকে ঐতিহাসিক। অসংখ্য দেশি-বিদেশি আলোকচিত্রীর ছবিতে যশোর রোডের শরণার্থীদের ছবি আছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত অসংখ্য তথ্যচিত্র, প্রামাণ্যচিত্রে যশোর রোডের ভিডিওচিত্র আছে। আর মুক্তিযুদ্ধের পর সেই রোডের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, শুধু কিছু সংস্কার হয়েছে।
এতসব গুরুত্ব বিচার করে যশোর রোড যে কোনো সময় জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে পারে। যদি আমরা আমাদের যশোর রোডকে সংস্কার করে তার ইতিহাস জাতিসংঘের দফতরে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করতে পারি তবে একদিন এই সড়কের জন্য জাতিসংঘের কাছ থেকে আমরা স্বীকৃতি পাবই।
বাংলাদেশ একটি অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, যা আমরা কখনও কল্পনায়ও ভাবিনি। সেই কাজটি হল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা এবং সেই বিচারের রায় কার্যকর করা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যদি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময়ে সরকারপ্রধান না হতেন তাহলে কখনই মানবতাবিরোধীদের বিচার হতো না।
আমার বিশ্বাস, যদি সরকারপ্রধান এ বিষয়েও একটু সুনজর দেন তাহলে এর সহজ সমাধান বের হয়ে আসবেই। তাছাড়া, যশোর-বেনাপোল ৩৮ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশেই অন্তত ৫০ ফুট করে জমি আছে সরকারের। এই জমি জবরদখল করে রেখেছে একশ্রেণীর মানুষ।
তাদের সরিয়ে নিয়ে অথবা নতুন কোনো পরিকল্পনা করে যশোর রোডের শত বছরের ইতিহাসের সাক্ষী প্রাচীন গাছগুলো রক্ষা করা যায়। যে দেশের সরকার সবচেয়ে অসম্ভব কাজটি সমাধান করে ফেলেছে অর্থাৎ প্রধান মানবতাবিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর করতে পেরেছে, তারা চাইলেই যশোর রোডের এ সমস্যারও সমাধান হয়ে যাবে।
যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলো না কাটার জন্য ছয় মাসের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শুধু ছয় মাস নয়, গাছগুলো যেন যুগের পর যুগ টিকে থাকে এ আশা আমাদের সবার।
বিনয় দত্ত : লেখক, নাট্যকার ও গণমাধ্যমকর্মী
benoydutta.writer@gmail.com
