Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক সংকট

Icon

ড. হাসান মাহমুদ

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয় ও সাংস্কৃতিক সংকট

ছবি: সংগৃহীত

একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদের জাতীয় পরিচয় নিয়ে একটা বিতর্ক জারি আছে। জাতি হিসাবে আমরা কি বাঙালি, নাকি মুসলমান-এ প্রশ্নের মধ্যে ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ দুটি পরিচয়কে পৃথক ধরে নেওয়া হয়েছে এমনভাবে যেন একজন বাঙালির পক্ষে মুসলমান হওয়া বা একজন মুসলমানের পক্ষে বাঙালি হওয়া সম্ভব না। অথচ, বাস্তবে একজন ব্যক্তির পক্ষে একইসঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হওয়া সম্ভব। এ বিষয়টা পরিষ্কার বোঝা যায় প্রত্যয় দুটোর সংজ্ঞা আর বাস্তব উদাহরণ দিয়ে।

বাঙালি বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীকে, যারা ভৌগোলিকভাবে বাংলা হিসাবে পরিচিত অঞ্চলে প্রজন্ম পরম্পরায় বসবাস করে, বাংলা ভাষায় কথা বলে, এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ খায়, এ সমাজে প্রচলিত নানা আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি অনুসরণ করে, ইত্যাদি। অন্যদিকে মুসলমান হলো ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়। পৃথিবীর যে কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের, যে কোনো ভাষাভাষী ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীই মুসলমান হতে পারে শুধু তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির ভিত্তিতে। তার মানে, বাংলা অঞ্চলের বাংলাভাষী, বাঙালি সমাজের ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর পক্ষে ইসলাম গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মুসলমান হতে বাস্তবে কোনো বাধা নেই। সত্যি বলতে, পৃথিবীর যে কোনো ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জন্যই তাদের দেশ, ভাষা, সামাজিক রীতিনীতির নানা পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমান হতে বাস্তবে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নব্বই শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর বেলায় এই প্রশ্ন বারবার সামনে চলে আসে যে, ‘আমি বাঙালি, না মুসলমান?’ জাতীয় পরিচয় নিয়ে এ সংকট যথাযথভাবে উপলব্ধির মাধ্যমে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করাটা চব্বিশের জুলাই-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জ।

বাংলা অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় নিয়ে এ সংকটের প্রথম প্রকাশ দেখা যায় এখন থেকে ঠিক ১৪৪ বছর আগে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার পরিচালিত সর্বপ্রথম ১৮৭১ সালের আদমশুমারিতে বাংলার পল্লি অঞ্চলে-সুনির্দিষ্ট করে বললে, পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষকসমাজের অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি শিক্ষিত সমাজ এ আবিষ্কারে অবাক হয়। কারণ, তারা বিশ্বাস করত যে, বাংলা অঞ্চল হিন্দু জনগোষ্ঠীর আবাস এবং হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু। সেই থেকে বাঙালি জাতির পরিচয় ও ইতিহাস নিয়ে এক সুদীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের সূচনা হয়।

আদমশুমারির দশ বছর পর ‘বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ (১৮৮১) শীর্ষক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, বাংলার এ সংখ্যাগুরু মুসলমান কৃষকসমাজ ‘স্বধর্ম ত্যাগ করিয়া মুসলমান হইয়াছে।’ আর তাদের সেই ‘স্বধর্ম’ ছিল হিন্দু ধর্ম। এই দাবির পক্ষে তিনি যুক্তি দেন, বাইরে থেকে শাসক হিসাবে আগত সামান্যসংখ্যক মুসলমানের পক্ষে বংশবিস্তার করে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে আদমশুমারি অনুযায়ী সমগ্র বাঙালি জাতির অর্ধেক যে মুসলমান হিসাবে পাওয়া গেল, এটা কীভাবে ঘটল? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বঙ্কিম তার পরবর্তী প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালীর উৎপত্তি’তে বাংলার সব জনগোষ্ঠীকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন জাতি হিসাবে বিভক্ত করেন-আর্য, অনার্য, অনানার্য ও মুসলমান। তিনি এ চারটির মধ্যে প্রথম তিনটি জাতিকে হিন্দু হিসাবে শনাক্ত করেন তাদের মধ্যে প্রবহমান আর্যরক্তের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে; চতুর্থটিকে তিনি মুসলমান হিসাবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু ঠিক কীভাবে সেই চার নম্বর অংশটি মুসলমান হয়ে উঠল, এ প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর তিনি দেননি। এমনকি তার উল্লিখিত নানা মাত্রায় আর্যরক্তের উত্তরাধিকারী তিনটি জনগোষ্ঠীই বা কখন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় হিন্দু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, সেই আলোচনাও তিনি উপস্থাপন করেননি। তিনি অনুমান করে নিয়েছেন যে, হিন্দুরা আবহমানকাল ধরেই বাংলার অধিবাসী। অর্থাৎ, বঙ্কিমচন্দ্র তার আলোচনার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মীমাংসা উপস্থাপন করেননি-এক. বাংলার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী মুসলমান হয়েছে কীভাবে? দুই. বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি হয়েছিল কীভাবে?

পরবর্তীকালে বঙ্কিমের আলোচনার সূত্র ধরে বাঙালি জাতির পরিচয় নিয়ে সেই যে আলাপ ও বিতর্কের শুরু হলো, তা অদ্যাবধি জারি আছে।

২.

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘সংস্কৃতির সংকট’ নামক বইয়ে বদরুদ্দীন উমর উল্লেখ করেন, ‘‘আমরা বাঙালি, না মুসলমান?’ এই প্রশ্ন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মনকে কিছুদিন থেকে আলোড়িত করে এলেও আজ আবার সেটা অল্পসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনে নোতুন করে দেখা দিয়েছে” (পৃষ্ঠা ৩)। এরপর তিনি যথাযথ যুক্তিসহকারে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে এই প্রশ্নকে ‘অর্থহীন’ হিসাবে প্রমাণ করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন থাকে, এহেন অর্থহীন একটা প্রশ্ন কীভাবে বাংলার সব মুসলমান জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ের আলোচনার কেন্দ্রে আসে? আর কীভাবেই বা এ প্রশ্নের সুরাহা করা যায়? এ প্রসঙ্গে উমর লিখেছেন, “মুসলমান বাঙালীর জীবনে এই সাংস্কৃতিক সমস্যা সাম্প্রদায়িকতার সমসাময়িক। সাম্প্রদায়িকতা যখন তীব্র আকার ধারণ করেছে, ‘আমরা বাঙালি, না মুসলমান?’ এ-প্রশ্ন তখনই আনুপাতিক প্রচণ্ডতার সঙ্গে মাথা তুলে এ সাংস্কৃতিক সংকটকে করে তুলেছে দুরূহতর” (পৃষ্ঠা ১২)।

চলমান সাংস্কৃতিক সংকটের মধ্যে আলোচ্য প্রশ্নটির উৎপত্তি নির্ণয় করার সঙ্গে সঙ্গে উমর জাতিগত পরিচয়ের এ সংকট থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘এ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বস্তরে এবং সর্বভাবে খর্ব করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া’ (পৃষ্ঠা ১২)। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এভাবেই বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সংকটকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। আর এ ক্ষেত্রে সফল হলেই আর কোনো দিন ‘আমরা বাঙালি, না মুসলমান?’ এমন অর্থহীন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।

তাহলে সর্বপ্রথমে জানা দরকার উমর সাম্প্রদায়িকতা বলতে কী বুঝিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামের প্রকাশিত গ্রন্থে বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করছেন : ‘কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে’ (পৃষ্ঠা ১)।

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে উমরের প্রদত্ত এ সংজ্ঞাটাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য; সাংস্কৃতিক ও জাতীয় পরিচয় বিষয়ক যাবতীয় আলোচনা ও বিতর্কেও এ সংজ্ঞাই একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে গৃহীত।

মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসাবে সুপরিচিত উমরের প্রস্তাবিত সাম্প্রদায়িকতার এ সংজ্ঞাকে বাংলাদেশের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীরা স্বভাবতই মার্ক্সবাদী বা বস্তুবাদী সংজ্ঞা হিসাবেই বিবেচনা করে থাকে। উল্লেখ্য, মার্ক্সবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে থাকে জনগোষ্ঠীর সামাজিক শ্রেণিগত (social class) অবস্থান। কিন্তু নানা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে জনগোষ্ঠীর সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থানকে বারবার আলোচনায় নিয়ে এলেও উমর তার প্রস্তাবিত সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞার ভিত্তিতে নিয়ে এসেছেন ‘ধর্মীয়’ সম্প্রদায়গত অন্তর্ভুক্তি। তার প্রদত্ত এ সংজ্ঞায় সাম্প্রদায়িকতার দুটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাচ্ছে-এক. পৃথক ধর্মীয় পরিচয়ের (religious identity) ভিত্তিতে পৃথক সম্প্রদায়; দুই. ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় কর্তৃক অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধন (antagonistic, hostile).

উমরের এ সংজ্ঞাটি তার নিজের বয়ানেই স্ববিরোধী। কারণ, সামাজিক পরিচয় আর ধর্মীয় পরিচয় পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক কোনো ব্যাপার নয়। যেমন, উচ্চ, মধ্য বা নিম্নবিত্ত (তথা, সামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান) যে কোনো ব্যক্তিই ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্মসহ আর যে কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের (তথা, ধর্মীয় পরিচয়) অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। উলটোভাবে, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের অন্তর্ভুক্তি লক্ষণীয়।

উমরের প্রস্তাবিত এবং সর্বজনগৃহীত সাম্প্রদায়িকতার এ সংজ্ঞাকে একাডেমিয়ায় প্রচলিত মাপকাঠিতে বিবেচনা করলেও যথার্থ মনে হয় না। সাম্প্রদায়িকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো communalism. বহুল প্রচলিত ইংরেজি ভাষার ডিকশনারিগুলোর মধ্য থেকে দুটি ডিকশনারিতে প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা নিয়ে উমরের প্রদত্ত সংজ্ঞার যথার্থতা যাচাই করা যাক। Merriam-Webster ডিকশনারিতে Communalism-এর সংজ্ঞা আছে দুটি : এক. social organization on a communal basis-সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করা; দুই. loyalty to a sociopolitical grouping based on religious or ethnic affiliation-ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের পার্থক্যের ভিত্তিতে সামাজিক-রাজনৈতিক দলাদলি। আর Collins-এর ডিকশনারিতে সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা পাওয়া গেল চারটি : এক. a system or theory of government in which the state is seen as a loose federation of self-governing communities-এমন একটা তত্ত্ব বা শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রকে বিবেচনা করা হয় শিথিলভাবে পারস্পরিক সম্পর্কিত স্বশাসিত গোষ্ঠীগুলোর একটা সংগঠন; দুই. an electoral system in which ethnic groups vote separately for their own representatives-এমন একটা নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে পৃথক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো আলাদা আলাদাভাবে তাদের নিজ নিজ প্রতিনিধি নির্বাচন করে; তিন. loyalty to the interests of one's own ethnic group rather than to society as a whole-সমগ্র সমাজের বদলে নিজ নিজ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য; চার. the practice or advocacy of communal living or ownership-সম্প্রদায়গতভাবে বসবাস বা মালিকানা চর্চা করা।

অর্থাৎ, নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য এবং নিজ সম্প্রদায়ের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির রাজনীতিই হলো সাম্প্রদায়িকতা। আর এ ‘নিজ সম্প্রদায়’ গঠনের ভিত্তিতে শুধু ধর্মই না, এর সঙ্গে আরও দেখা যাচ্ছে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, যেখানে ভাষা, বর্ণ (caste) ও জাতীয়তাও (nationality/citizenship) একেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।

একথা সত্য, বাস্তবে ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের ভিত্তিতে পৃথক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানা সময়ে নানা দেশে সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতা ও সংঘাত দেখা যায়। যেমন, আরাকানে নৃতাত্ত্বিকভাবে আলাদা রাখাইন আর রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সংঘাত, ভারতের মণিপুর রাজ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে পৃথক হিন্দু আর খ্রিষ্টানদের মধ্যকার সংঘাত, উত্তরপ্রদেশ আর বিহার রাজ্যে বর্ণের ভিত্তিতে পৃথক উচ্চবর্ণ আর দলিতদের মধ্যকার সংঘাত। এসবের দৃষ্টান্ত থেকে একথাও বলা যায় যে, নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থে পরিচালিত হয় বলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রায়শই অন্যান্য প্রতিযোগী সম্প্রদায়ের স্বার্থে আঘাত হানে। কিন্তু এই হানাহানি সাম্প্র্রদায়িকতার ফলাফল মাত্র, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভিত্তি বা কারণ নয়। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবশ্যক বা ডিফাইনিং ফ্যাক্টর হলো নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য/বিশ্বস্ততা/নিবেদিতপ্রাণ থাকা (Loyalty to the community)।

অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধনের আকাঙ্ক্ষা যে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি নয়, এ বিষয়টি আরও কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মের অনুসারীই নিজেদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের একেকজন সদস্য মনে করে, নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ থাকে এবং একইসঙ্গে অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করে সুদীর্ঘকাল। উমরের প্রদত্ত সংজ্ঞা সঠিক হলে এমন সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান কখনোই দেখা যেত না। প্রত্যেকেই ভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ ও ক্ষতিসাধনে লিপ্ত থাকত, যা বাস্তবে কখনোই দেখা যায় না, এবং কোথাও দেখা যায়নি।

৩.

উপরের আলোচনায় এটি পরিষ্কার যে, আমাদের জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির সংকট চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সফল হলেও বদরুদ্দীন উমরের আলোচনায় এ সংকট থেকে উত্তরণের কার্যকর পথ পাওয়া যাচ্ছে না।

‘আমরা বাঙালি, না মুসলমান?’-এই প্রশ্ন উমরের পূর্ববর্তী বাঙালি মুসলমান সমাজে ছিল, উমরের সময়ে দেখা দিয়েছিল, আর বর্তমানেও একইভাবে বিদ্যমান। আমাদের সমাজের সর্বত্রই বাঙালি মুসলমানকে অনিবার্যভাবেই এ প্রশ্নের মোকাবিলা করে চলতে হয়। উমর এ সমস্যার কারণ বা ভিত্তি হিসাবে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে চিহ্নিত করেছেন, এবং এ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নির্মূলের মধ্য দিয়ে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা এ সাংস্কৃতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন, তা অযৌক্তিক ও অবাস্তব। এ থেকে আবার এমন কথা বলারও জো নেই যে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোনো সংকট নেই। অথবা, বাঙালি মুসলমানের জাতীয় পরিচয় নিয়ে সংকট নেই। না, এ সংকট অবশ্যই আছে। ধর্ম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধও আছে। কখনো কখনো সেই বিরোধ থেকে সংঘাত-হানাহানিও ঘটে। কিন্তু সেসব হানাহানির কারণ বা ভিত্তি এসব জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নয়। অর্থাৎ, বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সংকটের কারণ অন্যকিছু।

ড. হাসান মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)

বাঙালি মুসলমান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম