সিদ্ধান্ত নিতে হবে সতর্কতা, বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এইচআরএম রোকন উদ্দিন (অব.)
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকটগুলোর একটি সামাল দিচ্ছে-রোহিঙ্গা সমস্যা। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধদের বর্বরতা ও জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের কক্সবাজারে গড়ে ওঠা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প এখন পরিণত হয়েছে একটি সামাজিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বোঝায়। এ পটভূমিতে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে উত্থান ঘটেছে আরাকান আর্মির, যারা ইতোমধ্যেই রাখাইনের ১৭ জেলার মধ্যে ১৪টি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এটি শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ নয়, বরং একটি সম্ভাব্য নতুন রাষ্ট্র বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের জন্মের ইঙ্গিতও দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ হয়ে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য একটি মানবিক করিডর খোলার। এ প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন মানবিক ও কূটনৈতিক সুযোগের দ্বার খুলে দিতে পারে, অন্যদিকে রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও কৌশলগত ভারসাম্যের দুঃসহ চ্যালেঞ্জ।
পটভূমি ও বিদ্যমান বাস্তবতা
১. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যর্থতা : এখন পর্যন্ত তিনবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমার সরকারের নিরুত্তর অবস্থান এবং রাখাইনে অনিরাপদ পরিস্থিতি এ ব্যর্থতার মূল কারণ।
২. আরাকান আর্মির উত্থান ও নিয়ন্ত্রণ : বর্তমানে শুধু বিদ্রোহী নয়, বরং রাখাইনের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় প্রশাসনিক কাঠামো, ট্যাক্স সংগ্রহ, নিরাপত্তাব্যবস্থাও চালু রয়েছে।
৩. মানবিক করিডরের প্রস্তাব : জাতিসংঘের মতে, রাখাইনে আটকে পড়া বহু সাধারণ নাগরিক বর্তমানে খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এ করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সাহায্য পৌঁছানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
প্রস্তাবের সম্ভাব্য সুফল
১. কূটনৈতিক লিভারেজ সৃষ্টি : বর্তমানে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ যত বিস্তৃত হচ্ছে, ততই তারা একটি ভবিষ্যৎ প্রশাসনিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত জনগণের সহায়তায় অংশগ্রহণ করে, তবে আরাকান আর্মির কাছে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে একটি ভবিষ্যৎ অংশীদার ও সহানুভূতিশীল প্রতিবেশী।
এ অবস্থান বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আলোচনার টেবিলে একটি শক্তিশালী পক্ষ করে তুলতে পারে। ভবিষ্যতে যদি আরাকান আর্মি রাখাইনে একটি কার্যকর প্রশাসন গঠন করে, তাহলে এ পূর্ববর্তী সহযোগিতা তাদের ওপর নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে-রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনে সহযোগিতা করতে।
২. আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও সহানুভূতির সম্ভাবনা : বর্তমানে বিশ্বে রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থার মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। এ মুহূর্তে বাংলাদেশ যদি একটি মানবিক করিডরের অনুমতি দিয়ে নির্যাতিত রাখাইনবাসীর পাশে দাঁড়ায়, তাহলে তা হবে দেশের মানবিক নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীলতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি ও অন্যান্য উন্নত দেশের সহানুভূতি ও সমর্থন অর্জন করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন (resettlement) এবং অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে।
৩. রাখাইন অঞ্চলের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রস্তুতি : রাখাইনে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে। মিয়ানমার জান্তা সেখানে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এবং আরাকান আর্মি প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে। এ রূপান্তরের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রয়োজন ‘forward looking diplomacy’, অর্থাৎ ভবিষ্যতের বাস্তবতা মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া। যদি ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি রাখাইনের শাসনে অংশ নেয় বা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসাবে কার্যকর হয়, তাহলে এখনই সীমিত মানবিক সহযোগিতা ও নিরপেক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে বাংলাদেশ রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে সরাসরি মাটিভিত্তিক তথ্যও পেতে পারে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে।
৪. চীন-ভারত প্রতিযোগিতায় কৌশলগত ভারসাম্য স্থাপন : রাখাইন রাজ্য শুধু মানবিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক হটস্পট। চীন তার ‘China-Myanmar Economic Corridor’ (CMEC) প্রকল্পের জন্য রাখাইন উপকূল (বিশেষত কিয়াউকফু বন্দর) ব্যবহার করতে চায়। অপরদিকে, ভারত ‘Kaladan Multimodal Project’-এর মাধ্যমে রাখাইন থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশের কৌশল নিতে চায়। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি মানবিক করিডরের মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল ও নিরপেক্ষ উপস্থিতি বজায় রাখে, তাহলে এটি চীন-ভারত প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তা না হলে বাংলাদেশ এ প্রতিযোগিতার বাইরে থেকে শুধু প্রভাবিত হবে, কিন্তু প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
এ করিডরের মাধ্যমে রাখাইন অঞ্চলে বাংলাদেশের নরম উপস্থিতি (soft footprint) তৈরি হবে, যা কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ভবিষ্যতে সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক সংযোগ এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি হবে।
প্রস্তাবের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
১. নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি : যে কোনো আন্তঃসীমান্ত করিডর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সীমান্ত নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বড় ঝুঁকি থাকে। মানবিক করিডরের আড়ালে জঙ্গিগোষ্ঠী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, চোরাচালানকারী কিংবা নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে পারে, যা শুধু সীমান্ত এলাকা নয়, পুরো দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাখাইন অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তাহীন ও অস্ত্র-সংঘাতপূর্ণ এলাকা। এ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হলে মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যদি করিডর পর্যাপ্ত নজরদারিতে না থাকে, তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী চরম চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে।
২. বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বৈধতার প্রশ্ন : বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র। কোনো সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সহানুভূতি বা সহযোগিতা দেখানো আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সংবেদনশীল ও বিতর্কিত বিষয়। প্রস্তাবিত করিডর ব্যবহারের মাধ্যমে যদি আরাকান আর্মিকে সহায়তা পাঠানো হয়, তাহলে তারা এটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বা রাজনৈতিক বৈধতার ইঙ্গিত হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে ভবিষ্যতে মিয়ানমার সরকার ও ASEAN-এর মতো সংগঠনগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে। এমনকি এতে বাংলাদেশের নিরপেক্ষতার নীতিও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
৩. মিয়ানমারের প্রতিক্রিয়া : মিয়ানমারের সেনাশাসিত সরকার (তাতমাদ) এ করিডরকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি পক্ষপাতদুষ্ট পদক্ষেপ হিসাবে দেখতে পারে। তারা এটিকে আরাকান আর্মির প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ ও নিজেদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করতে পারে। এর ফলে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়তে পারে, যেমন-সীমান্তে সেনা সমাবেশ, গুলিবিনিময় বা অনুপ্রবেশের ঘটনা। পাশাপাশি মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান সামান্য কূটনৈতিক যোগাযোগও বাতিল বা স্থগিত করতে পারে, যার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কূটনৈতিক পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৪. অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও রাজনীতি : এমন একটি সংবেদনশীল ও জটিল ইস্যুতে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ সিদ্ধান্তকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বা দেশবিরোধী সিদ্ধান্ত হিসাবে তুলে ধরে। দেশের ভেতরে কিছু মহল এ করিডরকে বাংলাদেশকে যুদ্ধে জড়ানোর পথ, কিংবা মিয়ানমার বা ভারতের সঙ্গে কৌশলগত বিরোধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি হিসাবে প্রচার করতে পারে। সামাজিকমাধ্যমে অপপ্রচার, ধর্মীয় বা জাতিগত উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কাও থেকে যায়। তাছাড়া, জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে প্রভাবিত করতে পারে, যা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশের করণীয় ও সুপারিশ
১. শর্তসাপেক্ষ সহযোগিতা : বাংলাদেশকে মানবিক করিডরের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কড়া শর্ত আরোপ করতে হবে, যা এ করিডরকে মানবিক সহায়তা প্রদানে সীমাবদ্ধ রাখবে এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করবে। করিডরের সময়সীমা নির্দিষ্ট করতে হবে (যেমন ৩ মাস বা ৬ মাসের জন্য)। শুধু খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি ত্রাণসামগ্রী পরিবহণের অনুমতি থাকবে। কোনো ধরনের যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি বা দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য (dual-use) পণ্য পরিবহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। করিডর ব্যবস্থাপনায় পুলিশ, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষের সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের কঠোর শর্ত আরোপ না করলে করিডরটি ভবিষ্যতে অকার্যকর বা বিপজ্জনক রূপ নিতে পারে।
২. জাতিসংঘ ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের শর্ত : বাংলাদেশ কোনোমতেই এককভাবে এ করিডর পরিচালনা করবে না-এ বার্তা স্পষ্ট করতে হবে। করিডর ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে : জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা (UNHCR), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তত্ত্বাবধান। ওআইসি বা আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মতো নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য মানবিক সংস্থার অংশগ্রহণ। সীমান্ত এলাকা ও করিডরের ভেতরে নিরাপত্তা ও লজিস্টিক মনিটরিংয়ের জন্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন। এ শর্ত না থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে করিডরের অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী করা হতে পারে।
৩. প্রত্যাবাসনের শর্ত সংযুক্ত করা : বাংলাদেশের পক্ষে এ করিডর অনুমোদন করার শর্ত হওয়া উচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাস্তব ও লিখিত অগ্রগতি। জাতিসংঘকে করিডর বাস্তবায়নের আগে আরাকান আর্মি ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক করতে হবে, যেখানে উল্লেখ থাকবে-রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে প্রস্তুতি, গৃহনির্মাণ, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি। আরাকান আর্মি যদি ভবিষ্যতে রাখাইন শাসনে অংশ নেয়, তাহলে তাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা, অধিকার ও সহনশীলতা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি আদায় জরুরি। প্রত্যাবাসনের সময়সীমা ও ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের রূপরেখাও সংযুক্ত করা উচিত।
৪. কূটনৈতিক নিরপেক্ষতা : বাংলাদেশকে কঠোরভাবে ঘোষণা দিতে হবে-এ করিডর কেবল মানবিক উদ্দেশ্যে অনুমোদিত। এতে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক অবস্থান বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত নেই। একাধিক ভাষায় (বাংলা, ইংরেজি, বর্মী) সরকারি প্রেস রিলিজ, বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এ নিরপেক্ষতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মাধ্যমে সব অংশীদারকে চিঠি দিয়ে জানাতে পারে যে, এটি শুধু একটি মানবিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পদক্ষেপ। এ কূটনৈতিক নিরপেক্ষতা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনার সুযোগ ধরে রাখতে সহায়ক হবে।
৫. পূর্ণ নিরাপত্তা প্রস্তুতি ও কন্টিনজেন্সি প্ল্যান : মানবিক করিডর বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় বহুমুখী নিরাপত্তা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। করিডর ও আশপাশের এলাকায় ইও/ইএই, সেনাবাহিনী, পুলিশ, NSI, DGFI-এর সমন্বিত কমান্ড সেল গঠন করতে হবে। ড্রোন নজরদারি, মোবাইল চেকপোস্ট, ট্রাক-স্ক্যানিং প্রযুক্তি এবং চলাচলের রেকর্ড সংরক্ষণ চালু করতে হবে। যদি কোনো সময় করিডরে অপব্যবহার বা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে করিডর স্থগিত করার জন্য বিকল্প পরিকল্পনা (contingency plan) থাকতে হবে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও নিরাপত্তা সংস্থার সমন্বয়ে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ ইউনিট গঠন করাও বিবেচনাযোগ্য।
প্রস্তাবিত মানবিক করিডর একটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হলেও তা বাংলাদেশের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগও। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রেখে যদি বাংলাদেশ মানবিক সহায়তায় অংশ নেয়, তবে তা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ উন্মুক্ত করতে পারে। তবে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে সতর্কতা, বিচক্ষণতা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার আলোকে-অজ্ঞতা বা আবেগের বশে নয়।
জনগণকে অকারণে বিভ্রান্ত না করে সঠিক তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা প্রয়োজন। কারণ এ করিডর শুধু একটি লজিস্টিক ইস্যু নয়, এটি বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থান, আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এইচআরএম রোকন উদ্দিন (অব.) : সাবেক কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক
