ইসলামে যুদ্ধনীতি : শান্তি প্রতিষ্ঠাই মুখ্য
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)
প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
প্রতিটি বিষয়ের মতো যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কেও ইসলামি জীবনব্যবস্থায় স্পষ্ট নীতি বিদ্যমান। কারণ কিছুসংখ্যক মানুষ কর্তৃক আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করার কারণে যুদ্ধ-বিগ্রহও পৃথিবীর শুরু থেকেই বিদ্যমান আছে। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে অনেকে অশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার ছড়িয়ে দেয়। ফলে যুদ্ধ-বিগ্রহের সৃষ্টি হয়। পবিত্র ইসলাম সম্পূর্ণরূপে একটি শান্তির ধর্ম, যা পৃথিবীতে কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠাই করতে চায়; যুদ্ধ করে দেশ জয়, অশান্তি, সন্ত্রাস বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সংঘাত নয়। কিন্তু তারপরও যদি কেউ সংঘাত, সন্ত্রাস, আধিপত্য বিস্তার, দখলদারত্ব বজায় রাখার জন্য দমনমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায়, ইসলাম সে সম্পর্কেও স্পষ্ট বিধান নাজিল করেছে।
একটি কথা সবাইকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইসলামের নাম ব্যবহার করে কোনোরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করলে এর দায়দায়িত্ব কোনোভাবেই পবিত্র ইসলাম ধর্মের ওপর বর্তায় না। সর্বজনীন এ ধর্মকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য বিভিন্ন ইসলামি শব্দের অতি সুকৌশল অপ্রয়োগ চলছে। যেমন, সন্ত্রাসীদের বলা হচ্ছে জঙ্গি বা মুজাহিদ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে বলা হচ্ছে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ, সন্ত্রাসীদের বোমাকে বলা হচ্ছে জঙ্গিবোমা ইত্যাদি। আবার প্রকৃত ইসলামি নেতৃত্বকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে উগ্র মৌলবাদী নেতৃত্ব হিসাবে। এতেই বোঝা যায়, একটি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে ইসলামের অগ্রযাত্রাকে প্রতিরোধ করার জন্য।
দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ : যে কোনো আগ্রাসী শক্তির হাত থেকে নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার তাগিদে ইসলাম যুদ্ধ করার অনুমতি প্রদান করে। বহির্শত্রুর হুমকি মোকাবিলায় দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষার জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থায়ীভাবে শক্তিশালী সেনাবাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ আল্লাহপাক দিয়েছেন।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ : ইসলাম কখনো প্রথমে যুদ্ধ শুরু করার অনুমতি দেয় না। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়ে যতগুলো যুদ্ধ হয়েছে, এর একটিতেও মুসলমানরা প্রথমে আক্রমণকারীর ভূমিকা পালন করেননি। পার্থিব কারণে অর্থাৎ দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে হিংসা-বিদ্বেষপ্রসূত আগ্রাসী নীতির মাধ্যমে অন্য কোনো জাতি বা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সে আমাদের নয়, যে যুদ্ধ করে অন্ধ বিদ্বেষের জন্য এবং সেও আমাদের নয়, যে মৃত্যুবরণ করে অন্ধ বিদ্বেষের কারণে’ (আবু দাউদ শরিফ)। ইসলাম সবার সঙ্গে শান্তি, সৌহার্দ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তবে আল্লাহর বিধান অনুসরণকারীদের ধ্বংস করার জন্য যারা আক্রমণ রচনা করে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ, নীতি ও কৌশল ইসলাম জারি করেছে। পবিত্র কুরআন শরিফে বর্ণিত এ ব্যাপারে আল্লাহপাকের কিছু নির্দেশ নিুরূপ :
ক. ‘এবং তোমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে, তোমরা আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করো না। কারণ আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না’ (সূরা আল বাকারা : ১৯০)।
খ. ‘যদি তোমরা প্রতিশোধ নিতে চাও; যেটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে, ঠিক ততটুকুই বদলা নাও। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, সেটা বেশি কল্যাণকর’ (সূরা নাহল : ১২৬)।
গ. ‘তোমাদের জন্য যুদ্ধকে বিধিবদ্ধ করা হলো, যদিও এটি তোমাদের কাছে অপ্রিয়। কিন্তু এমন হতে পারে যে, তোমরা যা পছন্দ করো না, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এমন হতে পারে যে, তোমরা যা পছন্দ করো তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর; আর আল্লাহপাকই (চূড়ান্ত ভালো-মন্দ) জানেন; তোমরা (সবকিছু) জানো না’ (সূরা আল বাকারা : ২১৬)।
ঘ. ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাবে যতক্ষণ ফিতনা (বিপর্যয়, অশান্তি) দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর জন্য দ্বীন (আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠিত না হয়। যদি তারা (বিরুদ্ধবাদীরা) বিরত হয়, তবে জালিমরা (অপরাধীরা) ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে শত্রুতাবশত আক্রমণ করা চলবে না’ (সূরা আল-বাকারা : ১৯৩)।
ঙ. ‘এবং তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো। আর জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী’ (সূরা আল বাকারা : ২৪৪)।
চ. ‘আর তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ভ্রান্তি শেষ হয়ে যায়, এবং আল্লাহর সব হুকুম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারপর যদি তারা বিরত হয়ে যায়, তবে আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ লক্ষ করেন। আর তারা যদি না মানে, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের সমর্থক এবং কতই না চমৎকার সাহায্যকারী’ (সূরা আল-আনফাল : ৩৯)।
যুদ্ধের জন্য পূর্বপ্রস্তুতির বিধান : ইসলাম যেহেতু সমাজে অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নিপীড়ন ও যাবতীয় অশান্তি দূর করে কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়; তাই যুদ্ধ করার জন্য যথাযথ শক্তি, সামর্থ্য ও দৃঢ়তা অর্জনকেও অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইসলামে তাগিদ রয়েছে। যুদ্ধে অপমানজনকভাবে শত্রুর কাছে পরাজিত না হয়ে বিজয়ী বা সফলকাম হওয়ার লক্ষ্য নিয়েই আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে এবং এজন্য সব ধরনের রণকৌশল প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ সরঞ্জামাদি, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যাবতীয় রসদ সম্ভার প্রস্তুত করা অত্যাবশ্যকীয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বিধান হলো :
ক. হে ইমানদারগণ! তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন দৃঢ়তা অবলম্বন করবে, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো, নিজেদের মাঝে মতভেদ (বিবাদ) করবে না। এরূপ করলে তোমরা সাহসহারা হবে, আর তোমাদের প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হবে; আর ধৈর্য ধারণ করবে। আল্লাহপাক অবশ্যই ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন (সূরা আনফাল : ৪৫-৪৬)।
খ. তোমরা তাদের (কাফিরদের) মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের এবং এতদ্ব্যতীত তাদেরকে, যাদের সম্বন্ধে তোমরা জানো না। কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা ব্যয় করবে, এর পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। আর তোমাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না (সূরা আনফাল : ৬০-৬১)।
শান্তি চুক্তির বিধান : যুদ্ধের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয় না। কিংবা সম্পূর্ণরূপে শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যুদ্ধকালীন সময়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শত্রুপক্ষ যদি সন্ধি বা চুক্তি করার সদিচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে ইসলাম তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিধান হলো-‘আর শত্রুরা যদি শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সঙ্গীর দিকে আকৃষ্ট হয়, তবে আপনিও সেদিকে আগ্রহী হবেন এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সব শোনেন ও জানেন’ (সূরা আনফাল : ৬১)। ‘অতঃপর যদি তারা তোমাদের থেকে পৃথক থাকে, তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের সঙ্গে সন্ধি করে, তবে আল্লাহ তোমাদের তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ দেননি’ (সূরা আন-নিসা : ৯০)।
দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ করা ও আল্লাহর সাহায্যের ওপর আস্থা রাখা : সৈন্যবাহিনী কেবল অত্যন্ত শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামাদি এবং রণকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুদ্ধে জয়লাভ করবে, ইসলাম তা স্বীকার করে না। যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য অন্য সবকিছুর সঙ্গে সৈন্যদের দৃঢ় ও অত্যন্ত উঁচু মনোবল এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীলতার মাধ্যমে যথেষ্ট ধৈর্য অবলম্বন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অধিনায়কদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এবং আল্লাহপাকও মুসলমানদের এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মহান আল্লাহপাকের এ নির্দেশগুলো মনে রাখতে হবে। আল্লাহপাক ঘোষণা করেন : ‘হে নবি, মুমিনদের সংগ্রামের (যুদ্ধের) জন্য উদ্বুদ্ধ করো। তোমাদের মাঝে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দুশজনের ওপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মাঝে একশজন থাকলে এক হাজার কাফিরের ওপর বিজয়ী হবে। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের (প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে) বুঝ সমঝ নেই’ (সূরা আনফাল : ৬৫, ৬৬)।
‘জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহপাক মুমিনদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে; অতঃপর হত্যা করে এবং হত হয়। আল্লাহর এ সত্য ওয়াদা তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে উল্লেখ আছে। আর ওয়াদা পালনে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে আছে? অতঃপর তোমরা যে সওদা করেছ, তজ্জন্য আনন্দ করো, এটাই মহা সাফল্য’ (সূরা আত তওবাহ : ১১১)।
‘হে ইমানদারগণ! নিজেদের অস্ত্র তুলে নাও এবং পৃথক পৃথক সৈন্যদলে কিংবা সমবেতভাবে বেরিয়ে পড়’ (সূরা আন-নিসা : ৭১)।
‘বস্তুত যারা আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে এবং অতঃপর মৃত্যুবরণ করে কিংবা বিজয় অর্জন করে, আমি তাদেরকে মহাপুণ্য দান করব’ (সূরা আন-নিসা : ৭৪)।
‘হে ইমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সঙ্গে মুখোমুখি হবে, তখন পশ্চাদপসরণ করবে না। অবশ্য যে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা নিজ সৈন্যদের কাছে আশ্রয় গ্রহণের উদ্দেশ্য ছাড়া যে কেউ পশ্চাদপসরণ করবে, সে অবশ্যই আল্লাহর গজবে পতিত হবে। আর তার ঠিকানা হলো জাহান্নাম। বস্তুত সেটা হলো অতি নিকৃষ্ট বাসস্থান’ (সূরা আনফাল : ১৫.১৬)।
মজলুমকে সাহায্য করার জন্য যুদ্ধ : ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য, জুলুম ও নিপীড়নের হাত থেকে মজলুম মানুষকে রক্ষা করার জন্য যে যুদ্ধ, তাকে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধে নিহতদের শহিদি মর্যাদা : যুদ্ধক্ষেত্রে যারা নিহত হন, তাদেরকে ইসলাম অত্যন্ত উচ্চমর্যাদায় আসীন করেছে। দেশ রক্ষার জন্য, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ করার জন্য, আগ্রাসী শত্রুবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য যেসব মুসলমান নিজেদের উৎসর্গ করে, তাদের অত্যন্ত মর্যাদাশীল জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের মৃত্যুকে অন্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের ‘শহিদ’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়েছে। আল্লাহপাকের ভাষায়, ‘যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে প্রাণ উৎসর্গ করে, তাদেরকে তোমরা কখনো মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত; শুধু জীবিতই নয় বরং তারা চিরজীবী, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৪)। কবির ভাষায় : ‘শহীদি মৃত্যু নহেকো মৃত্যু, নবজীবনের অভ্যুদয়/শহীদের তাজা খুনে আখেরাতে নব ইতিহাস লেখা রয়।’
যুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করা : ইসলাম শুধু যুদ্ধের লক্ষ্যের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং এসব যুদ্ধের জন্য যথারীতি সব ধরনের নিয়মকানুনও নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং কোনো অবস্থাতেই যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে কঠোর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ‘তোমরা ক্ষুধার্তদের আহার করাও, রোগীদের সেবা-শুশ্রূষা করো এবং নিরপরাধ বন্দিদের নিষ্কৃতি প্রদানের ব্যাপারে চেষ্টা করো’ (বুখারি শরিফ)।
‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ইমান’, দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। মাতৃভূমিকে ভালোবাসা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সর্বোচ্চ আবশ্যকীয় বিষয়। এ প্রিয় মাতৃভূমিকে আগ্রাসী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই প্রত্যেককে যুদ্ধনীতি সম্বন্ধে ভালোভাবে জানতে হবে এবং নিজেকে সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। ইসলাম এমন একটি জীবনবিধান, যা মানুষ তথা সব প্রাণী ও বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রদত্ত। পার্থিব জীবনে মানুষের প্রতিটি কর্ম পরিচালনার পদ্ধতি তিনি ইসলামি জীবনবিধানে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার বিধানগুলো স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। আশা করা যায় তোমরা আকল-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবে’ (সূরা আল বাকারা : ১১৯)। আল্লাহ চান মানুষ ইহজগতে তার প্রদত্ত আইনকানুন, বিধিবিধান-পদ্ধতি মেনে চলুক। এতে সমাজে তথা সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলামি নীতি অনুযায়ী মানুষ মানুষের প্রভু হতে পারে না। সব মানুষ সমান। সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তাই ইসলামি সমাজব্যবস্থায় শাসক-শাসিত, কর্মচারী-কর্মকর্তা, ধনী-গরিব, শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা যায়।
ইসলাম একটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, শান্তি, সমঝোতা, সহাবস্থান, সহিষ্ণুতা ও সন্ধির ধর্ম। মুসলমানরা একটি শান্তিকামী জাতি। শান্তির এ ধর্ম ইসলামকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে মুসলমানরা শান্তি ও ন্যায়বিচার কায়েম করার মাধ্যমে অন্যায়, জুলুম ও অবিচারকে উৎখাত করে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করতে চায়। কিন্তু সন্ত্রাসী, জুলুমবাজ, আগ্রাসী শক্তি এ শান্তির ধর্ম ইসলামকে তাদের হীন স্বার্থ কায়েমের একমাত্র অন্তরায় মনে করে। তাই তারা প্রতিনিয়ত এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং একে ধরা পৃষ্ঠ থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করতে চায়। এসব কায়েমি স্বার্থবাদীকেই ইসলাম সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দিয়েছে।
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com
