Logo
Logo
×

বাতায়ন

পরিচয়ের রাজনীতি, সংস্কৃতির পালাবদল ও বাঙালি মুসলমান

Icon

ড. হাসান মাহমুদ

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসে পরিচয়ের রাজনীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। প্রখ্যাত ইতিহাস-গবেষক রাফিউদ্দীন আহমদ ঐতিহাসিক তথ্যাদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ চাষাভুষা মুসলমান সমাজের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসাবে রাজনৈতিক চেতনার জন্ম হয়েছিল।

উনিশ শতকের পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আশরাফ আর আতরাফ বিভাজন ছিল। প্রধানত পেশার ভিত্তিতে সামাজিকভাবে নির্মিত এ বিভাজন এতটাই বিস্তর ছিল যে, রাফিউদ্দীন আহমদের মতে, উনিশ শতকের শেষভাগে পূর্ব বাংলার চাষাভুষা বাঙালি মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আশরাফ মুসলমান নেতাদের খুব সামান্যই সংযোগ ছিল। তাহলে কীভাবে এ জনবিচ্ছিন্ন মুসলমান নেতৃত্বই হিন্দুদের সঙ্গে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমগ্র বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল? গ্রামীণ চাষাভুষা, আতরাফ মুসলমানরাই বা কেন সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে বিচ্ছিন্ন সেসব আশরাফ মুসলমানের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, যাদের সঙ্গে বাস্তবিক, তাদের কোনো ধরনের মিলই ছিল না? রাফিউদ্দীন দাবি করেছেন, এ আশরাফ-আতরাফ সমন্বয় সম্ভব হয়েছিল উনিশ শতকে গ্রামীণ জনপদে ‘বাঙালি মুসলমান’ পরিচয়ের উদ্ভব ও বিকাশের মধ্যে।

পূর্ব বাংলার চাষাভুষা মুসলমানের মধ্যে এই যে মুসলমান স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসাবে একটা পরিচয়ের অভ্যুদয় হলো, যেখানে আশরাফ-আতরাফ সবাই ভাই ভাই, যাদের সবার একই রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সমস্যা ও দাবি-দাওয়া, এরই মধ্য দিয়ে হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা, যা সাফল্যে রূপ নেয় সাতচল্লিশে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের শুরুতেই আশরাফ আর আতরাফ মুসলমানের মধ্যকার রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়, যার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে উর্দু বনাম বাংলা বিতর্কের মধ্যে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে এ অনৈক্য দ্রুতই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে সমগ্র ইন্ডিয়ান মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে বের হয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমান গঠন করে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যেখানে তাদের স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচয় বাঙালি।

বাংলাদেশ একটা জাতিরাষ্ট্র, যেখানে মূলধারা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিচয় বাঙালি। এ পরিচয় তথা বাঙালিত্বকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়, এ বাঙালি হিন্দু এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করা হয়, কিছু মুসলমান আছে, যারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত নয়; এরা বাংলার বাইরে থেকে মাইগ্রেট করে এসেছে। স্থানীয় হিন্দু এবং রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে এই যে খাঁটি বাঙালি জাতি, এ পরিচয়টা ন্যাচারাল বা স্বাভাবিক হিসাবে বিশ্বাস করলেও আদতে এটা সামাজিকভাবে নির্মিত, ইংরেজিতে একাডেমিক পরিমণ্ডলে যাকে বলা হয় socially constructed। অর্থাৎ বাঙালির ঘরে জন্ম নিলেই কেউ বাঙালি হয় না। তাকে সামাজিকভাবে স্বীকৃত ও আত্মস্থকৃত কিছু ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাস করতে হয় এবং নিজের জীবনে সেগুলোর বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে নিজের বাঙালিত্বকে সামাজিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ করতে হয়। তবেই মিলে বাঙালি হিসাবে সামাজিক পরিচয়ের স্বীকৃতি।

বর্তমান বাংলাদেশে মুসলমান সমাজে বাবা-মায়ের দেওয়া ইসলামগন্ধী নাম পরিবর্তন করা বা নিজেদের সন্তানদের ‘এমন সব নাম দেওয়া যার সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নেই’, এ প্রবণতাকে বাঙালি মুসলমান পরিচয় থেকে বের হয়ে সেক্যুলার বাঙালি পরিচয় গ্রহণ করার একটা চেষ্টা হিসাবে পাঠ করা যায়। অর্থাৎ সাতচল্লিশের আগে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ, চাষাভুষা জনগোষ্ঠী ইসলামকে তাদের সামষ্টিক পরিচয় হিসাবে গ্রহণ করেছিল। ফলে দেখা যায়, তাদের নামগুলোও সামাজিকভাবে পরিচিত ইসলামি নাম, যেমন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, আবদুল লতিফ, আবদুল জব্বার, সাইদুল ইসলাম, বেগম ফয়জুন্নেছা, সাবিনা ইয়াসমিন, ফরিদা আক্তার, রাবেয়া খাতুন ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে এসে এসব নাম হয়ে গেছে ব্যাকডেটেড, অনাকাক্সিক্ষত, অতএব পরিত্যাজ্য।

২.

বেশ কয়েক বছর আগে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি তার মুসলমান বাবা-মায়ের দেওয়া ইসলামগন্ধী নাম নিয়ে বেশ হীনম্মন্যতায় ভুগতেন এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আলাপচারিতায় সেটা প্রকাশও করতেন। তার বাবা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়ভাজন ছাত্র এবং বাংলাদেশের একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পুত্রসন্তানের জন্মের সংবাদটা গুরুকে দেওয়ার পর তার গুরু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিষ্যের ছেলের জন্য নাম ঠিক করে দেন রহমতুল্লাহ। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই ছেলে নিজেও উচ্চশিক্ষা ও ডিগ্রি অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার নিজের নাম নিয়ে বিব্রতবোধ করাটা বাঙালি মুসলমান থেকে সেক্যুলার বাঙালি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষাকেই অনুচ্চারে প্রকাশ করে।

সাতচল্লিশের আগে ব্রিটিশ এবং হিন্দুত্ববাদবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং সাতচল্লিশ-পরবর্তী পাকিস্তান রাষ্ট্রে সামষ্টিকভাবে মুসলমান পরিচয় নিয়ে গর্বিত প্রজন্মের সন্তানরা যে একাত্তরের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে মুসলমান পরিচয় নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, নিজেদের ইসলাম থেকে দূরে বা বাইরে নিয়ে যেতে চায়, এ ব্যাপারটা দুঃখজনকই, বিশেষ করে এদের বাবা-মায়ের দিক থেকে বিবেচনা করলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নিজের পরিবারের মধ্যেই এর দৃষ্টান্ত আছে। ইসলামি পরিচয়কে ধারণ ও লালন করা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিজের ছেলের নাম দিয়েছিলেন মুহম্মদ বশীরউল্লাহ। কিন্তু তার ছেলে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে পিতৃদত্ত নাম পরিবর্তন করে মুর্তজা বশীর নাম পছন্দ করে নেন। কথিত আছে, তাদের বেগমবাজারের বাসায় পোস্টম্যান এসে মুর্তজা বশীরের নামে চিঠি নিয়ে এলে ক্ষুব্ধ শহীদুল্লাহ পুত্রের সামনেই পোস্টম্যানকে চিঠিসহ ফিরিয়ে দেন পরিবারে সেই নামে কেউ নেই বলে।

বাবা-মায়ের প্রজন্মের সঙ্গে সন্তানের প্রজন্মের মধ্যে এই যে, সাংস্কৃতিকভাবে দুদিকে যাত্রা-ইসলামের দিকে এবং ইসলাম থেকে দূরে-এটা ক্রমেই বাড়তে বাড়তে উচ্চশিক্ষিত শহুরে পরিবারের বাইরে এসে বাংলাদেশের প্রায় সব সামাজিক পরিসরেই বিস্তৃত হয়েছে। এ নিয়ে ফেসবুকের বন্ধু মনোয়ার পাটোয়ারী লিখছেন, ‘বাঙ্গালদের একটা জেনারেশনের সঙ্গে পরেরটা পুরো বিপরীত হয়ে যায়। শেখ মুজিব পাকিস্তান সৃষ্টিতে জান দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে, তার মেয়ে বক্তৃতাতে রেগুলার পাকিস্তানবিরোধী গলাবাজি করে।...প্রচুর লোক পাবেন, যার দাদা মুসলিম লীগ করত, কিন্তু বাপ আওয়ামী লীগ, আবার পোলা অ্যান্টি-ইন্ডিয়ান। আবুল মনসুর ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের নেতা, মনেপ্রাণে পাকিস্তানি, আর তার পোলা ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনাম খাস ইন্ডিয়ান দালাল। কাজী মোতাহার হোসেন মুসলিম সাহিত্য সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। নিজে ফুল দাড়িওয়ালা, টুপি পরতেন। মেয়ে সনজীদাকে রঠার খোয়াড় ভ্রান্তিনিকেতন পাঠিয়েছেন। সনজীদা দেশে এসে মুসলিম আইডেন্টিটির নেতিবাচক সংস্থা ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং শেষতক সভাপতি ছিলেন। সনজীদা খাতুন মারা গেছেন, তার পরের জেনারেশনের কেউ হিজাবি হলে অবাক হবো না।’

এখানে পাটোয়ারী যে জেনারেশনাল বা দুই প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বিপরীতমুখী যাত্রা লক্ষ করছেন, এটাকে যথাযথভাবে বোঝা বাংলাদেশে জুলাই-পরবর্তী পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন এমন হয়, সন্তান বাবা-মায়ের, পিতৃপুরুষের সাংস্কৃতিক পরম্পরাকে শুধু পরিত্যাগই করে না, বরং বৈরীজ্ঞান করে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে স্বীকৃত আরেকটা সাংস্কৃতিক পরিচয়কে আত্মস্থ করে?

জাতিগত পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কখনোই জন্মগতভাবে নির্ধারিত হয় না। এমনটা হলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে, কী তার শিষ্যের ছেলে, কী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সনজীদা, কেউই তাদের বাবা-মায়ের দেওয়া ইসলামগন্ধী নাম নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন না।

সাতচল্লিশের আগে নিজেদের মুসলমান পরিচয়কে রক্ষা করার জন্য, স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বাঙালি মুসলমানকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এর ফলে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ইসলামকে আঁকড়ে ধরার জন্য সক্রিয়ভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা লক্ষণীয়, যা তাদের নাম, পরিচয়ের মধ্যেই সবার আগে দেখা যায়। নিজেদের নাম যেমন ছিল মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তেমনি পুত্রের নামকরণও করেছিলেন মুহম্মদ বশীরুল্লাহ অথবা মুহাম্মদ আবুল হাশিমের পুত্র বদরুদ্দীন মুহম্মদ উমর। শিক্ষকতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতা ও মান-ইজ্জতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়েও নিজের মুসলমানত্বকে ত্যাগ করেননি বা ত্যাগ করার প্রয়োজন মনে করেননি। কিন্তু তাদেরই নেতৃত্বাধীন সমাজে, এমনকি পরিবারের মধ্যেই কী এমন ঘটনা ঘটল, যা তাদের পুত্রদের ও প্রজন্মের মধ্যে মুসলমান পরিচয়কে ত্যাগ করতে উৎসাহী করে তুলল? অথচ এদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে, যা মুসলমানের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত!

একাত্তরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় ঘোষণা করার প্রতিফলন ঘটে ‘স্বাধীন বাংলাদেশে সব নাগরিক বাঙালি’ এ বিশ্বাসকে মূলধারায় নিয়ে আসায় এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকেও পুনর্গঠন করার চেষ্টার মধ্যে। সমগ্র ইন্ডিয়ান মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে ‘সেক্যুলার বাঙালি’র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া স্বভাবতই পাকিস্তানের বিপরীতমুখী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর হয়েছেও সেটাই-পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি ইসলাম থেকে দূরে যাওয়াটাই হয়ে উঠছে স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শিক অভিমুখ। এজন্যই সারা বিশ্বেই সেক্যুলারিজম মানে সব ধর্ম থেকেই নিরপেক্ষতা হলেও বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের মানে ইসলাম থেকে দূরে যাওয়া।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত স্বাধীন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক নির্মাণের মধ্যে ইসলাম বা মুসলমান পরিচয়কে কী মাত্রায় অবাঞ্ছিত করা হয়েছে, তার একটা দৃষ্টান্ত মো. ফাহাদ ইবনে ইলিয়াস নামের একজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায়। নিজের একটা ফেসবুক পোস্টে ফাহাদ লিখছেন, “বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর লাগাম ছাড়া আনন্দ-ফুর্তিতে মজে গিয়েছিলাম। গান-বাজনা, কনসার্ট-মুভি, ফেসবুক-প্রেম-ঘোরাফিরা, খেলাধুলা-টিউশনি আর অল্প-বিস্তর পড়ালেখা। এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বলতে ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। কবিতা লিখতাম। কিন্তু গানের প্রতি ছিল অন্যরকম ফ্যাসিনেশান। বাবা ওস্তাদের কাছ থেকে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন। ভাইয়া তবলা বাজাত, বোনও গান শিখত। ছেলেবেলায় বাবা হারমোনিয়ামে গান গাইতেন আর তার কাছে গুটিসুটি হয়ে গলা মেলাতাম। সেই থেকে রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি একটা আলাদা টান অনুভব করেই বড় হয়েছি। ভার্সিটিতে ওঠার পর ভাবলাম গান গাওয়াটা শিখেই ফেলি। অগত্যা ছায়ানটের ভর্তি ফরম তুললাম।

ছায়ানটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে তো আক্কেল গুড়ুম। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক বছর ওস্তাদের কাছে গান শিখে এসেছে একেকজন। ছেলেমেয়ে থেকে বুড়ো-বুড়ি পর্যন্ত। তবু খালি গলায় গান গেয়েই টিকে গেলাম। কয়েকদিন বাদে ভর্তির টাকা জমা দিলাম। প্রথম সাপ্তাহিক পরিচিতি পর্ব ঠিক করা হয়েছিল শুক্রবার। হাজার হোক, তখনো শুক্রবারের ‘মুসল্লি’ ছিলাম। তাই আগেভাগেই পাঞ্জাবি-পাজামা পরে গেলাম জুমার নামাজে। সকাল দশটা কী এগারোটা বাজে। কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তেমন। পরে জানলাম অডিটোরিয়ামে সাপ্তাহিক পারফরম্যান্সে সবাই আছেন। গান গাইছে, বক্তব্য রাখছে। আমি এতিমের মতো ঘুরে ঘুরে অবশেষে পেছনে গিয়ে বসলাম।

সময় গড়িয়ে চলছে। বারোটা, একটা। কিছু শেষ হওয়ার বা বিরতি নেওয়ার নামগন্ধও নেই। আমি বারবার ঘড়ি দেখছি। নামাজ পড়ব কখন? শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলাম না। তলিয়ে থাকা ‘ইমানের তাড়নায়’ বের হয়ে এলাম। নিচে এসে সবকিছু যেন নতুনভাবে চোখে পড়ল। মঙ্গল প্রদীপগুলো তখনো দপদপ করে জ্বলছে। যুবক-যুবতীদের নির্বিকার মিলনমেলা। পুরো পরিবেশের কোথাও আমি আমার একান্ত থিতিয়ে পড়া ইমানের জুমাবারটিকে খুঁজে পাইনি সেদিন। মসজিদে চলে এলাম। ভর্তির টাকা দেওয়া থাকলেও সেদিনই ছিল ছায়ানটে আমার শেষ যাওয়া। এ ঘটনাটি আমার ‘সংস্কৃতিমনা’ চিন্তাজগতে বড় একটা ধাক্কা দিয়েছিল। বুঝলাম এ জগতে নিজের ন্যূনতম ধর্মের প্রকাশও বড় বেমানান।”

ফাহাদের এ বয়ানে যেমন ইসলাম ও বাঙালি মুসলমানকে অপরায়নের সাংস্কৃতিক মেকানিজমের হদিস পাওয়া যায়, একইভাবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের পাটাতনে নির্মিত বাঙালিত্বকে পরিত্যাগ করে আবার ইসলামে, বাঙালি মুসলমান পরিচয়ের দিকে যাওয়ার প্রত্যয়ও লক্ষণীয়। সেই সঙ্গে বাঙালি মুসলমানকে যে গান-বাজনা, আনন্দ-উৎসব-উদযাপনবিরোধী হিসাবে প্রচার করা হয়, তথা ইসলাম কূপমণ্ডূক, মধ্যযুগীয় এবং বর্বর-ফাহাদের বয়ান এ অপপ্রচারকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।

জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ইসলামি পরিচয়কে ধারণ করাদের অংশগ্রহণ ছিল সবচেয়ে বেশি-এ আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিকাংশই এসেছে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে, রাস্তায় আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের মধ্যেও বাঙালি মুসলমানের সন্তানরাই সবচেয়ে বেশি। তাদের সঙ্গে আরও ছিল অমুসলমান বাংলাদেশিদের অনেকেই, যারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাংস্কৃতিকভাবে চাপায়ে দেওয়া বাঙালি পরিচয়ের গা-জোরামিকে পরিত্যাগ করেছে, ‘তোরা বাঙালি হয়া যা’ নির্দেশনাকে না বলে দিয়েছে।

এবারের পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে হিন্দুত্ববাদী চিহ্নাদি ও আচার বাদ দেওয়ার পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানসহ আরও ২৮টি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও আনন্দ উদযাপন বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিনির্মাণ করার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে দেখা যায়, যেখানে বাঙালি মুসলমান বা আর কোনো জাতিসত্তাকে অপরায়ন ও দানবায়ন করা হবে না।

ড. হাসান মাহমুদ : নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কাতার

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম